হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি মালিকী মাযহাবের ইমাম। তাঁর সীরাতগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রথম যেদিন ফতওয়ার মসনদে বসলেন মুফতী হিসেবে ফতওয়া দেয়ার জন্য সেদিনই তাঁর কাছে ৪০টি মাসয়ালা বা সুওয়াল আসলো। তিনি ১৮টার জাওয়াব দিলেন এবং বাকী ২২টির জাওয়াবে বললেন, আমি জানি না’ যখন জাওয়াব শেষ হয়ে গেলো এবং সুওয়ালকারীগণ চলে গেলো, তখন তাঁর নিকটবর্তী যে সকল বড় বড় আলিমগণ বসেছিলেন তাঁরা বললেন, “হে হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি কি সত্যিই ঐ ২২টি মাসয়ালার জাওয়াব জানেন না?” তখন হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “হ্যাঁ, আমার জানা আছে, তবে ১৮টি মাসয়ালায় আমার পূর্ণ তাহ্কীক আছে, তাই জাওয়াব দিয়েছি, আর বাকী ২২টি মাসয়ালায় পূর্ণ তাহ্কীক নেই, হতে পারে বর্তমানে ২২টি মাসয়ালা সম্বন্ধে আমার যে ফায়সালা আছে পূর্ণ তাহ্কীকের পরে তার ব্যতিক্রমও হতে পারে। এই লোকগুলো অনেক দূর থেকে প্রায় ৬ মাসের রাস্তা অতিক্রম করে আমার কাছে এসেছে মাসয়ালা জানার জন্য। এখন যদি আমি বিনা তাহ্কীকে তার জাওয়াব দিয়ে দেই যা পূর্ণ শুদ্ধ নয়, তবে তার ভিত্তিতে তারা আমল শুরু করবে, আর পরে যখন আমার পূর্ণ তাহ্কীক হবে এবং তা যদি বর্তমান ফায়সালার ব্যতিক্রম ফায়সালা হয়, তাহলে তাদেরকে কে এই ফয়সালার বিশুদ্ধ বা পূর্ণ তাহ্কীক সম্বলিত মতটি জানাবে? যেহেতু আমি তাদের বিস্তারিত পরিচয় বা ঠিকানা জানি না। আর এজন্য হয়ত আমাকে আল্লাহ্ পাক-এর কাছে জবাবদিহী করতে ও পাকড়াও হতে হবে। কেননা আল্লাহ্ পাক বলেছেন, ‘যদি তোমরা না জান, তাহলে যারা জানেন ও অভিজ্ঞ, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।”
পাঠক! মূলতঃ উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে কিরূপ তাক্বওয়া অবলম্বন করতেন তার নজীর আমরা এ ঘটনার দ্বারা পেলাম। আর তার বিপরীতে নামধারী আলিম তথা ধর্মব্যবসায়ী আলিমরা কিরূপ হীনপ্রবৃত্তির হতে পারে সেরূপ বর্তমান যামানার একজন নামধারী আলিমের (মাসিক মদীনা সম্পাদক মাহিউদ্দীনের) উদাহরণ যদি দেয়া হয় তবে দেখা যাবে যে, সে যে ন্যাক্কারজনকভাবে বিনা তাহ্ক্বীকে বক্তব্য দিচ্ছে শুধু তাই নয় বরং তার চরিত্র এতই জঘন্য যে, সে নিজের ফতওয়ার বিরুদ্ধে নিজেই লিখছে, একেকবার একেক ধরণের জবাব দিচ্ছে সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। এরূপ একটি সাক্ষাৎপ্রমাণ নিচে দেয়া গেলো। নামধারী আলিম তথা আলিমে ‘ছূ’ মাসিক মদীনা সম্পাদক তার পত্রিকা মাসিক মদীনা জুন/২০০২ ঈসায়ী সংখ্যার, ১১০, ১১১ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছে- মুহম্মদ আবূ জাফর সালেহ্ , লাকসাম, কুমিল্লা প্রশ্নঃ কোরআন এবং হাদীসের বিধান অনুযায়ী নারী নেতৃত্ব হারাম। অন্যান্য সংগঠনের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা নারীর সাথে একমত পোষণ করে রাষ্ট্রীয় কোন আইন পাশ করতে পারবেন কিনা? উত্তরঃ (১) “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম” এ ফতওয়া কে কোথায় কোন ভিত্তিতে দিলেন, তা আমাদের জানা নাই। (২) তা ছাড়া এমন একটা ঢালাও বক্তব্যের পিছনে দলীল কি, তাও জানবার সুযোগ আমাদের হয়নি। পারস্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে পরলোকগত বা নিহত সম্রাটের এক কন্যার অভিষেক হওয়ার সংবাদ হযরত নবী (সাঃ) কে শোনানোর পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, “সে জাতির কল্যাণ হতে পারে না যে জাতির নেতৃত্ব নারীর হাতে অর্পিত হয়।” এই হাদীসখানার পরিপ্রেক্ষিতে ফেকাহবিদগণ নারীনেতৃত্ব অনুত্তম সাব্যস্ত করেছেন। হারাম সাব্যস্ত করেন নাই। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ঈমানদার, সুস্থ মস্তিস্ক, সুবিবেচক ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন নয়, ফাছেক বা প্রমাণিত দুষ্কৃতকারীকে ইসলামী রাষ্ট্রের যে কোন ধরণেরই দায়িত্ব দেয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু এমন কথা কোথাও রয়েছে বলে আমার জানা নেই যে, কোন অবস্থাতেই কোন নারীকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সুতরাং ইসলামের নামে ঢালাও ফতোয়া বা মন্তব্য করা কি ঠিক হবে? (৩) অনেকে যুক্তি দেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলীফাকে নামাযে ইমামতি করতে হয়। জেহাদের নেতৃত্ব দিতে হয়। …… সুতরাং অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই এক কথায় হারাম সাব্যস্ত করে কোরাস গাইতে থাকা ঠিক কিনা তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
পাঠক আলোচ্য উত্তরের ১নং অংশে সে বলেছে, “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম’ এ ফতওয়া কে, কোথায়, কোন ভিত্তিতে দিলেন তা আমাদের জানা নেই।”
পাঠক! “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম” এ ফতওয়া কে কোথায় কোন ভিত্তিতে দিলেন, তার অন্য কোন জবাব না দিয়ে মাহিউদ্দীনের দেয়া উত্তরই আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরছিঃ মাসিক মদীনার সম্পাদক মাহিউদ্দীন তার মদীনা পত্রিকার জানুয়ারী/৮৯ ঈসায়ী সংখ্যার এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছে- মুহম্মদ আব্দুল হাই, তাড়াইল বাজার, কিশোরগঞ্জ প্রশ্নঃ কোন মহিলাকে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বানানো শরীয়ত-সম্মত কিনা? জানালে কৃতজ্ঞ হব। উত্তরঃ কোন মুসলিম শাসনকর্তা যদি ইসলামী অনুশাসন অনুসরণ করতে যান তবে তার সর্বপ্রথম কর্তব্য দাঁড়ায় স্বীয় ইমামতিতে নামায প্রতিষ্ঠা করা ও জেহাদের নেতৃত্ব দেওয়া। এ দু’টি ক্ষেত্রেই কিন্তু নারীর নেতৃত্ব চলেনা। একজন মহিলা যত বড় বিদূষী ও পূণ্যবতীই হোননা কেন, তাঁর পক্ষে নামাযের ইমামতি করার প্রশ্ন আসেনা। সে মতে কোন নারীর ইসলামী দেশের সর্বোচ্চ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ইসলমী শরীয়ত সমর্থিত নয়। এক হাদীসে রয়েছে আল্লাহ্ রসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, তোমাদের শাসকগণ যখন হবে কৃপণ আর শাসন ক্ষমতা গিয়ে পড়বে নারীদের হাতে তখন দুনিয়ার পৃষ্ঠদেশ অপেক্ষা অভ্যন্তরভাগই তোমাদের জন্য অধিক মঙ্গল জনক বলে বিবেচিত হবে।” হযরত রসূলে করীমের (সাঃ) সময়কালে পারস্য সম্রাট কিসরার এক কন্যাকে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। এ সংবাদ শুনে আল্লাহ্ রসূল (সাঃ) মন্তব্য করেছিলেন, “যে জাতি তাদের শাসনকর্তৃত্ব নারীদের হাতে তুলে দেয়, তাদের কখনও মঙ্গল হতে পারে না।
উপরোক্ত দু’টি হাদীসই সহীহ্ এবং হাদীসের প্রায় সব কয়টি বিখ্যাত কিতাবে রয়েছে।
অতএব, পাঠক! বলতে হয় যে, ‘ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম এ ফতওয়া কে কবে কোথায় কিসের ভিত্তিতে দিয়েছে’ এ বিষয়টি যদি মদীনা সম্পাদকের সত্যিই জানা না থাকত তবে তাকে নাজানার দলে আরবীতে যাকে বলা হয় ‘জাহিলের’ দলে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। কিন্তু তার নিজের লিখনীই যখন প্রমাণ করে যে, ‘ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম’ এ বিষয়টি তিনি শুধু জানেনই না বরং নিজে লিখে, নিজের মদীনা পত্রিকায় ছেপে প্রকাশ করেছেন; তখন শরীয়তী আদালত যদি তাকে শুধু কায্যাবই নয় বরং মুনাফিক বা মাহিউদ্দীন বলে সাব্যস্ত করে তখন আমাদের কি বলার থাকতে পারে? জুন/২০০২ ঈসায়ী এ মদীনা সম্পাদক বলেছে, (২) “তাছাড়া এমন একটি ঢালাও বক্তব্যের পিছনে দলীল কি তাও জানবার সুযোগ আমাদের হয়নি।এর প্রেক্ষিতে মদীনা সম্পাদক জানুয়ারী/৮৯ ঈসায়ীতে যে দু’টো হাদীছ শরীফ তুলে ধরেছে তা পুনঃউল্লেখ না করে তার উত্তরের শেষ লাইন, “উপরোক্ত দু’টো হাদীছ শরীফই ছহীহ্ এবং হাদীছ শরীফের প্রায় সব কয়টি বিখ্যাত কিতাবে রয়েছে।” এই বক্তব্যটি যথেষ্ট। ৩নং বক্তব্যে সে বলেছে, যে অনেকে যুক্তি দেন যে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলীফাকে নামাযে ইমামতি করতে হয়, জিহাদে নেতৃত্ব দিতে হয়। অর্থাৎ জুন/২০০২ এর বক্তব্য মুতাবেক এই যুক্তি ঠিক নয়। কিন্তু এই বক্তব্য ঠিক কিনা সে সম্পর্কে সেপ্টেম্বর/৯০ ঈসায়ী সালে মাহিউদ্দীন নিজেই লিখেছে, মাসিক মদীনা/সেপ্টম্বর ১৯৯০, মুহম্মদ আবদুশ শাকুর জামেয়া ইসলামিয়া রোড, পটিয়া, চট্টগ্রাম। প্রশ্নঃ কুরআন-হাদীস অনুযায়ী কোন মহিলা রাষ্ট্রনায়িকা হতে পারেন কিনা? উত্তরঃ রাষ্ট্রনায়ক যুদ্ধের সেনাপতি এবং মসজিদের ইমামের পদ ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ। মাসিক মদীনা/মার্চ, ১৯৯১, মুহম্মদ গোলাম মোস্তফা ভসানীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহী প্রশ্নঃ মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান কোন মহিলা হতে পারে কিনা? উত্তরঃ রাষ্ট্রটি যদি খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী পরিচালিত করতে হয় তবে কোন মহিলা সে রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেন না। কেননা খলীফা মুসলিম জনগণের ইমামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন।
পাঠক! এ লিখার প্রথমে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তাক্বওয়ার উদাহরণ দেয়া হয়েছিল। তার পাশাপাশি আজকে উনচল্লিশ বছরের ইসলামী পত্রিকার সম্পাদকের যে পরিচয় আমরা পেলাম তাতে ঐ হাদীছ শরীফেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রতিভাত হয়, “মিশকাত’ শরীফের হাদীছে যা উল্লেখ আছে, “সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আলিম এবং সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীব আলিম।” মূলতঃ উলামায়ে হক্বের উদাহরণের ক্ষেত্রে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে যদি বলতে হয়, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠদের একজন তবে তার পাশাপাশি একই প্রশ্নের উত্তর একেক বছর একেক রকমের দ্বারা, নিজের লিখার বিরুদ্ধে নিজের লিখার দ্বারা, নিজেই নিজের লিখার অস্বীকার করার দ্বারা মূলতঃ দু’পয়সার লোভ আর ক্ষমতাসীনদের কাছে আদরনীয় তথা বেনিফিসিয়ারী হওয়ার দ্বারা মাহিউদ্দীন নিজেকে হাদীছ শরীফের উল্লিখিত নিকৃষ্টজনদের অন্যতম সাব্যস্ত করতে হয়।
নারী নেতৃত্ব হারাম জানুয়ারী/৮৯ ঈসায়ী এ কথা বলে একবার নয় বার বার বলে (সেপ্টেম্বর/৯০, মার্চ/৯০, মার্চ/৯১) কিরূপ অবলীলাক্রমে সেই একই পত্রিকার মাহিউদ্দীন জুন/২০০২ ঈসায়ী এ নারী নেতৃত্ব জায়িয বলতে পারল।
মূলতঃ এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “কোন্ জিনিস আলেমের অন্তর হতে ইল্ম বের করে দেয়? বলা হয়েছে, লোভ। দুনিয়ার লোভ আলেমের অন্তর থেকে ইল্ম বের করে নেয়। মূলতঃ বর্তমান জোট সরকারের ক্ষমতার অংশিদারীত্ব, মহিলা নেতৃত্বের সুনজর কামনা তথা রাজ ক্ষমতার লোভ তার অন্তর থেকে যৎকিঞ্চিত ইল্ম যা ছিল তাও দূর করে দিয়েছে। সে এখন মিথ্যাবাদী দাজ্জালে পরিণত হয়েছে। যে সম্পর্কে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা তাদের কাছে যেয়োনা। তাদেরকেও তোমাদের কাছে আসতে দিওনা তবে তারা তোমাদের গোমরাহ্ করতে পারবেনা।
-খন্দকার মুহম্মদ সাখাওয়াত হুসাইন ইব্রাহীমপুর, ঢাকা।