ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষাত এবং অনৈসলামিক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতার আসল রূপ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আর গণতন্ত্রের অবস্থান পাশাপাশি যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ-৪

সংখ্যা: ১৭৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তুরস্ক বহুল আলোচিত একটি নাম। আর তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ব্যাপক আলোচিত। ৭ লাখ ৮০ হাজার ৫৮০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটির মোট জনসংখ্যা এখন ৭ কোটি ১০ লাখের বেশি। জনসংখ্যার ৮০ ভাগ টার্কিশ এবং প্রায় ২০ ভাগ কুর্দিশ। ৯৯ ভাগ সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়। তুরষ্কের সামরিক বাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে নিজেদের দাবি করে। তাদের এ দাবি যথাযথ। তুরষ্কের সামরিক বাহিনী ১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫টি সরকারকে অপসারণ করেছে। ১৯৯৭ সাল এর সাম্প্রতিক সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। ১৯৯৭ সালে সামিরক বাহিনী প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন আরবাকানের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সে সময় সেনাবাহিনী রাস্তায় ট্যাংক নামিয়ে দিয়ে সরকারকে এই বার্তা পৌছে দিয়েছি যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে কোনো আপোস চলবে না। সেনাবাহিনী ১৯৬০ ও ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আরো তিন-তিনবার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। তুরষ্কের সংবিধানে জনজীবনে কঠোরভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। ১৯২৩ সালে দেশটির গোড়াপত্তনের পর থেকে এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর জোর দেয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামকে প্রতিহত করা। ধর্মনিরপেক্ষ তুরষ্কের জনক কামাল ছিলেন একজন বিভ্রান্ত সেনা কর্মকর্তা।  অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২৩ সালে তিনি প্রজাতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের গোড়াপত্তন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বর্তমান প্রজন্ম এবং সাধারণ শিক্ষিত প্রায় সকলেই তুরস্কের ‘কামাল আতাতুর্ককে’(?) তুরস্কের জাতীয় নেতা ও কর্ণধার বলে বিশেষ মূল্যায়ন করে। কিন্তু হাক্বীক্বত ইতিহাস কি বলে? ইসলামের আলোকে তার স্থান কোন স্তরে পর্যবসিত হয়? তা উপলব্ধির জন্য সে যে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কত নিষ্ঠুরভাবে ও নির্মমভাবে ইসলাম উঠিয়ে অনৈসলামকে জারি করেছিল নীচে তার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেয়া গেল- কামাল তার দেশের নারীদের পর্দা ত্যাগ করতে ও অভিশপ্ত বৈদেশিকদের গায়ে গা মিশিয়ে নৃত্য করতে বাধ্য করে। সে তার স্ত্রীকে খোলামুখে পুরুষের পোশাকে সর্বত্র ঘুরিয়ে বেড়াত।  ১৯২৪ সালে কামাল বৃত্তি ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত করে আলিমদের অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্থ করে। প্রথমে বিদ্যালয়ে কয়েক ঘন্টা কুরআন ও ধর্মশিক্ষাদানের ব্যবস্থা রাখে। ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দে এ নিয়মও উঠে গেল। মুসলমান রাখতে চাইলে এখন হতে পুত্র-কন্যাদেরকে ধর্ম শেখানোর ভার অভিভাবকদের ঘাড়ে পড়ল।  কামাল সরকারের মনে হলো, প্রত্যেক দরবেশই নতুন শাসনতন্ত্রের শত্রু। দরবেশদের আস্তানাগুলো ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ও কুসংস্কারের বিকাশ ক্ষেত্র, এ অজুহাতে বিপ্লবী আদালতের সুপারিশক্রমে ১৯২৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর মহাসভা করে সমস্ত তেক্কা (কবর) ও তুর্বা (খানকা) বন্ধ এবং দরবেশ প্রতিষ্ঠান তারা ভেঙ্গে দিল। শেখ, দরবেশ প্রভৃতি উপাধি  ও তাদের রীতিনীতি গ্রহণ, এমনকি তাদের বিশিষ্ট পোশাক পরিধানও দণ্ডনীয় বলে ঘোষিত হলো। মাদ্রাসার ওয়াকফের ন্যায় খানকা এবং কবর-দরগাহর সম্পত্তিও সাধারণ শিক্ষা খাতের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। খানকা ও তেক্কাগুলো বৈষয়িক বিদ্যালয়রূপে ব্যবহৃত হতে লাগল। ৭ই সেপ্টেম্বর আরেক আইনের দ্বারা উলামার সংখ্যা ভীষণভাবে হ্রাস করা হলো। এখন হতে কেবল ধর্ম বিভাগের সরকারী চাকুরেদেরই উলামার পাগড়ী ও পোষাক পরার অধিকার রইল। অপর কেউ  এটা পরিধান করলে ফৌজদারীতে সোপর্দ হবে বলে হুকুম জারি হলো।  মুসলমানী চান্দ্র বৎসর কামালবাদীদের নিকট অসুবিধাজনক মনে হলো। ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের  ২৬শে ডিসেম্বর তারা হিজরী সনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সময় ও পঞ্জিকা গ্রহণ করল। এর ফলে পাশ্চাত্যের সাথে পত্রাদি লিখার সুবিধা হলেও মুসলিম জগতের কিংবদন্তীর সাথে তুরস্কের একটি  দৃঢ়বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল।  মূর্তি নির্মাণ সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী; তথাপি ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা অক্টোবর ইস্তাম্বুলে কামালের মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। তুরস্কে এ দৃশ্য সর্বপ্রথম। পরের বৎসরের ৪ঠা নভেম্বর আঙ্কারার যাদুঘরের সম্মুখে আরও একটি মূর্তি স্থাপিত হলো। পারিবারিক আইনই ছিল ইসলামী আইনের সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ। নতুন দেওয়ানী আইন প্রর্বর্তিত হওয়ায়  তাও বাতিল হয়ে গেল। এটা ইসলামের ‘মরণ-আঘাত’  বলে বর্ণিত হয়েছে।  প্রকৃতপক্ষে এটা তদাপেক্ষাও গুরুতর। রাষ্ট্র্রকে সম্পূর্ণ বৈষয়িক করার পথে আর দু’টি মাত্র বাধা ছিল। ইসলাম তখনও রাজধর্ম বলে স্বীকৃত হত; একটি আলাদা ধর্মনৈতিক বিভাগেরও অস্তিত্ব ছিল। ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল শাসন বিধি হতে ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত কথাই বাদ দেয়া হলো । ফলে ইসলাম আর তুরস্কের রাজধর্ম রইল না। পূর্বে প্রতিনিধিরা আল্লাহ্ পাক-এর নামে হলফ নিতেন; এখন হতে নিতে আরম্ভ করলেন আত্মসম্মানের নামে। প্রত্যেক বালেগ পুরুষ ও বয়ঃপ্রাপ্তা নারী ইচ্ছানুযায়ী ধর্মান্তর গ্রহণের অধিকার পেল।  ৩রা অক্টোবর আরবীর  বদলে ল্যাটিন বর্ণমালা গৃহীত হওয়ায় মুসলিম জগতের সাথে তুরস্কের আর একটি  প্রধান বন্ধন টুটে গেল।  ১৯৩৪ সালের ২৬শে নভেম্বর আর একটি আইনে সমস্ত তুর্ক তাদের বে, আগা, পাশা, হানুম, এফেন্দি প্রভৃতি আরবী-ফারসী পদবী ও আহমদ, মুস্তফা প্রভৃতি আরবী নাম বাদ দিয়ে প্রাচীন তুর্ক নাম ও উপাধি গ্রহণে আদিষ্ট হলো।  প্রত্যেক তুর্ক পুরুষের পদবী হলো এখন হতে  ‘রায়’ ও বিবাহিতা-অবিবাহিত নির্বিশেষে প্রত্যেক মহিলার ‘বায়ান”। কামাল নিজে মুস্তফা নাম ও গাজী উপাধি ত্যাগ করে আতাতুর্ক (তুর্কদের জনক) ও ইসমত ইনোনু’ (ইনোনুর যুদ্ধ জয়ী) উপাধি গ্রহণ করলেন। ২৪শে নভেম্বর মহাসভার এক অধিবেশনে কামাল এই নতুন উপাধিতে ভূষিত হলেন।   ১৯৩৫ সালে  মসজিদের বাইরে ইমাম-মুফতীদের পাগড়ী ও জুব্বা পড়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল। শুধু ইমামতি করার সময়ই ধর্মীয় পোশাক পড়ার অনুমতি মিলল। প্রচলিত দেশীয় পোশাকের নিন্দা করে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হলো, ‘আমরা  হ্যাট মাথায় দিব; ইউরোপের ভ্রমণ পোশাক হতে আরম্ভ করে দরবারী পোষাক পর্যন্ত সমস্তই পরিধান করব। যে ইতস্তত করবে সে মূর্খ বলে অভিহিত হবে। কামাল যেখানেই গেল, সেখানেই হ্যাট তাঁর সঙ্গে চলল; সর্বত্রই এজন্য প্রবল প্রচার কার্য চলতে লাগল।  ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তুর্কীরা আরবদের মত পাগড়ী ব্যবহার করত। অথচ কামাল বলল, “তুরানী পোশাকের পুনরুজ্জীবিত করার দরকর নেই। সভ্য ও আন্তর্জাতিক পোশাক আমাদের জন্য উপযুক্ত পোশাক, তা পরিধান করব।  পায়ে জুতা, উপরে প্যান্ট, ওয়েস্ট কোট, শাট টাইকোট এবং সর্বোপরি এদের সাথে মিলিয়ে রৌদ্র প্রতিরোধক শিরস্ত্রাণ যার আসল নাম ‘হ্যাট’ তা হবে আমাদের জাতীয় পোশাক।” কামাল সর্বপ্রথম এরূপ পোশাক পরে এনেবালো ও কাষ্টমানোয় গমন করে। কামালের অনুকরণে প্রথমে সরকারী কর্মচারীরা ‘হ্যাট’ পরিধান করতে থাকে। গ্রামের জনসাধারণ ও গোঁড়াপন্থিগণ হ্যাট পরিধানকে ইসলাম বিরোধী মনে করলেও ১৯২৫ সালে ২৫শে নভেম্বর ফেজ ও পাগড়ীকে জাতীয় পোশাক হিসেবে বাতিল এবং হ্যাটসহ ইউরোপীয় পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক করে জনৈক কামালবাদী সংসদে একটি খসড়া আইন উপস্থাপন করলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়। অতঃপর ‘হ্যাট ল’ কঠোর হস্তে প্রয়োগ করা হয় এবং যারা এই আইন অমান্য করলো তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলো। যে হ্যাট পরল না, তাকে কারাগারে নিক্ষেপ বা ফাঁসি-গাছে লট্কানোর হুকুম দেয়া  হলো। কামালের ভয়াবহ যন্ত্র ‘বিপ্লবী আদালত’ প্রত্যহ শত শত লোককে  ধৃত,  কারারুদ্ধ বা প্রাণদ-ে দ-িত করতে লাগল। এর সাথে ইসলামী সালামও উঠে গেল। এর পরিবর্তে ‘সুপ্রভাত’, ‘বিদায়’ ও হ্যান্ডশেক রেওয়াজ প্রবর্তিত হলো। সরকারের আদেশে কুরআন শরীফ তুর্কীতে অনূদিত হলো, মসজিদে তুর্কী ভাষায় নামায পড়া এবং আযান দেয়ার প্রচলনও হলো। কামালের আমলে মক্তব-মাদ্রাসা লোপ ও ধর্ম শিক্ষা দান বন্ধ হওয়ায় তার কাঙ্খিত ইউরোপীয় শিক্ষা বিপ্লব সম্পূর্ণ হলো। একমাত্র ইস্তাম্বুলেই ৬০০ মসজিদ-বিদ্যালয় ছিল; আজ তার একটিরও অস্তিত্ব  নেই। অতএব, পাঠক! এখানেই বিবেচ্য বিষয় যে, মুসলমান নামধারী রাষ্ট্রপতিও কিভাবে ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি করতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রেক্ষিতে মুসলমানের যে কি অবস্থা হতে পারে ইসলামী দেশ যে কোন পর্যায়ে পৌছতে পারে তুরষ্ক তার প্রমাণ। পাশাপাশি মুসলমানদেশে, মুসলমান পরিচয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলমান সরকার প্রধান কি করে ইসলামের বিরোধীতা করতে পারে, মুসলমানকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে তুরস্কের কামাল বাহিনী তার নজীর।

-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান

ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২

কোকাকোলা ও অন্যান্য কোমল পানীয় সম্পর্কে উন্মোচিত সত্য-১৮

‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’- একটি সূক্ষ্ম ও গভীর ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া অথচ নিশ্চুপ তথাকথিত খতীব, মহিউদ্দীন, আমিনী ও শাইখুল হাদীছ গং তথা তাবত ধর্মব্যবসায়ীরা- (১)

মওদুদীর নীতি থেকেও যারা পথভ্রষ্ট সেই জামাত- জামাতীদের জন্যও ভয়ঙ্কর মুনাফিক॥ আর সাধারণের জন্য তো বলারই অপেক্ষা রাখেনা

প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২