দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা দিয়ে নামার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি দমনে কতটুকু সফল হয়েছে তা এখন রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। বিশেষ করে ইসলামের নামধারী দলগুলোর পাহাড়সম দুর্নীতি, দুর্নীতি দমন অভিযোগের আলোচনার কেন্দ্রে না আসায় এ প্রশ্ন সূচাঁলো আকার ধারণ করেছে।
এদিকে দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক দলগুলোতেও সংস্কার কার্যক্রমের কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার করছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আশ্চর্যজনকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে ইসলামের নামধারী দলগুলো।
বিশেষ করে ইসলামের নামধারী চিহ্নিত জামাতটি যেন আশ্চর্য রকমের সুবিধা লাভ করছে। অথচ অন্য সরকারে না হলেও বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অন্ততঃ রাজাকার, আল বাদর, রগকাটা, পাকাটা, জঙ্গি, মৌলবাদী তথা ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এটাই ছিল জনগণের গভীর প্রত্যাশা। বিশেষতঃ স্বাধীনতা বিরোধী আল বাদর প্রধান নিজামী-মুজাহিদগং গত দুর্নীতিবাজ সরকারের দৌরাত্মে স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রীত্বের সুবাদে গাড়ীতে ফ্লাগ উড়িয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর দৃশ্যে যারা মর্মবেদনায়, অর্ন্তযাতনায় ভুগতেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীকৃত ভূমিকার কারণে তাদের অবদমন তথা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে নিজেদের মর্মজ্বালার প্রশমনে প্রশান্তি লাভ করবেন সে আশায় উন্মুখ ছিলেন অনেকেই। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন সে আশায় গুড়ে বালি দিল।
শুধু দুর্নীতির বিষয় নয়, সংস্কার প্রশ্নেও নয় এমনকি বিধি-নিষেধের দিক থেকেও আল বাদর- জামাতীদের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আচরণ রীতিমত রহস্যজনক হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য, গত ১৬ই এপ্রিল নির্বাচন কমিশন, ধর্মীয় বিবেচনায় উট, মিনার শঙ্খ, বই, চরকা- এ ৬টি নির্বাচনী প্রতীক বাতিল করে।
কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে যে দাড়িপাল্লা ইনসাফ ও ইসলামের মূল প্রতীক বলে প্রনিধানযোগ্য যা তথাকথিত জমাতে ইসলাম ব্যবহার করে আসছে; তা রসহস্যজনক কারণে বাতিল করা হয়নি। অথচ দাড়িপাল্লা যে ইসলামেরই ইঙ্গিতবহ খাছ প্রতীক তা সাধারণেও অবগত।
অতি সাধারণ মুসলমানদের ঘরেও ‘সূরা রহমান খুব আদরণীয়। সহজ কথা ‘সূরা রহমান’ বহুল পরিচিত ও পঠিত এক সূরা। এ ‘সূরা রহমানের’ ৭-৮ আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক বলেন, “তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মীযান (দাড়িপাল্লাহ) যাতে তোমরা সীমালঙ্ঘন না করো মীযানে (দাড়িপাল্লায়)।
প্রদত্ত আয়াত শরীফে প্রথমে আকাশকে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে। সাধারণভাবে আকাশের মর্যাদা পৃথিবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্থানগত ও মর্যাদাগত উভয় শ্রেষ্ঠত্বই এখানে উল্লেখ্য। পৃথিবীকে আকাশের বিপরীত ধরা হয়।
সমগ্র কুরআন শরীফে এ বৈপরীত্য সহকারেই আকাশ ও পৃথিবীর আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াত শরীফে আকাশকে সমুন্নত করার পর মীযান স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, যা আকাশের বিপরীতে আসে না।
মূলতঃ বিশেষ হেকমতপূর্ণভাবে আকাশ ও পৃথিবী উভয়ের মাঝখানে তৃতীয় একটি বিষয় অর্থাৎ মীযান স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এর পেছনে হিকমত এই যে, মীযান স্থাপন এবং পরবর্তী তিন আয়াত শরীফে বর্নিত মীযানকে যথাযথ ব্যবহারের নির্দেশ। এতদূভয়ের সারমর্ম হচ্ছে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আত্মসাত ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা।
এখানে আকাশকে সমুন্নতকারণ ও পৃথিবী স্থাপনের মাঝখানে মীযানের কথা উল্লেখ করায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।
উলামায়ে মুহাক্কিক ও মুদাক্কিকগণ মীযান শব্দের তাফসীর করেছেন ইনসাফের দাড়িপাল্লা তথা ন্যায়বিচার। আর মীযানে প্রচলিত অর্থই হচ্ছে দাড়িপাল্লা।
প্রদত্ত আয়াত শরীফে দাড়িপাল্লা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ পাক দাড়িপাল্লা স্থাপন করেছেন। যাতে বান্দা ওজনে কম বেশী না করে এবং জুলূম অত্যাচারে লিপ্ত না হয়। বেঈমানী না করে বরং ইনসাফে প্রবৃত্ত হয়।
তাই দাড়িপাল্লা প্রতীক যে আসলে কুরআন-সুন্নাহয় বিবৃত মীযানের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় ও সংবেদনশীল করে তোলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাশাপাশি ইসলামের এ সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করেই বেনিফিসিয়ারী হওয়ার জন্যই তথাকথিত জামাতে ইসলামও যে দাড়িপাল্লা প্রতীক ব্যবহার করে আসছে তা না বললেও চলে।
জামাতীদের শ্লোগান- “আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই, দাড়িপাল্লায় ভোট চাই।” আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসনের সাথে দাড়িপাল্লা প্রতীক সম্পৃক্ত করার পেছনে উদ্দেশ্য মূলতঃ ঐ একটাই।
মীযান বা দাড়িপাল্লা যে ইনসাফের প্রতীক জামাতিরা সে অর্থেই এ প্রতীক ব্যবহার করে আসছে। এবং মীযান বা দাড়িপাল্লা গুঢ়মর্মের মতই ওরা ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে; ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে ওদের এ দাবী বহু পুরানো। কিন্তু ’৭১ এর হায়েনা, রাজাকার- জামাতিরা ওদের পুরানো অভ্যাসের মতই বার বার তা লঙ্ঘন তথা সত্য প্রমাণিত করেছে। বরং সব সময় ওদের উদাহরণ হয়েছে; গাছে না উঠতেই এক কাদির মত।
চারদলীয় জোট সরকারে ক্ষমতার অংশ পাওয়া মাত্রই ওদের লুটপাট, ধর্ষণ বহুগুণে বহুমাত্রায় বেড়েছিল। নীলফামারী ও সাতক্ষীরার জামাত এমপিই নয় খোদ নিজামীর মন্ত্রণালয় সম্পর্কেও অভিযোগের পাহাড় উঠেছে। শুধু শিল্পই নয়, হেন কোন খাত ও দিক নেই যাতে জামাতিদের কালো থাবা বিস্তার হয়নি।
সাবেক বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময়ে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জামাতের অবৈধ নিয়োগ ও সন্ত্রাস সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত সরকারের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো জামাত শিবিরের ক্যাডার-কর্মীরা। শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সময় তাদের কাছ থেকে ৫০ টাকার স্টাম্পে মুচালেকা নেয়া হতো এজন্য যে, তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর যেন অবশ্যই নামধারী জামাতে ইসলামীর কর্মকা-ের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখে।
এমনকি এ মুচালেকা নেয়ার সময় শিক্ষকদের পবিত্র কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথও করানো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া মুহম্মদ আশরাফুজ্জামান নামে এক শিক্ষক তার নিজের স্বীকারোক্তিতে একথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা থাকার পরও জামাত শিবিরকে মুচালেকা দিয়ে কেন তাকে নিয়োগ পেতে হলো, বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। এছাড়া গত ৫ বছর ধরেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জামাত শিবির যেভাবে কুক্ষিগত করে নিজেদের দলীয় লোকদের নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো, তার সবকিছুরই তদন্ত হয়ে বিচারের দাবী রাখে।
মূলতঃ জামাতিদের কর্মকা-েই প্রতিভাত করে যে, তারা ইহজগতেই দাড়িপাল্লার আদর্শহীন। সততা, ইনসাফ আর ইসলামের লেশমাত্র তাদের মধ্যে নেই। বরং তারা ইসলামের নামে প্রকাশ্য, বর্বর ও জঘন্য ধর্মব্যবসায়ী। ইসলাম এদের মুখোশ মাত্র। ইসনাফ তাদের মিথ্যা প্রচারণা। কাজেই ইনসাফের প্রতীক দাড়িপাল্লা তাদের জন্য আদৌ প্রয়োজন হতে পারে না।
বিশেষত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেখানে ধর্মীয় বিবেচনায় প্রতীক বাতিল করেছে সেক্ষেত্রে বলতে হয় যে, বর্তমানে প্রচলিত প্রতীকগুলোর মধ্যে দাড়িপাল্লার উর্ধ্বে ধর্মীয় চেতনা সম্বলিত আর কোন প্রতীক নেই। সুতরাং এ বিচারে জামাতী আল বাদরদের জন্য দাড়িপাল্লা মার্কা নিষিদ্ধকরণ না করার কোন কারণ নেই।
কিন্তু তারপরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনাবশ্যক ও অনাকাঙ্খিত বিলম্ব মূলতঃ তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণকেই প্রতিভাত ও প্রমাণিত করবে। ফলতঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অচিরেই আরো আস্থা হারাবে।
মূলতঃ এর দ্বারা একটি সত্য আরো জোরদারভাবে প্রতিভাত হয় যে, আসলে ইসলামের নামে রাজনৈতিক ফায়দালোভী জামাতী আল বাদরদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার পরিবর্তে বরং ইসলামের আলোকেই মুসলমানদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই কেবল ইসলামের নামধারী এসব ধর্মব্যবসায়ীদের সমূলে উৎপাটন করা যাবে। আল্লাহ পাক বলেন, সত্য এসেছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূরীভূত হওয়ারই যোগ্য।
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২