رب زدنى علما.
অর্থঃ- “হে আমার রব! আমার ইল্ম বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা ত্বাহা/১১৪)
আর ইল্ম অর্জন করবার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন,
واتقوا الله ويعلمكم الله.
অর্থঃ “তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন কর, আল্লাহ্ পাক তোমাদের ইল্ম দান করবেন।” (সূরা বাক্বারা/২৮২)
আর বলার অপেক্ষা রাখেনা আল্লাহ পাক-এর রসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই হলেন সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে সবচাইতে মুত্তাক্বী বা তাক্বওয়া সম্পন্ন; তাই তাঁর পূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণই হলো তাক্বওয়া অবলম্বনের এবং ইল্ম অর্জনের একমাত্র পন্থা।
তাই আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানা, চেনা, তাঁর মর্যাদা-মর্তবা, শান-মান অনুধাবন করার মাধ্যমেই ইল্ম অর্জন করা সম্ভব।
কারণ হাদীছ শরীফে রয়েছে,
كان خلقه القران.
অর্থঃ- “তাঁর মুবারক জীবনই হলো কুরআন শরীফ।”
মূলতঃ আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরীকা শিক্ষা করাই হলো ইলম্। আর আলিম হল সে ব্যক্তি যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরীক্বা দ্বারা ফায়দা হাছিল করেছেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাতেই বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ সুন্নাহ্ বা ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই বা বিষয় নেই, যা আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম শিক্ষা দেননি। আকাঈদ, ইবাদত, মুয়ামিলাত, মুয়াশিরাত ও তাছাউফ পর্যালোচনা করলে সহজেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلم علمان علم الاديان وعلم الابدان.
অর্থঃ- “ইল্ম দু’প্রকার, ইল্মে আদইয়ান ও ইল্মে আবদান।”
ইল্মে আদইয়ানকে ইল্মে নাকলিয়্যা বলা হয়, অর্থাৎ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস যথা আকাঈদ, ফিক্বাহ ও তাছাউফ। পক্ষান্তরে ইল্মে আবদানকে ইল্মে আকলিয়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান বলা হয়েছে। এ ইল্মে আকলিয়া আমাদেরকে ইলমে নাকলিয়া বুঝতে ও বুঝাতে সাহায্য করে। আর তাই দ্বীন সম্পর্কে প্রজ্ঞা অর্জন করতে হলে যত রকমের জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে সবই দ্বীনি ইল্মের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে ইসলামের শত্রুরা যেভাবে মুসলমানদের শতধাবিভক্ত করে মুসলিম জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে, ঠিক সে ভাবে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে শিক্ষাক্ষেত্রে। মুসলমানদের মধ্যে প্রান্তিক দুটি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করে, একটি হলো ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অন্যটি হলো কর্মহীন ধর্ম শিক্ষা। আর পরম পরিতাপের বিষয় হলো মুসলমানেরা এদুটো ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে, ফলতঃ জন্ম নিয়েছে অপাংক্তেয় দুটো দলের। একটি হলো দ্বীনের বেশধারী তথাকথিত আলিম নামের আক্বীদা বিপর্যস্থ অজ্ঞ উলামায়ে ‘ছু’ বা দুনিয়াদার নিকৃষ্ট আলিম ও অন্যটি ফাসিক-ফুজ্জার, দুনিয়াদার অথর্ব, নাস্তিক, মুরতাদ, তথাকথিত বুদ্ধিজীবি। ইসলামের শত্রুরা তাদের কু-পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছে যুগ-যুগ ধরে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাবে পূর্বের নীল-নকশা অনুসারে।
উদাহরণ ও প্রমাণ হিসাবে আমরা একটি ঘটনার অবতারনা করছি। বলা হয়ে থাকে যে, তুর্কির অটম্যানরাই তুরস্কের উসমানীয়া খিলাফত সর্বপ্রথম পরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধা, বোধশক্তি যাচাই করে ধীশক্তি সম্পন্ন বুদ্ধিমান মেধাবী প্রার্থী নির্বাচনের পদ্ধতির প্রচলন ঘটায়। আমেরিকান লিটারেচার যেমন লিখা রয়েছে যে, যখন অটোম্যান সেনা বাহিনী ভিয়েনার নিকটবর্তী হলো, তখন ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠী হতবুদ্ধি ও দিশাহারা হয়ে গেল। ইউরোপে মুসলমানদের অব্যাহত বিজয় ও খৃষ্টান ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্ম বিস্তারের আশংকায় তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হলো। অটোম্যানদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করবার জন্য অনেক চেষ্টা সাধনা করতে লাগল এবং উপায় খুঁজতে লাগল। একদিন মধ্যরাতে ইস্তামবুলে নিযুক্ত বৃটিশ এ্যামবেসিডর সাইফার-এর মাধ্যমে একটি বার্তা প্রেরণ করলো যাতে বলা হয়েছিল, “আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, অটোম্যানদের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের মূল কারণ ও তার প্রতিকার আমি খুঁজে পেয়েছি এবং সেটা বলার জন্য আমি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছিনা। সে এটাকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেছে, “অটোম্যানরা কখনো যুদ্ধবন্দীদের নির্যাতন করেনা এবং তাদের সাথে অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক ব্যবহার করে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তারা ছোট শিশুদের মেধা যাচাই করে এবং প্রচণ্ড ধীমান ও বিচক্ষণ শিশুদের নির্বাচন করে শাহী প্রাসাদের এনডারিন মাদ্রাসাগুলোতে উপযুক্ত ওস্তাদদের তত্ত্বাবধানে, ইসলামী জ্ঞান, ইসলামী আখলাক, নৈতিকতা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও কলা ইত্যাদি শিক্ষাদানের মাধ্যমে কর্মঠ, শক্তিশালী, উদ্যোগী আদর্শ মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলে। পরবর্তীতে এ সকল অসাধারণ ছেলেরাই, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনে। অতএব অটোম্যান সভ্যতাকে পরাস্ত করতে হলে তাদের এ সকল স্কুল, মাদ্রাসা এবং এদের শাখা সমূহকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে এবং এভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদেরকে পিছিয়ে দিতে হবে। অটোম্যান ইতিহাসের পরবর্তী বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা একথার সাক্ষ্য বহন করে যে, বৃটিশ রাষ্ট্রদূতের এ প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়েছিল এবং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য স্কটল্যাণ্ড ও প্যারিসের ইহুদী ফ্রী ম্যাসনিক সংঘগুলো গুপ্তভাবে নিষ্ঠার সাথে কাজ শুরু করে দিয়েছিল। তারা মুসলমানদের প্রবঞ্চিত করবার জন্য এবং মাদ্রাসা ও স্কুলগুলো থেকে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক বিষয়ে দক্ষ, জ্ঞানী এবং বিদ্বান ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়া প্রতিরোধ করবার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলো। নতুন প্রজন্ম ও যুব সমাজকে ইসলামী জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা হলো, তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে অধার্মিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ের শিকারে পরিণত করা হলো। তাদের ইউরোপের মাটিতে এনে আমোদ-প্রমোদ ও ভোগ-বিলাসে লিপ্ত করা হলো। তাদেরকে মিথ্যা সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও লাইসেন্স দিয়ে বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবি সাজিয়ে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেশে প্রেরণ করা হলো। অত্যন্ত ধূর্ত অভিসন্ধী এবং লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে এ সকল অজ্ঞ ডিপ্লোমাধারী ও সংকীর্ণ চিন্তাধারী, অন্ধ, গোঁড়া নামধারী বিজ্ঞানীদের প্রশাসনের উচু পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মুস্তফা রসিদ পাশা, ফুয়াদ পাশা এবং এ ধরনের অন্যান্যরা মাদ্রাসাগুলো থেকে বিজ্ঞানের কোর্সসমূহ তুলে দিল, যেমন ফ্রি-ম্যাসন রশিদ পাশা সুলতান আব্দুল মজিদের রাজত্বকালে ব্রিটিশ এ্যাম্বেসিডারের সহায়তায় ১২৫৫ হিজরী ২৫ শে সাবান (১৮৩৯) এ কালো আইন তানজিমাত কানুন (জব-ড়ৎমধহরুধঃরড়হধষ খধ)ি প্রনয়ণ করে মাদ্রাসাগুলোতে সমকালীন বিজ্ঞান শিক্ষা নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত কিছু কিতাব সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করে। আলিম নামধারী অজ্ঞলোক তৈরীর প্রক্রিয়ায় একে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে মিথাত পাশা এবং তালাত পাশা ধর্মীয় বিষয়গুলো কাট-ছাট করে কমিয়ে দেয় এবং ধর্ম-শিক্ষাকে শুন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। বিশেষতঃ মিথাত পাশা দুরাচারী পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসলাম ও কুরআনের উপর যে আঘাত হানে তা ক্ষমার অযোগ্য। সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ খান যদি রুখে না দাঁড়াতেন তবে ক্ষতির কোন সীমা পরিসীমা থাকতো না। তুরষ্কের ইতিহাসে এর অনেক প্রমান বিদ্যমান আছে। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত ও বিপর্যস্ত করা হয়েছে। তাই ইতিহাস, সমাজ-বিজ্ঞান প্রভৃতি বই -এ সেন বংশ, পাল বংশ প্রভৃতি ইতিহাস থাকলেও আল্লাহ পাক-এর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আলোচনা অনস্তিত্বের শামীল। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পূর্জা পার্বন যেমন, শুভ দীপাবলী ও নানা সংক্রান্তির আলোচনা থাকলেও ঈদে মীলাদুন্ নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ফাতেহায়ে ইয়াজ দাহম, শবে মেরাজ লাইলাতুল রগাইব প্রভৃতির আলোচনা নেই বললেই চলে। অপর দিকে মাদ্রাসাগুলোতে যাও আলোচনা ছিল তা উলামায়ে ‘ছু’ গোষ্ঠী ইহুদীদের দোসর ওহাবী, খারেজী, লা-মাযহাবী, জামাতীদের পয়সার লোভে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আক্বীদার খিলাফ বদ আক্বীদা ও বদ মাযহাবের প্রচার-প্রসারে লিপ্ত হয়েছে। ফলতঃ বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের ঈমান। আর ইসলামের শত্রুরা জানে মুসলমানদের ঈমান হরণ না করতে পারলে ইসলাম ধ্বংস করা যাবে না।
তাই নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে, দু’জাহানের কামিয়াবী দান করতে হলে এবং ইসলামকে যমীনের বুকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে, চাই শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক সংশোধন ও সংস্কার। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আলোচনাকে কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত পর্যায়ে ব্যাপক বুলন্দ করে সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে হবে। বিশ্বকে নেতৃত্বদানে সক্ষম আলোকিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হক্কানী উলামা-ই-কিরাম তৈরী করার উদ্দেশ্যে ইল্মে মানকুলা, মাকুলা ও তাছাউফ সমৃদ্ধ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আক্বীদা ভিত্তিক আদর্শ মাদ্রাসাসমূহ স্থাপন করতে হবে এবং সাধারণ শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিরাজমান অপকর্ষ ধর্মহীনতা ও অন্যান্য অসঙ্গতিসমূহ দূর করে শিক্ষা ব্যবস্থার ইসলামী করনের মাধ্যমে প্রান্তিক দু’টি অবস্থার মধ্যে সামজস্য বিধানের সচেষ্ট প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে।
-আল্লামা সাইয়্যিদ মুহম্মদ মুনিস মুর্শিদ