সাইফুল্লাহ মুনীরের মাথা ঝিমঝিম করিতেছে। দেহ টলমল করিতেছে। চোখের সামনে যেন দুনিয়া উল্টাইয়া যাইতেছে। ষাট বৎসরের জীবনে এমন গোলক ধাঁধায় সে আর কখনো পড়িয়াছে বলিয়া মনে হইতেছেনা। অনন্তর কি এক আবেশে ষাট বছরের জীবন কাহিনীর পৃষ্ঠা উল্টাইতেই তাহার দৃষ্টি এক জায়গায় গিয়া থমকাইয়া পড়িলো। চল্লিশ বছর আগের সেই ঘটনা যেন এখনও জ্বলজ্বল করিতেছে। দরিদ্র মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ার পরও মায়ের মুখ সে কমই মলিন দেখিয়াছে। নিয়তিকে মানিয়া আল্লাহ পাক-এর শোকর-গুযার করিয়া, মা তাহার সদা-সর্বদা হাসিমুখেই দিন কাটাইতো। কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যায় হাট হইতে ফিরিয়া সে দেখিলো ঘরে বাতি জ্বলে নাই। বৃদ্ধা মা তাহার চৌকির পা ধরিয়া ফুঁপাইয়া, ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। বহু কষ্টে তাহার অশ্রু সংবরণে সাহায্য করিয়া ঘটনার বিবরণ যাহা সে জানিয়েছিলো তাহা এই যে, ‘তাহাদের ভিটাবাড়ি ও পুকুরের সীমানায় তাহার পর্দানশীল মা পর্দার জন্য যে বেড়া দিয়েছিলো তাহার ফোঁকর দিয়া, তাহাদের একমাত্র বাছুরটি পিছলাইয়া আস্তে আস্তে পানিতে তলাইয়া গিয়াছে। পর্দানশীন মা জননী শুধু বেড়ার ভেতরে থাকিয়া এই দৃশ্য দেখিয়াছিই বটে; কিন্তু বেড়ার ওপারে গেলে পর্দার খেলাফ হইতে পারে এই আশঙ্কা বোধ তাহাকে তড়িঘড়ি করিয়া, ছুটিয়া গিয়া বাছুরটির পেছনের এক পা বা দুই পা টানিয়া ধরিয়া উহাকে রক্ষা করা হইতে নিবৃত্ত রাখিয়াছে। এই দিকে দরিদ্র সংসারে এই বাছুরটি তাহার বিশেষ সম্বল হিসাবে যতটা না দামী ছিল তাহার চাইতে শিশুবস্থা হইতে উহাকে লালিয়া-পালিয়া বড় করিবার নিমিত্তে উহার প্রতি অন্তরের মুহব্বত ততোধিক বেশী ছিলো। ইহার সাক্ষাৎ মৃত্যু যেন তাহার কাছে পুত্র শোকের মতই বাজিয়াছিলো। কিন্তু তাহার পরও এই পুত্রসম মুহব্বতও আল্লাহ পাক-এর মুহব্বতের কাছে পরাজয় স্বীকার করিয়াছিলো। দরিদ্র জীবনের এই বিশেষ অবলম্বনটিও, পর্দা সম্পর্কে আল্লাহ পাক-এর আদেশ বাণীর কাছে তুচ্ছ হইয়াছিলো। ছোটকালেই স্থানীয় মসজিদের ইমাম ছাহেবের নিকট তাহার মতো ওয়াজ শুনিয়াছিলো যে, ‘একবার হযরত উম্মে সালমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও হযরত মায়মুনা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। এমন সময় এক অন্ধ ছাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হইলেন। হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মু’মিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুন্নাদ্বয়কে বললেন, ‘আপনারা ইবনে উম্মে মাকতুম হইতে পর্দা করুন।’ হযরত উম্মে সালমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তিনি কি অন্ধ নন? তিনি তো আমাদের দেখিতে পাচ্ছেন না।’ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আপনারা দু’জনে তো অন্ধ নন। আপনারা তো দু’জনে দেখতে পান।” (আহমদ, তিরমিযী) হতবিহ্বল চিত্তে সাইফুল্লাহ মুনীরের আজ মনে পড়িতেছে যে, তাহার মা এই হাদীছ শরীফ দ্বারা খুই উজ্জীবিত হইয়াছিলেন। সারাজীবন এই হাদীছ শরীফের আমল অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাহাকে দেখা তো দূরের কথা তিনিও যাহাতে কোন পুরুষ লোককে না দেখেন সেই জন্যেই তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। আর সেই তাক্বওয়া বোধের কারণেই বাছুর হারাইলেও পর্দার খেলাফ করিতে তিনি মনের ভেতর সায় পান নাই। যদিও বাছুরটির প্রতি পুত্রসম মুহব্বতের কারণে তিনি ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়াছিলেন।’ সেই দিনের সেই কাহিনী স্মরণ করিয়াই আজ সাইফুল্লাহ মুনীরের সামনে যেন আসমান-যমীন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। কারণ কিছুক্ষণ পূর্বে তাহার নাতি তাহাকে মাসিক আল বাইয়্যিনাতের ১৩৩তম সংখ্যা হইতে একটি মতামত পড়িয়া শুনাইল, যাহাতে বায়তুল মোকারম মসজিদের খতীব ও তথাকথিত ইসলামী পত্রিকার সম্পাদক মাহিউদ্দীন উভয়ে মঞ্চে ময়দানে মহিলা কুস্তির অনুমোদন দিয়াছে বলিয়া সমালোচনা করা হইয়াছে। চল্লিশ বছর পূর্বে স্বল্প শিক্ষিত মায়ের আমল আর চল্লিশ বছর পর বর্তমানের খতীব-মাহিউদ্দীন গং-এর মহা বিপরীত ফতওয়া এই দুইয়ের প্রতিক্রিয়ায় পৌঢ় সাইফুল্লাহ মুনীরের মাথা ক্রমশঃ বিগড়াইয়া উঠিতেছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগিয়া তাহার মাথায় তালগোল পাকাইয়া যাইতেছে। তাহার মা যেখানে অর্ধ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত হইয়া কুরআন শরীফের গুটি কতক আয়াত শরীফ ও সামান্য দু’চারখানা হাদীছ শরীফের শিক্ষা লইয়া সারাজীবন এমন পর্দা করিলেন যে, বোরখা পড়িবার পরও যেন তাহার অবয়ব না বোঝা যায় সেইজন্য দিনের বেলা বাহির না হইয়া রাতে বাহির হইতেন। এবং এইরূপ পর্দার জন্য নিজের জীবন সম্পদ ও বিসর্জন দিতে কুণ্ঠা করিতেন না। সেখানে খতীব-মাহিউদ্দীন গং কি করিয়া নাউযুবিল্লাহ্, নাউযুবিল্লাহ শুধু বেপর্দা হওয়াই নয় বরং মঞ্চে-ময়দানে এক মহিলার সাথে আরেক মহিলার কুস্তির জন্য অনুমতি দিলেন? গ্রামের ছেলে হওয়ায় সাইফুল্লাহ মুনীরের জীবনে বহু কুস্তি দেখার সুযোগ হইয়াছে। ঠিক সেই একই কায়দায় এক মহিলা আরেক মহিলাকে ফ্লাইং কিক দিয়া ফালাইবে, বিচিত্র কায়দায় মারামারি করিবে, জড়াজড়ি করিবে আর তাহা অবলোকন করিবে রাজ্যের সব মানুষ; আর তাহাও খতীব-মাহিউদ্দীন গং জায়িয বলিয়া অনুমতি দিতে পারিলো। (নাউযুবিল্লাহ) খতীব-মাহিদ্দীন গংয়ের এই ফতওয়ায় সাইফুল্লাহ মুনীর সত্যিই চোখে সর্ষের ফুল দেখিতে লাগিলো। তাহার বুকের ভেতরটায় কেমন যেন হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলো, দম বন্ধ হইয়া যাইতে চাহিলো, কেমন হাস-ফাঁস করিতে লাগিলো। খতীব-মাহিউদ্দীন গংকে সে এতদিন প্রকা- মাওলানা বলিয়াই জানিত। কিন্তু আজ বিবেকের প্রশ্নবানে জর্জরিত হইতে লাগিলো যে, ইহারা কেমনতরো মাওলানা-খতীব হইলো? কোন যামানা নাযিল হইলো যে, মাওলানা-খতীব ফতওয়া দেয়, মহিলা কুস্তি জায়িয। সাইফুল্লাহ মুনীরের গা আরো একবার শিরশির করিয়া উঠিলো। এই সব মাওলানা-খতীব গং কি তাহা হইলে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ উল্টাইয়া দিতে চায়? তাহারা নিজেরাই আজ নতুন কুরআন-সুন্নাহ রচনা করিতে চায়? আল্লাহ পাক-এর কুরআন শরীফ, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ অস্বীকার করিয়া, বিকৃত করিয়া, অবমাননা করিয়া, মনগড়া ফতওয়া দিয়া তাহারা নিজেরাই আজ নতুন নবী সাজিতে চায়? এতসব প্রশ্নের ভারে সাইফুল্লাহ মুনীর ভাবলেশহীন হইয়া পড়িলো। জীবনের পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে সে কেবলি কুক্তিত হইতে লাগিলো। ইহাও কি সম্ভব? খতীব-মাওলানার কক্তে খোদ কুরআন-সুন্নাহ্র চরম বিরোধী কথা এরূপ প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়া সম্ভব? এতসব তীর্যক প্রশ্নের আঘাতের পর আঘাতে হঠাৎ সম্বিত ফিরিয়া পাইলো সে। তাহার হৃদয় পটে কে যেন জানান দিলো- হ্যাঁ, সম্ভবই তো বটে। যেহেতু এটা আখিরী যামানা। আর এই যামানা সম্পর্কে হাদীছ শরীফেই ব্যক্ত হইয়াছে, ‘আখিরী যামানায় এমন কিছু মিথ্যাবাদী লোক বাহির হইবে তাহারা এমন সব কথা বলিবে যাহা তোমরা শোননি তোমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী শোনেনি। ইহারা দাজ্জালের চেলা। তোমরা ইহাদের কাছে যাইওনা। তাহাদেরকে তোমাদের কাছে আসতে দিওনা। তবে তাহারা তোমাদের গোমরাহ করিতে পারিবে না।’ সাইফুল্লাহ মুনীরের দ্বিধান্বিত মন এবার সচকিত হইয়া উঠিলো। হ্যাঁ, মহিলা কুস্তি জায়িয, বেপর্দা হওয়া জায়িয এই রকম কথা তার বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী কেহই নাই। সুতরাং খতীব-মাহিউদ্দীন ছূরতে এরা কাজ্জাব তাহা যথার্থই সত্য বটে। আর ইহাদেরকে পরহেয করা এখন আওয়ামুন্ নাছের জন্য জরুরী কর্তব্য বটে। সাইফুল্লাহ মুনীরের ভেতর হইতে এক দীর্ঘশ্বাস বাহির হইলো। অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে কামনা করিলো, মহান আল্লাহ পাক যেন সবাইকে সেই তৌফিকই দান করেন। (আমীন, ছুম্মা আমীন)
-মুহম্মদ ওয়ালীর্উ রহমান, ঢাকা।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি তোলা, রাখা, আঁকা, দেখা হারাম’ মুজাদ্দিদে আ’যমের অনবদ্য তাজদীদ