ফিরআউন, নমরূদের কথা উম্মাহ্ জানে। তারা খোদা দাবী করেছিল। তাদের খোদাদ্রোহীতা, ইসলামদ্রোহীতা অতীত ইতিহাস। বড়ই ঔদ্ধত্যপূর্ণ, ঘৃণীত সে ইতিহাস। বলাবাহুল্য, তুরস্কের কামাল সে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। সে ফিরআউন, নমরূদেরই প্রতিভু। তুরস্কের মুসলমানদের মুসলমানিত্বের শেষ চিহ্নটুকু উঠিয়ে দেবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছে কামাল।
দেশ থেকে পর্দা উঠিয়ে দেয়া, নারীদের নৃত্যে বল প্রয়োগ বাধ্য করা, মাযার-খানকা শরীফ তুলে দেয়া, দরবেশদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, হিজরী সন উঠিয়ে দেয়া এমনকি মুস্তফা, আহমদ প্রভৃতি আরবী শব্দ উঠিয়ে দেয়া, আরবী বর্ণমালা উঠিয়ে দিয়ে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা, আরবীর পরিবর্তে তুর্কী ভাষায় নামায পড়তে বাধ্য করা, ইসলামকে তুরস্কের রাজধর্ম থেকে বাদ দেয়া, মসজিদের বাইরে ইমাম-মুফতীদের পাগড়ী, জুব্বা পরিধান নিষিদ্ধ হওয়া, পক্ষান্তরে ইউরোপীয় পোশাক যথা সুট পরিধানের আইন প্রণয়ন করা এবং আইন ভঙ্গকারীদের জন্য তথাকথিত বিপ্লবী আদালতের মাধ্যমে কারাগারে নিক্ষেপ, ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো, সালাম উঠিয়ে তার পরিবর্তে ঐমমঢ ুমরভধভথ ও হ্যান্ডশেক প্রবর্তন অর্থাৎ এক কথায় ইসলামী সব আচরণ উঠিয়ে দিয়ে তদস্থলে ইউরোপীয় কালচার প্রচলন করা সব কামালের কুকীর্তি। যে প্রসঙ্গে গত সংখ্যায় আলোকপাত করা হয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, খুলাফায়ে রাশেদার সময় থেকে যে খিলাফত মুসলিম উম্মাহ্র প্রাণ প্রতীক ছিল তার ধারাবাহিকতা তুরস্কে তখনও বহাল ছিল। সে কারণে তুরস্কের এই খিলাফত ছিল সমসাময়িক বিশ্বে মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণযুগের একটি প্রতীক, একটি স্তম্ভ, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের লক্ষ্যস্থল, তাদের আশা-উদ্দীপনা, চেতনা স্বরূপ। তথা গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম ঐতিহ্যের শেষ চিহ্ন স্বরূপ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কামাল এই পুরাতন ও প্রভাবশালী খিলাফতকে ছলেবলে তিরোহিত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। সর্বশেষ খলিফা ছিল সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ। আর খিলাফত উচ্ছেদের একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ আসে ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে ল্যুসেনে অনুষ্ঠিত সভায় ষষ্ঠ মুহাম্মদের উপস্থিতিতে। জাতীয় পরিষদের বিনা অনুমতিতে তিনি উপস্থিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় এবং ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর খিলাফত উচ্ছেদ বিল জাতীয় পরিষদ প্রণয়ন করে। এর ফলে খিলাফত রহিত হয় এবং সুলতান লণ্ডনে আশ্রয় গ্রহণ করে। যদিও খিলাফত রহিত করলে এর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনা মনে করে কামাল তৎক্ষনাৎ তা পুরোপুরি কার্যকর করতে ভয় পায়। কিন্তু খিলাফত উচ্ছেদ ছিল তার গোপন ইচ্ছা। এ কারণে ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে সাময়িকভাবে আব্দুল মজিদ এফেন্দিকে নতুন খলিফা বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাকে ধর্মীয় ক্ষমতা ব্যতীত কোন শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়া হয়না। খিলাফত রহিতের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিরোধ করে খিলাফত আন্দোলন গড়ে উঠে। ভারতবর্ষেও আগা খান, সৈয়দ আমীর আলী, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী খিলাফত বজায়ের পক্ষপাতি ছিলেন; এমনকি অনেকে শেষ উপায় খিলাফত উচ্ছেদ না করে কামালকেই খলীফা হওয়ার আহবান জানায়।
কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী কামাল খিলাফত ধারণাটাই রাখতে ইচ্ছুক ছিলনা। কারণ তাতে যে ইসলামী চেতনা প্রতিফাত হয়। তাই সমগ্র মুসলিম বিশ্বের একান্ত অনুরোধ তথা চাপ থাকা সত্বে জাতীয় পরিষদ ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দের, ২৯শে অক্টোবর খিলাফত রহিত বিলের বিরোধিতার জন্য রাষ্ট্র্র্রদ্রোহিতার বিল পাস করে এবং প্রচার করে যে, তুরস্ক একটি প্রজাতন্ত্র এবং জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের প্রধান খলিফা নন। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রধান প্রেসিডেন্ট। আব্দুল মজিদ সাময়িকভাবে মুসলমানদের খলিফারূপে পরিচিত হলেও ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের ২রা মার্চ নবগঠিত রিপাবলিকান পিপলস পার্টির সভায় কামাল পাশা খিলাফত সম্পূর্ণরূপে রহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ৩রা মার্চ জাতীয় সভা এই বিষয়ে বিল পাস করে। এরপরে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় হতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দ হতে খিলাফত শুরু হয়ে দীর্ঘ তের শতাব্দীর পর ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষিত হল। আব্দুল মজিদ পরিবার পরিজনসহ বহিষ্কৃত হন। কিন্তু পাঠক! তারপরেও শুধু এ যুগেই নয় সে সময়েও এই খোদাদ্রোহী, ইসলামদ্রোহী ও ইসলামের চরম শত্রু কামালের ভাবমূর্তি ইহুদীবাদী প্রচার মাধ্যমের কারণে কিরূপ ছিল ডঃ মুহম্মদ আব্দুল কাদের লিখিত ‘আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস’ থেকে তা জানা যায়। “জগতে কেউ অমর নয়। কামালও চিরজীবী হয়ে আসেনি। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে অক্টোবরের শেষে ইস্তাবুলে তার পুরাতন অসুখ দেখা দিল। পক্ষাঘাত প্রভৃতি নতুন উপসর্গও জটিল। ৮ই নভেম্বর তার সংজ্ঞা লোপ পেল। ১০ তারিখে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে সে চিরতরে চক্ষু মুদলো। এই সংবাদে সমগ্র প্রাচ্য– বিশেষতঃ মুসলিম জগত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। মুসলমান রাজ্য ও প্রদেশগুলোতে শোক সভার অনুষ্ঠান হল। মুসলমানেরা কাজ-কর্ম বন্ধ করে মসজিদে গিয়ে মৃতের আত্মার মাগফিরাতের জন্য প্রার্থনা করল। স্বরাজ্যের বাইরে কোন রাজার জন্য এভাবে শোক প্রকাশের দৃষ্টান্ত এই সর্বপ্রথম। জন্মের মত কামালের মুখাবলোকন করার জন্য দেল্মা বাগ্চি প্রাসাদে জনতার হাট বসে গেল। পুলিশের সর্বপ্রকার চেষ্টা সত্ত্বেও ৪ জন মুসলমান, ৩ জন ইহুদী, ১ জন আর্মেনিয়ান ও ২ জন বৈদেশিক ভিড়ের চাপে প্রাণ হারাল। এদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ আর ৭ জনই নারী। কামাল জনসাধারণের বিশেষতঃ নারী সমাজের কত প্রিয় ছিলেন, এটাই তার প্রমাণ। ১৫ নভেম্বর তাঁর শবদেহ আঙ্কারায় নীত হল। কৃষক ও কৃষক রমনীরা ৪০/৫০ মাইল পথ হেঁটে প্রত্যেক স্টেশনে তার শবাধার দেখতে আসল। জনসাধারণের প্রদত্ত দু’লক্ষাধিক পুস্পমাল্যে তা সুশোভিত হল। ইতোমধ্যে গ্রীস, জার্মানী প্রভৃতি বিভিন্ন রাষ্ট্র, এমন কি সুদূর স্পেন হতেও বৈদেশিক দূতেরা আঙ্কারায় হাযির হলেন। পরদিন সাড়ে বারোটার সময় যথারীতি তাঁর শব সমাহিত হল।” শুধু তাই নয়, এযুগেও এদেশে কামাল সম্পর্কে কিরূপ চেতনা দেয়া হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের যাবতীয় বই থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরণের একটি বইয়ে নিম্নরূপ মন্তব্য করা হয়- “মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও ইউরোপের ‘রুগ্ন দেশ’ তুরস্ককে বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষাই করেনি, নবজীবন দানও করে। সেদিক থেকে তাকে ত্রাণকর্তা বলা যেতে পারে। সে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্ককে একটি আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে। সে তার অতুলনীয় সংস্কার দ্বারা সালতানাত, খিলাফত, ক্যাপিচুলেশন ও মিল্লাত প্রথার অবসান ঘটায়। পাশ্চাত্য প্রভাবে সে তুরস্কের আধুনিকীকরণে সফলতা লাভ করে এবং প্রগতিশীল, গণতন্ত্রী এবং সংস্কারপ্রবণ তুরস্ক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কামালকে জাতীয় পরিষদ আতার্তুক বা তুর্কী পিতা নামে অভিহিত করে।” পাঠক! মূলতঃ মুসলমানগণ যতদিন যাবত ঘরের শত্রু সম্পর্কে সচেতন না হবে ততদিন পর্যন্ত বিদেশী, বেঈমান, ইহুদী, খ্রীষ্টান আমেরিকা, ইসরাইল সম্পর্কে তাদের বিষোদগার অরণ্যে রোদনে পরিণত হবে। কবি বলেছেন, ‘এই ঘরে আগুন লেগেছে ঘরেরই আগুন থেকে।’
কাজেই তুরস্কের কামালের মত মূল্যায়ণে আর ভুল নয় ইরাকের সাদ্দামও যে একই পথের যাত্রী সে সম্পর্কে আর দ্বিধা সংকোচ নয়। বরং ইহুদী খ্রীষ্টানদের দ্বারা তৈরীকৃত সাদ্দামের এই ভালোমানুষি, ইসলাম দরদী, মুসলমানদের হিরো এই দাবীর অন্তঃসারশুণ্যতা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব ততই আমাদের মঙ্গল। সাদ্দামই যে আমেরিকার হাতে ইরাককে তুলে দেয়ার নেপথ্য নায়ক তা যত শীঘ্র বুঝব ততই সঠিক পথে আগাব।
-মুহম্মদ ওয়ালীর্উ রহমান, ঢাকা।