আবুল বাশার মুহম্মদ রুহুল হাসান
(বর্তমান সংখ্যার আলোচনাঃ সবসময় বাংলাদেশের ১ দিন বা ২ দিন পূর্বে সৌদি আরবের ঈদ, রমাদ্বান পালন কখনই শরীয়ত সম্মত হতে পারে না।)
আমরা লক্ষ্য করে আসছি সৌদি আরব আমাদের দেশের কখনও একদিন পূর্বে কখনও দু’দিন পূর্বে আরবী মাস শুরু করছে এবং সে অনুযায়ী একদিন বা দু’দিন পূর্বেই তারা ঈদ পালন করছে, রমাদ্বান শুরু করছে। স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়টি কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে-
(১) সৌদি আরব কি প্রতিমাসেই আমাদের দেশে চাঁদ দেখা যাবার পূর্বেই চাঁদ দেখে থাকে?
(২) সৌদি আরবকে পৃথিবীতে প্রথম চাঁদ দেখতে পাবার দেশ হিসেবে বিবেচনা করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য।
(৩) অমাবস্যার কারণে যেদিন সৌদি আরবে চাঁদ দেখা যায়না সে দিন থেকেই চন্দ্রমাস শুরু করাটা কি শরীয়ত সম্মত? অর্থাৎ Newrnoon (নিউমুন) তারিখ কি চন্দ্রমাসের প্রথম তারিখ হতে পারে?
১নং প্রশ্নের ব্যাখ্যাঃ আমরা জানি যে সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবী একটি উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে। এ ছাড়াও পৃথিবী নিজস্ব অক্ষে ২৪ ঘন্টায় একবার প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সবসময় একই রকম থাকেনা। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ জুন মাসে সূর্যের দিকে এবং ডিসেম্বর মাসে সূর্যের বিপরীত দিকে হেলে থাকে। আবার চাঁদের ক্ষেত্রে দেখতে পাই, চাঁদ নিজস্ব কক্ষপথে পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘুরছে। চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় ফলে চাঁদের আলোকিত অংশ পৃথিবী থেকে যতটুকু দেখা যাবে সেটা নির্ভর করে পৃথিবীর চারপার্শ্বে চাঁদ তার কক্ষপথের কোথায় অবস্থান করছে। পৃথিবী ও চাঁদের এই গতির কারণে এবং বিভিন্ন অবস্থানের কারণে চাঁদ যে কোন স্থান থেকে এবং পশ্চিমে অধিবৃত্ত আকারে বিস্তৃত হতে পারে। মার্চে সুদুর উত্তরে যেমন আলাস্কার দক্ষিণে মঙ্গোলিয়া নোভোস্কটিয়ায় চাঁদ দেখা যেতে পারে এবং আগষ্টের মধ্যে তা সরে গিয়ে সুদুর দক্ষিণে মাদাগাছকার, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি স্থানে দেখা যেতে পারে।
আমরা যদি ১৪২৭ হিজরীর শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার বিষয়টি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব অমাবস্যা সংঘটিত হয়েছে অক্টোবরের ২২ তারিখে ৫:১৫ আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী এবং চাঁদ প্রথমে দৃশ্যমান হয়েছে পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলোতে। পরবর্তীতে অক্টোবরের ২৩ তারিখে এই চাঁদ দৃশ্যমান হয়েছে সাউথ আমেরিকা, সেন্ট্রাল আমেরিকাতে।
বাংলাদেশে ২৩শে অক্টোবর দেখা যাওয়ার আকৃতিতে আসেনি। ফলে পরের দিন ২৪ তারিখে চাঁদ দৃশ্যমান হয়েছে বাংলাদেশ, নর্থ এশিয়া এবং ইউরোপে।
উপরের আলোচনায় আমরা এটা বুঝতে পারলাম কখনই একটি দেশ থেকে সবসময় প্রথমে চাঁদ দেখা যাবে না, এবং সম্ভব নয়। ফলে প্রতিমাসেই সৌদি আরব আমাদের দেশ বাংলাদেশের পূর্বে চাঁদ দেখার যে খবর প্রচার করে তা সত্য নয়। প্রতিমাসেই আমাদের দেশের পূর্বে সৌদি আরবের চাঁদ দেখতে পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে কেন সৌদি আরব সবসময়ই আমাদের দেশের পূর্বে আরবী মাস শুরু করে তার ব্যাখ্যা পরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে।
২ নং প্রশ্নের ব্যাখ্যা: অনেকের ধারণা যেহেতু চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে আমরা দেখতে পাই এবং পাশ্চিমে অস্ত যায় আর সৌদি আরব যেহেতু আমাদের পশ্চিমে ফলে সৌদি আরবেই প্রথমে চাঁদ দেখা যাবে। ব্যাপারটা আসলে হাস্যকর। কেননা সবদেশের পশ্চিমেই অন্য একটি দেশ আছে। যেমন সৌদি আরবের পশ্চিমে মরক্কো, মরক্কোর পশ্চিমে নর্থ আমেরিকা, নর্থ আমেরিকার পশ্চিমে পলেনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি। ফলে, আমাদের দেশের পশ্চিমে সৌদি আরব বলে সেখানে সব সময়ই হিলাল বা বাঁকা চাঁদ আমাদের দেশের আগে দেখা যাবেনা। কেননা আমাদের দেশের পূর্বের দেশগুলো যেমন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডেও আমাদের দেশের পূর্বে চাঁদ দেখা যায়।
এ ছাড়াও অনেকে মনে করেন যেহেতু কাবা শরীফ পৃথিবীর কেন্দ্র এবং কাবা শরীফ সৌদি আরবে অবস্থিত ফলে সৌদি আরবই প্রতি মাসে প্রথম চাঁদ দেখবে। আসলে কুরআন শরীফ এবং হাদীছ শরীফে কা’বা শরীফকে কেন্দ্র বলা হয়েছে বলে আমরা কাবা শরীফকে কেন্দ্র মনে করি। কিন্তু কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের কোথাও নেই চাঁদ মক্কা শরীফেই প্রথম দেখা যাবে। চাঁদ দৃশ্যমান হবার বিষয়টি পৃথিবীর মাঝখানের কোন দেশের সাথে সম্পৃক্ত নয়। তা পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকেই যে কোন মাসে প্রথমে দৃশ্যমান হতে পারে। ফলে সৌদি আরবকে পৃথিবীতে প্রথম চাঁদ দেখতে পাবার দেশ হিসেবে বিবেচনা করার কোন কারণ নেই এবং এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। বরং হাস্যকর ধারণা।
৩নং প্রশ্নের ব্যাখ্যা: যে মুহূর্তে চাঁদের আলোকিত অংশ সম্পূর্ণ সূর্যের দিকে এবং অন্ধকার অংশ সম্পূর্ণ পৃথিবীর দিকে থাকে সেই মুহূর্তটিকে অমাবস্যা বলে। ইংরেজীতে বলে Newmoon (নিউমুন)। Newmoon এর আভিধানিক অর্থ যদিও নতুন চাঁদ কিন্তু মূলত Newmoon দেখা যায় না। অমাবস্যার চাঁদ আমরা কখনও দেখি না, দেখা সম্ভব নয়। Newmoon বা অমাবস্যার পর পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখার মত অবস্থানে যেতে চাঁদের সময় লাগে প্রায় এক থেকে দেড়দিন।
১৯৭১ সালে NASA পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মাইলের উর্ধ্বে উঠে ছবি তুলে তাতে অমাবস্যায় কোন বাঁকা চাঁদের অস্তিত্ব পায়নি। সুতরাং Newmoon এর অবস্থানে অবস্থান করার সময় চাঁদ দেখার যে কোন দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা। কোন দেশ যদি Newmoon এর আভিধানিক অর্থ নতুন চাঁদ হিসেবে গ্রহণ করে নতুন মাস গণনা শুরু করে তাহলে সেটা শুদ্ধ হবে না।
এই গণনা অনুযায়ী যদি কেউ রোযা শুরু করে তবে যে দিন রোযার দিন নয় সেদিন ফরজ রোযা রাখছে এবং গণনা শেষে যে দিন রোযা রাখার দিন সেদিন ঈদ করবে যা হারাম এবং যদি হজ্জ করে তা সঠিক তারিখে আরাফাতে অবস্থান না করার ফলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
গত সংখ্যায় আমরা লিখেছিলাম চাঁদ দেখার দাবী অবশ্যই উপেক্ষা করা হবে যদি না প্রথম দেখার স্থানের পশ্চিমের কোন স্থান থেকে দেখার দাবী সমর্থিত না হয়। এর ব্যাখ্যায় বলতে হয়, যদি মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশে চাঁদ প্রথম দেখা যায় তবে তার ৮-১১ ঘন্টা পর অবশ্যই উত্তর আমেরিকাতে চাঁদ দেখা যাবার কথা। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে যখন সন্ধ্যা নেমেছে ক্রমান্বয়ে তার পশ্চিমের দেশগুলোতে সন্ধ্যা নামতে থাকবে এদিকে চাঁদের আকৃতিও খুব ধীরগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে সে দেশের পশ্চিমের দেশেগুলোও নিজ নিজ দেশের সন্ধ্যায় Crescent moon বা বাঁকা চাঁদ আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে বা সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেছে বলে ঘোষণা করা হলে তার ১০-১১ ঘণ্টা পরে আকাশ পরিস্কার থাকার পরও উত্তর আমেরিকাতে চাঁদ দেখা না গেলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে মধ্যপ্রাচ্য বা সৌদ আরবে চাঁদ দেখার যে দাবী করা হয়েছে তা মিথ্যা।
প্রমাণ হিসেবে বলতে হয়, সৌদি আরব ১৪২৭ হিজরী শাওয়াল মাসের চাঁদ যেদিন দেখেছে বলে দাবী করেছে তার প্রায় ১০-১১ ঘন্টা পর নর্থ আমেরিকার দক্ষিণে যখন সূর্য অস্ত গেছে তাঁর পূর্বেই সেদিনের চাঁদ অস্ত যায় এবং নর্থ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় সূর্য ডোবার মাত্র ৭ মিনিট পর চাঁদ অস্ত গেছে। তাহলে সেই চাঁদ কি করে ১০-১১ ঘন্টা পূর্বেই সৌদি আরব দেখলো সেটা আসলেই ভাববার বিষয়!
আশ্চর্য্যরে বিষয় যে, এ যাবৎ কাল ধরে সৌদি আরব তাই করছে। Newmoon অর্থাৎ অমাবস্যা সংঘটিত হবার দিনটিকে তারা চন্দ্রমাসের প্রথম তারিখ ঘোষণা করছে। আর যেহেতু হিলাল বা বাঁকা চাঁদ দেখা যায় অমাবস্যার ১ থেকে দেড় দিন পর এবং আমাদের দেশ চাঁদ দেখেই রোযা এবং ঈদ পালন করে ফলে প্রতি বৎসরই আমরা সৌদি আরবের ১ দিন কখনও ২ দিন পর রোযা শুরু করছি, ঈদ পালন করছি।
(Newmoon) দেখে নতুন চন্দ্রমাস শুরু করাটা শরীয়ত সম্মত নয় যেহেতু Newmoon বা অমাবস্যার দিন চাঁদ দেখা যায় না। সৌদি আরব ূণষবমমভ দেখে চন্দ্রমাসের তারিখ ঘোষণা করছে বলে তা শরীয়তের দলীল নয়। সৌদি আরবের চন্দ্রমাস শুরুর ভুল পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ মওজুদ আছে। যেহেতু মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ সৌদি আরবে আবস্থিত ফলে, পুরো বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সৌদি আরবের প্রতি রয়েছে গভীর মমতা। ফলে তাদের অনুসৃত পথগুলো মুসলমানগণ অনুসরণ করতে পছন্দ করে, সঠিক মনে করে। কিন্তু এই সুযোগে সৌদি আরব বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে। চাঁদ দেখা নিয়ে সমগ্র মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা মত। এ সকল মতের মধ্যে একটি ভ্রান্ত মত হচ্ছে সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ পালন করা। আগামী সংখ্যায় আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
চাঁদ দেখার রিপোর্ট
যিলক্বদ মাসঃ ১৪২৭ হিজরীর যিলক্বদ মাসে অমাবস্যা (Newmoon) সংঘটিত হবে ২০শে নভেম্বর ২০০৬, রাত ১০:১৮ ঘণ্টায় (আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী)
২১শে নভেম্বর চাঁদ প্রথম দেখা যেতে পারে সাউথ আফ্রিকা, সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং সাউথ আমেরিকাতে। অথচ অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, নর্থ আমেরিকা, নর্থ আফ্রিকাতে ২১শে নভেম্বর চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাবনা নেই। সৌদি আরবও ২১শে নভেম্বর চাঁদ দেখতে পাবে না।
২২ তারিখে চাঁদ দেখা যেতে পারে জাপান, এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, নর্থ আফ্রিকা এবং নর্থ আমেরিকাতে।
বাংলাদেশে ১৪২৭ হিজরী যিলক্বদ মাসের চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাব্য সময় ও তারিখ-
২১শে নভেম্বর বাংলাদেশের আকাশে চাঁদের উচ্চতা থাকবে ৬.৭২ এলটিটিউড এবং চাঁদের বয়স থাকবে ১৪:৩৪ ঘন্টা এবং বাংলাদেশে সে দিন চাঁদ দেখা যাবে না।
বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যেতে পারে ২২ শে নভেম্বর যখন চাঁদের বয়স ১ দিন ১৩ ঘন্টা ১৩ মিনিট এবং সন্ধ্যা ৫:৩০ ঘন্টা থেকে চাঁদ দৃশ্যমান হওয়া শুরু হতে পারে।
যিলহজ্জ মাসঃ অমাবস্যা (Newmoon) সংঘটিত হবে ২০ শে ডিসেম্বর, দুপুর ২ টায় (আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী)। সুতরাং সেদিন পৃথিবীর কোন মহাদেশে চাঁদ দেখা যাবার আকৃতিতে আসবে না। তবে পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চাঁদ দেখা যাবার কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে।
২১ শে ডিসেম্বর চাঁদ দেখা যাবে অস্ট্রেলিয়া, সাউথ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাতে।
তবে জাপান, উত্তর এশিয়া ও ইউরোপে চাঁদ দেখা যাবে পরের দিন ২২ শে ডিসেম্বর।
বাংলাদেশে ১৪২৭ হিজরী যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাব্য সময় ও তারিখ-
২১ শে ডিসেম্বর বাংলাদেশে যখন সন্ধ্যা নামবে তখন চাঁদের বয়স ২১ ঘন্টা ৩৭ মিনিট (প্রায়)। কিন্তু চাঁদের উচ্চতা হবে ৪.৯ এলটিটিউড। এবং সূর্য অস্ত যাবার ৩৬ মিনিট পর চাঁদ অস্ত যাবে।
সুতরাং ২১ শে ডিসেম্বর চাঁদ দেখা যাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যাবে ২২ শে ডিসেম্বর এবং যিলহজ্জ মাসের ১ম তারিখ হবে ২৩ শে ডিসেম্বর। (চলবে)
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫