-মুহম্মদ সাদী
হাদীছ শরীফ ও ফিক্বাহ শাস্ত্রের তৎকালীন বিশারদ হযরত আবু বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি একাদিক্রমে দশদিন সাইয়্যিদুত ত্বায়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে অবস্থান করলেন। লব্ধ অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে গভীর অনুসব্ধিৎসায় তিনি একান্ত কাছে থেকে সবকিছু প্রত্যক্ষ করলেন। সন্ধান পেতে চাইলেন এমন একজন হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর, যাঁর হাত মুবারকের নীচে আপন হাত রেখে বিনা দ্বিধায় বাইয়াত হওয়া যায় এবঙ আপন নফসের প্রতি বিরাগ হয়ে এতোদিনের অর্জিত অনুষ্ঠান সর্বস্ব ইলমে ফিক্বাহ-এর প্রজ্ঞাকে আল্লাহ পাক এবঙ নূরে মুজাসসাম, ছাহিবুল ইহসান, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করা সম্ভব হয়।
হযরত আবু বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি এতোদিন ধরে জানতেন, “কারামত”ই হলো একজন ওলীআল্লাহ-এর মর্যাদা ও মর্তবা নিরূপণের মানদণ্ড। এতোদিন তাঁর প্রত্যয় ছিলো, বাহ্যিকভাবে প্রতিভাত “কারামত”ই ওলীত্বের নির্যাস। তাঁ তখনো জানা হয়নি, যে ব্যক্তি তার প্রজ্ঞাকে নিজের লাগাম বানিয়ে না নেয়, সে প্রকৃত সম্মানী হয় না। যে ব্যক্তি তা’ করে, মানুষ তাকে ইমাম বানিয়ে নেয় এবঙ তাকে ইযযত করে। তখন পর্যন্ত এটাও তৎার জানা হয়নি যে, আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি হাছিলের অত্যাবশ্যকতায় দুনিয়া বিরাগী অন্তরে ইবাদত-বন্দেগীতেমনোযোগী হতে যে ইলম উৎসাহ যোগায়না, প্রকৃত প্রস্তাবে তা ইলম নয়্ আল্লাহ পাক-এর আদেশ এবঙ আকরামূল আউয়ালীন ওয়াল আখিরীন, রউফুর রহীম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশিত পথে ইস্তিক্বামাত (অবিচল) থাকাই যে প্রকৃত “কারামত” এবঙ এই কারামতই যে আল্লাহ পাক-এর মাহবুব ওলীগণের ভূষণ, তাও ভালো করে এতোকাল তাঁর জানা হয়নি।
তাই দশদিন সন্নিধানে থেকেও বোধগম্য কোন কারামত দেখতে না পেয়ে (সূক্ষ্ম কারামত উপলব্ধির অক্ষমতায়) হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তাঁর মনঃপুত হলো না। এমতক্ষেত্রে খানকা শরীফ থেকে বিদায় নেয়ার পূর্ব মুহুর্তে তিনি বললেনঃ “আমি আমার গন্তব্যে ফিরে যেতে চাই। আপনার অনুমতি চাইছি হুযূর।” আলোচনায় জানা গেলো, তাঁর নাম হযরত আবু বকর শিবল রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বিশ্বখ্যাত আলিম। স্বনামধন্য চারশত উস্তাদের কাছে তিনি চল্লিশ হাজার হাদীছ শরীফ আত্মস্থ করেছেন এবঙ ইলমে কালাম ও ইলমে ফিক্বাহ শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছেন। দশদিনের নিরবিচ্ছিন্ন অনুসন্ধানে হযরত জুনাইদ বাদদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কোন কারামত তিনিদেখতে পাননি। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায়, অর্থাৎ বাইয়াত হওয়ার জন্য তাকেঁ অনুপযুক্ত মনে করে হযরত আবু বকর শিবলি রহমতুল্লাহি আলাইহি আপন নবাসে ফিরে যেতে মনঃস্থির করেছেন।
এসব জেনে ও শুনে সাইয়্যিদুত ত্বায়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি জানতে চাইলেনঃ “হে আবু বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনিতো বিশ্ববিখ্যাত আলিম। চল্লিশ হাজার হাদীছ শরীফ আত্মস্থকারী একজন বিদগ্ধ মানুষ আপনি। দশদিন আমার খানকা শরীফে থেকে আপনি আমাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই দশদিনে ইবাদত-বন্দেগী, খাওয়া-দাওয়া, কথা-বার্তা, উঠা-বসা, আচার-আচরণ, অর্থাৎ সার্বিক বিষয়ে আমার কোন কোন আমল কী আপনি দেখেছেন, যা’ সুন্নতের খিলাফ?” হযরত আবু বকর শিবলী সবনয়ে জবাব দিলেনঃ “হে আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি! দশদিনে সুন্নতের পরিপন্থী কোন আমলই আমি দেখিনি। আমি প্রত্যক্ষ করেছি যে, আপনার মুবারক জীবনাচরণের সকল আমলই সুন্নতের সং্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এবঙ পূঙ্খানুপূঙ্খরূপে সং্গতিপূর্ণ।
অতঃপর হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেনঃ “হে আবু বকর শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি! মহান আল্লাহ পাক এর অপার রহমত এবঙ রহমতুল্লিল আলামীন, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সদয় ইহসানে ইলম, আমল, আখলাক্ব, আক্বীদাসহ আমার সব কাজে অনুক্ষণ আমি সুন্নত অনুসরণ করে থাকি। এমন কোন কাজ ও আমলই আমি করিনা, যা’ সুন্নতের খিলাফ। সুন্নত পালনের মুহব্বত পূর্ণ এই অভ্যস্ততাই আমার কারামত। জীবনের সকল কাজে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, রহমাতুল উম্মাহ, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ ও অনুকরণের যোগ্যতায় একজন ওলী আল্লাহ-এর মাধ্যমে অবিরাম যে সূক্ষ্ম কারামত প্রকাশ পায়, তা সূক্ষ্মদর্শী মানুষ ছাড়া অন্যদের কাছে দুর্বোধ্যই থেকে যায়। এ দুর্বোধ্যতা এমন স্তরের, তাছাউফ বিহীন প্রগাঢ় ইলম চর্চায়ও যা’ কখনো উপলব্ধিতে আসে না, এমনকি আপনারও না। যে কারণে আপনি আবার হিদায়েত শূন্য তিমিরে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছেন।” (চলবে)