(ধারাবাহিক)
হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে যে নির্দেশ দেয়া হলো, সে নির্দেশ পেয়ে তিনি সরাসরি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে, ফজর নামায পড়ে রওয়ানা হলেন সেই আল্লাহ পাক-এর খালিছ ওলী হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফের দিকে। সেখানে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন। একে একে তিনি তিন বৎসর সেখানে অবস্থান করলেন।
তিনি বর্ণনা করেন, আমি প্রথম গিয়ে সালাম দিলাম, হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সালামের জবাব দিয়ে তিনি চলে গেলেন, আর কোন কথা বললেন না। তিনি যে মসজিদে নামায পড়াতেন, অবস্থান করতেন আমি সেখানে অবস্থান করতে লাগলাম। এক বৎসর অতিবাহিত হলো। এরপর আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আমি বললাম, রয় প্রদেশ থেকে এসেছি। এতটুকু কথা শেষ হয়ে গেল। আরেক বৎসর অতিবাহিত হলো। এরপর তিনি আমাকে বললেন, আপনি কেন এসেছেন? আমি বললাম, আমি আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত-মা’রিফত, ইসমে আ’যম যা রয়েছে, সেটা শেখার জন্য এসেছি।’ এরপর আরো এক বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর তিন বৎসর যখন অতিবাহিত হয়ে গেল তখন হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি (এর মধ্যে হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তা’লীম-তালক্বীন তাঁর মসজিদেই চলতে থাকলো। তাতে হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি অংশগ্রহণ করতে লাগলেন।) একটা কৌটা দিয়ে অর্থাৎ কাঠের ছোট একটা কৌটা দিয়ে বললেন, এ কৌটাটা নিয়ে সামনে নদী রয়েছে, নদীর অপর পারে একজন বুযূর্গ রয়েছেন সেখানে পৌঁছে দিবেন। হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি সেটা নিয়ে রওয়ানা হলাম। নদী পার হয়ে একটা জঙ্গল, মনে মনে চিন্তা করলাম, এ জঙ্গলের মধ্যে তো কেউ দেখবেনা, কৌটার মধ্যে মনে হচ্ছে কিছু নড়াচড়া করছে, সেটা কি নড়াচড়া করছে? সেটা দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে গেলেন। সেটা খুললেন, দেখা গেল, খোলামাত্রই সেই কৌটা থেকে একটা ইঁদুর বের হয়ে এক লাফ দিয়ে জঙ্গলে পড়ে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ফিকির করতে লাগলেন, কাজটা কি হলো? ইঁদুরটা চলে গেল, জঙ্গল থেকে তো ইঁদুর ধরা সম্ভব নয়। এখন আমি কি করব? আল্লাহ পাক-এর যে ওলীর কাছে আমাকে পাঠানো হয়েছে, আমি কি তাঁর কাছে যাব? অথবা আমি ফিরে যাব? কোনটা? অনেক চিন্তা করে তিনি শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক-এর যে ওলীর কাছে পাঠানো হয়েছিল, তাঁর কাছে তিনি গেলেন। যাওয়া মাত্রই সেই আল্লাহ পাক-এর ওলী বললেন যে, ‘হে ব্যক্তি! আপনি তো এসেছেন আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত, মা’রিফত শেখার জন্য, ইসমে আ’যম শেখার জন্য হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে। কিন্তু আপনাকে একটা সাধারণ ইঁদুর কৌটার মধ্যে দেয়া হলো, সেটা আপনি বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাহলে আল্লাহ পাক-এর ইসমে আ’যম, মুহব্বত-মা’রিফত যদি দেয়া হয়, সেটা কি করে আপনি বরদাস্ত করবেন? আপনি আবার ফিরে যান হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে। তিনি গেলেন, যখন তিনি গেলেন, তখন তাঁকে বলা হলো, হে ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি! আল্লাহ পাক আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত-মা’রিফত শিক্ষার জন্য, ইসমে আ’যম শিক্ষার জন্য। এই তিন বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল, আমি আল্লাহ পাক-এর কাছে সাতবার আরয করেছিলাম যে, আল্লাহ পাক! আমি কি তাঁকে শিক্ষা দিব? কিছু দিয়ে দিব? আল্লাহ পাক বললেন, এখনো সময় হয়নি। আরো ধৈর্যধারণ করুন। আমি যখন বারবার আল্লাহ পাক-এর কাছে আরয করতে লাগলাম। আল্লাহ পাক বললেন, তাহলে আপনি এক কাজ করুন, পরীক্ষা করে দেখুন, সে উপযুক্ত হয়েছে কি-না? সেই পরীক্ষার জন্যই আমি আপনাকে এই কৌটার মধ্যে ইঁদুর ভরে দিয়েছিলাম। আপনি সেটা রক্ষা করতে পারলেন না। তাহলে এক কাজ করুন, আপনার সময় এখনও বাকি রয়েছে। আপনি দেশে চলে যান। তিনি সবক দিয়ে দিলেন এবং নছীহত করলেন। তিনটা বিষয় বললেন। যে, সবচেয়ে উত্তম একটা নছীহত রয়েছে, হযরত ইউসূফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি খুব বড় আলিম ছিলেন। হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, আপনি দেশে গিয়ে আপনার ইলমের কথা প্রচার করবেন না। সাধারণ লোকের মতো আপনি বসবাস করবেন আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি হাছিল করার জন্য। তিনি বললেন, হুযূর! ইলম্ শিখেছি, আপনার ছোহবতে থেকেছি, আমি সেটা কি করে না বলে পারব? তখন বললেন, তাহলে দ্বিতীয় আরেকটা নছীহত রয়েছে, আপনি এক কাজ করুন, ইলম্ প্রচার করুন; তবে আমার কথা বলবেন না, আপনি যে আমার কাছে মুরীদ হয়েছেন। তিনি বললেন, এটা কি করে সম্ভব? আপনি এত বড় আল্লাহ পাক-এর ওলী, আমি আপনার কাছে মুরীদ হয়েছি, বাইয়াত হয়েছি, এটা বলব না? তখন তিনি বললেন, বেশ- যদি সেটা আপনি বলতেই চান, তাহলে আরেকটা শর্ত রয়েছে, আপনাকে ওয়াজ করতে হবে, আপনি সব সময় ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ করবেন। আপনার মজলিসে মানুষ থাকুক, চাই না থাকুক। আর কখনও মানুষের জন্য অর্থাৎ নিজের জন্য ওয়াজ করবেন না, আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করবেন। যখন এ নছীহত তাঁকে করা হলো, তিনি বললেন- বেশ, তবে একটা বিষয় আমার বুঝে আসলোনা। সেটা কি? সেটা হলো, আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করবেন, নিজের জন্য করবেন না। হযরত যুন্নূন মিছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এর অর্থ হচ্ছে, আপনি যখন ওয়াজ করবেন, আপনার এলাকায় যদি অন্য কোন ওয়ায়িজ আসে ওয়াজ করার জন্য, তারা যদি সত্যিই আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করে, সেটা আপনার নিকট যদি খারাপ মনে হয় যে, সে ওয়ায়িজ ওয়াজ করে লোক ভীড়ে নিবে, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি নিজের জন্য ওয়াজ করেন, আল্লাহ পাক-এর জন্য নয়। আর অন্য কোন ওয়ায়িজ যদি আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করে আর আপনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন যে, হ্যাঁ আপনার কাজ সে করে দিচ্ছে, তাহলে বুঝা যাবে, আপনি আল্লাহ পাক-এর জন্য করছেন।
তিনি সে নির্দেশ নিয়ে চলে আসলেন। কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পঞ্চাশ বৎসর এভাবে তিনি তাঁর পীর ছাহেবের নির্দেশ পালন করলেন। প্রথম দিকে কোন লোক হতো না তাঁর মাহফিলে। তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ করতেন। একদিন মাহফিলে কোন লোকই ছিলনা। তিনি মনে করলেন, আজকে চলে যাই, লোক যখন নেই। হঠাৎ একটা বৃদ্ধা মহিলা কোথা থেকে এসে বললেন, হে ইউসুফ! আপনি পীর ছাহেবকে যে ওয়াদা দিয়েছেন, সেটা স্মরণ রাখুন। তিনি আবার সেই ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ শুরু করে দিলেন। পঞ্চাশ বৎসর পর তিনি কামালিয়াত হাছিল করলেন। তবে হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জীবনের মূল যে বিষয়, তাঁর যে ইছলাহ, তিনি পরবর্তীতে আল্লাহ পাক-এর খালিছ ওলী ও লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছিলেন, তার একমাত্র কারণ বলা হয়েছে, সেই বেগানা মেয়েদের ওয়াস্ওয়াসা থেকে বেঁচে নিজের ঈমান হিফাযত করেছিলেন। সেই কারণে আল্লাহ পাক তাঁকে আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত, মা’রিফত, নৈকট্য দান করেছিলেন। (সুবহানাল্লাহ) কাজেই খুব ফিকির এবং চিন্তার বিষয়। আল্লাহ পাক যেটা বলেছেন এবং আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেটা বলেছেন,
الحياء شعبة من الايمان.
‘হায়া হচ্ছে ঈমানের একটা অংশ।’ অর্থাৎ- ঈমান থাকবে, যখন তার লজ্জা থাকবে। আর যখন লজ্জাটা তার চলে যাবে তখন তার ঈমানটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। আর এ পর্দার জন্য আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من اطلع عليك بغيك اذنك فخذفته بحصاة ففقأت عينه فما عليك من جناح. من اطلع عليك بغير اذنك.
কোন ব্যক্তি যদি তোমার অনুমতি ব্যতীত তোমার ঘরে উঁকি দেয় অর্থাৎ অনুমতি ব্যতীত যদি কেউ কারো ঘরে উঁকি দেয়,
فخذفته بحصاة ففقأت عينه.
এ অবস্থায় যদি তুমি কংকর নিক্ষেপ করে, ইট-পাটকেল মেরে তার চক্ষুটা নষ্ট করে দাও فما عليك من جناح. শরীয়তের দৃষ্টিতে তোমাকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা যাবে না। কারণ সে কেন তোমার ঘরে উঁকি দিল, এটা তার অপরাধ। এ অপরাধের জন্য ইট-পাটকেল মারার কারণে যদি তার চোখ নষ্ট হয়ে যায় তাতেও তুমি দোষী হবে না। বরং সেই দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।