গত কিছুদিন আগে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, বাংলাদেশ যদি ভারতের মতো সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হতে পারে তাহলে এদেশের গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে। ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও এখানে রয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, ভারতে গণতন্ত্র খুবই শক্তিশালী। কেননা সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অনুশীলন হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন বিভাজন বা বৈষম্য নেই। ভারতীয় হাই কমিশনার তার বক্তব্যে ভারতের অনুসরণে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত চর্চা চালিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এর ফলে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন বা বৈষম্য দূর করা সম্ভব। (দৈনিক আমাদের সময়, ১৯ মে/২০০৭, পৃষ্ঠা-১) ভারতীয় হাইকমিশনারের এ বক্তব্য ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে গভীর ওকালতিই কেবল নয় অথবা বাংলাদেশকে আরো ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য রীতিমত সবক প্রদানও নয় বরং ভারতের ইচ্ছানুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য ভারতের তরফ থেকে এক প্রকাশ্য হুমকি। মজার ব্যাপার হল, ভারতীয় হাইকমিশনার সাহেব কোন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় উপলক্ষ্যে বা কোন ধর্মনিরপেক্ষস্থানে দাঁড়িয়ে এ আস্ফালনটি করেননি; বরং চট্টগ্রামের সীতাকু- চন্দ্রনাথ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি একথা বলেন। তিনি মন্দিরটির নির্মাণ ও উন্নয়নে তার সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং সে স্থানটিকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বানও জানান। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও ভারতীয় হাইকমিশনার কিন্তু হিন্দু ধর্মের প্রসারেই কাজ করেছেন। সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন এবং হিন্দু স্বার্থের পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছেন। সীতাকু-ে মন্দিরের পাশাপাশি তিনি মসজিদ নির্মাণের কথা বলেননি বরং মন্দিরের নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ার লক্ষ্যে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বানই জানিয়েছেন। আলোচ্য এ উদাহরনের দ্বারাই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ প্রতিভাত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত দুই দশক ধরে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদই ভারতীয় জনগণের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক হিন্দুত্ববাদের প্রেরণা এসেছে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে সদ্য উদগত ফ্যাসিবাদের ধারণা থেকে। হিন্দুত্ববাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিএস মুলজে ওই সময় মুসোলিনির ইতালি সফর করেন। তিনি কেন কী উদ্দেশ্যে সুদূর প্রবাসে গিয়েছিলেন, তার সব তথ্য জানা না গেলেও তিনি ফ্যাসিবাদী ইত্যালি দর্শনে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সেবকসঙ্ঘ বা আরএসএস-এর শীর্ষ নেতা গুরু গোয়ালাকার হিটলারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং ফুয়েরারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। জার্মানদের বর্ণ ও জাতিগত বিশুদ্ধতায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন এবং তা ভারতের জন্য অনুকরণীয় ভাববেন। হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শগত সংগঠন আর এসএস এবং হিন্দু মহাসভার ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং সংগঠনটি ব্রিটিশদের কোলাবরেটর হিসেবেই অধিক পরিচিতি ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর গান্ধী হত্যার পরিকল্পক ও সংঘটক হিসেবে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনীতিতে এরা একটি প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায়। নানা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় সত্তরের দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রকাশ্যে উঠে আসে। ১৯৭৫ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরী অবস্থার আওতায় দমন নীতির শিকার ভারতের সব রাজনৈতিক সংগঠন- তা প্রচ- বাম বা দক্ষিণপন্থীই হোক- সবাই এই জোটে জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের সেক্যুলার রাজনীতির ধারক দাবীদার কংগ্রেসের এই টালমাটাল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে প্রখ্যাত সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের দেশব্যাপী প্রচারাভিযানের সময় তার সহযোগী হিসেবে হিন্দুত্ববাদীরা প্রথমবারের মতো স্বাধীন ভারতে রাজনীতির পুরোভাগে চলে আসে। বলাবাহুল্য, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসও প্রথমবারের মতো পরাজয় বরণ করে এবং মোরারাজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করে। বিজেপি’র পূর্বসূরি ডান সঙ্ঘের কয়েকজন নেতা দেশাই-এর মন্ত্রিসভার অন্তর্ভূক্ত হলে রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের আরেক ধাপ অগ্রগতি হয়। আশির দশকে নির্বাচনী রাজনীতিতে এলেও পার্লামেন্টে সদস্য সংখ্যার দিক দিয়ে বিজেপি’র তেমন কোন অর্জন না থাকলেও মতাদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদ শহরে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। অবশ্য এতে ম-ল আন্দোলন, যা বর্ণহিন্দুদের মতাদর্শরূপে হিন্দুত্ববাদকে খানিকটা প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তারও অবদান আছে। আরো অবদান আছে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের, যা শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ধ্বংসে গড়িয়েছিল। এর ফলে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যার মূল শিকার সংখ্যালঘু মুসলমানরা- তাও হিন্দুত্ববাদের ধারণা উস্কে দিয়েছিল। হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী বাজরং দল শিব সেনা এবং ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে এদের সমর্থকরা নির্বিচারে সংখ্যালঘু দমনে অংশ নেয়। কংগ্রেস শাসনামলের দীর্ঘ সময় ধরেও ভারতে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভিন্ন কারণে হলেও তাতে মতার্দশের কোন ছাপ ছিল না। ভারতে আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্কে একই ধারা অব্যাহত আছে এবং তাতে এখন হিন্দুত্ববাদ মতাদর্শের ছাপ লেগেছে। আসলে একটি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হিন্দুত্ববাদ প্রকল্পের মূল চালিকাশক্তি হলো- সহিংসতা। এই সহিংসতাই নিরবধি ইন্ধন যোগায় একটি ধারণার যে, ভারতের হিন্দুত্ববাদ বহিরাগত অর্থাৎ ভারতের ইতিহাসের আদিকাল যে শক-হুন দল, পাঠান মোগল এ দেশে শুধু আসেইনি, এ দেশকে নিজেদের আবাসভূমিতে পরিণত করেছে- তা হিন্দুত্ববাদের হুমকির মুখোমুখী। হিন্দুত্ববাদীদের কথিত বহিরাগতদের মধ্যে মূল হল মুসলমান। আশ্চর্য হলেও হিন্দুত্ববাদীদের ধারণায় হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বহুত্ববাদী, বহুজাতিক সংস্কৃতির ধারক এবং ধর্মনিরপেক্ষদের থেকেও কম নয়। তাই এদের সবার বিরুদ্ধে সহিংসতা আত্মসংরক্ষণের খাতিরে যথার্থ। নব্বইয়ের দশকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ তথা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তা হিন্দুত্ববাদী তৎপরতাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে একটি নিরলস প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া কালক্রমে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রূপ ধারণ করেছিল, যার বিশেষ প্রকাশ দেখা গিয়েছিল গুজরাটের মুসলমান নিধনযজ্ঞে। ২০০২ সালে যখন রাষ্ট্রীয় সব কর্তৃত্বকে একত্রিত করে সংখ্যালঘু গুজরাটি মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার উপক্রম হয়েছিল, সেটাই ছিল হিন্দুত্ববাদের বীভৎস রূপের একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ২০০৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদীদের ভারতে এক জাতি, এক সংস্কৃতি ও এক ধর্মের হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হলেও তা শঙ্কামুক্ত নয়। কারণ যেসব মনস্তাত্ত্বিক উপাদান হিন্দুত্ববাদকে লালন করে, তাও তো সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে অপসারিত হয়নি। হিন্দুত্ববাদের বিকৃত মতাদর্শকে যেসব উপাদান পুষ্টি যোগায় সেগুলো কিন্তু এত দিনে ভারতীয় রাজনীতির গভীরে প্রবেশ করেছে। সেদিক থেকে মাত্রায় হেরফের থাকলেও হিন্দুত্ববাদীদের গুজরাট এবং বামফ্রন্টের নন্দীগ্রাম এক পাল্লায়ই উঠে আসে। তাই হিন্দুত্ববাদের নির্বাচনী পরাজয় কোনো চূড়ান্ত পরাজয় নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপি’র বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতি যেখানে মায়াবতীর ব্রাহ্মণ দলিত মৈত্রীর মতো ঘটনা ঘটে অথবা কংগ্রেসের ভেতরেই প্রচ- অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে উত্তরাঞ্চলে বিজেপি’র কাছে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে, সেখানে যে কোন দলের একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদীদের সম্ভাব্য পুনরাভ্যুদয় কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়। তাই ভারতীয় হাইকমিশনার যখন ভারতে পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় আছে বলেন এবং বাংলাদেশকে সেরূপই হতে বলেন তখন একদিকে তিনি ভারতের হিন্দু আধিপত্য এবং মুসলিম অবদমনের অবস্থানটা গোপন রাখার পাশাপাশি এদেশেও ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দু আধিপত্য কায়েমের দুরভিসন্ধি এঁটেছেন। সেটাই সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। সঙ্গত কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার চিত্র অনুধাবনে এদেশীয় মুসলমানদের সচেতন হওয়ার বিষয়টি জোরদার হয়ে দাঁড়ায়।
-মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২