আবুল বাশার মুহম্মদ রুহুল হাসান
(বর্তমান সংখ্যার আলোচনাঃ ১৪২৭ হিজরীর পবিত্র রমাদ্বান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি এবং সমাধানের পথ)
১৪২৭ হিজরীর পবিত্র রমাদ্বান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে এবার সারা দেশে যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল তা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক। আর এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর মূল নায়ক দেশের তথাকথিত মাওলানা মুফতী কমিনী। তিনি দেশের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির মতামতকে উপেক্ষা করে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে উপহাস করে এবং তার পদত্যাগ চেয়ে, রাতে চাঁদ দেখার খবর পেয়ে সমগ্র দেশে ২৪ শে সেপ্টেম্বর থেকে পহেলা রমাদ্বান পালনের জন্য একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে প্ররোচিত করে। তার এই অদ্ভূত কর্মকাণ্ড একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সমাজে ইলম-প্রজ্ঞায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অজ্ঞ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি দল আছে “যারা নিজেরাই জানেনা তারা আসলে কি জানে না।” মুফতী কমিনী সেই সম্প্রদায়ের একজন। চাঁদ দেখা বিষয়ে তার কতুটুকু জ্ঞান থাকার প্রয়োজন সেই পরিমাপটুকু তার জানা নেই। চাঁদ দেখার উপর কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে যে অগাধ ইলম রয়েছে সে ব্যাপারে তার সম্যক জ্ঞানও নেই। এ বছরে রোযা পালনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ রমাদ্বানের ১ম তারিখ ঘোষণার ক্ষেত্রে সে যে উদ্ভট, কাল্পনিক, অবাস্তব আহ্বান করেছে সেটাই তার ইলমহীনতার যথার্থ প্রমাণ। আমরা আজকের আলোচনায় কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করবো। যে সকল বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে আমাদের দেশ তথা বিশ্বের অনেক দেশেই বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এক. যে কোন আরবী মাসের ২৯ তারিখ যে দিন চাঁদ প্রথম দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেদিন কোন অঞ্চলের দিগন্তরেখা মেঘমুক্ত বা পরিষ্কার থাকলেও চাঁদ দৃশ্যমান হবে না যদি চাঁদ দেখা যাওয়ার আকৃতিতে না আসে। অর্থাৎ চাঁদের উপযুক্ত বয়স না হয়।
দুই. সূর্য ডোবার পর সাধারণত পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে চাঁদ দেখা না গেলে সে চাঁদ সেদিন সেই দিগন্ত রেখায় আর দেখা যাবে না।
তিন. চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে সকল সাক্ষীর মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।
এক এর ব্যাখ্যাঃ চাঁদ যেহেতু পৃথিবীর চারপার্শ্বে একটি কক্ষপথে ঘুরে। তাই ধীরে ধীরে তার অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়। যে সময়ে চাঁদের আলোকিত অংশ সম্পূর্ণ সূর্যের দিকে এবং অন্ধকার অংশ সম্পূর্ণ পৃথিবীর দিকে থাকে সেই সময়টিকে অমাবস্যা বলে। সে সময় চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যের মাঝামাঝি অবস্থান করে। তখন চাঁদের বয়স শূণ্য ঘণ্টা, শূণ্য মিনিট। অমাবস্যা সংঘটিত হবার প্রায় ১ থেকে দেড়দিন পর বাঁকা চাঁদ বা হিলাল দেখা যায়। কিন্তু সেটা প্রথম কোন দেশে দেখা যাবে সেটা নির্দিষ্ট নয়। অমাবস্যার পর চাঁদের বয়স কত সেটা ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয় যেমন দিগন্তরেখার উপর চাঁদের উচ্চতা, চাঁদের পেছনে সূর্যের লালাভ আলো, সূর্য ডোবার কত সময় পর চাঁদ অস্ত যায় এ রকম আরও অনেক বিষয় যদি অনুকূলে থাকে তবে একটি স্থান থেকে চাঁদ দৃশ্যমান হবে।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানে এ সকল বিষয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। বর্তমানে চাঁদ দেখা বিষয়ক বিজ্ঞান এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে ক্যালকুলেশন করে আগাম ধারণা করা যায় পৃথিবীর কোথায় প্রথম নতুন মাসের নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হতে পারে। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ মাদ্রাসার পক্ষ থেকে, মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতায় পবিত্র রমাদ্বান মাসের যে ক্যালেণ্ডার প্রকাশিত হয়েছে তা রমাদ্বান মাসের প্রায় ১৫ দিন পূর্বেই সেই ক্যালেণ্ডারে ২৫শে সেপ্টেম্বরকেই ১ম রমাদ্বান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা গবেষণায় ধরা পড়েছিল, ২৩শে সেপ্টেম্বরে যখন বাংলাদেশের কোথাও সন্ধ্যা নামবে তখন চাঁদ দেখা যাওয়ার আকৃতিতে থাকবে না। অর্থাৎ চাঁদের বয়স ছাড়াও দিগন্তরেখার উপর চাঁদের উচ্চতা, চাঁদের পেছনের আলো, এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয় চাঁদ দেখার অনুকুলে থাকবে না ফলে চাঁদ দৃশ্যমান হবে পরের দিন ২৪শে সেপ্টেম্বর সূর্যাস্তের পর এবং রমাদ্বানের ১ম তারিখ হবে ২৫শে সেপ্টেম্বর। এতসব যুক্তি প্রমাণ হাতে থাকার পরও কেউ যদি দাবী করে আমাদের দেশে চাঁদ দেখা গেছে সেটা হবে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অমূলক উক্তি। তা হবে, যা যেখানে উপস্থিত নেই তা সেখানে উপস্থিত আছে বলে দাবী করা। এ ছাড়াও ২৩শে সেপ্টেম্বর ছিল প্রায় সমগ্র দেশের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে প্রায় দুই-তিন দিন টানা বৃষ্টি হয়েছে। এ রকম প্রতিকূল পরিবেশে চাঁদ দেখা যাওয়ার আকৃতিতে আসলেও বাস্তবে দেখা যাওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে হাদীছ শরীফে আছে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শা’বানের ৩০ দিন পূর্ণ করার পর রমাদ্বানের রোযা রাখতে। ২৩শে সেপ্টেম্বর জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি সমগ্র বাংলাদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যখন জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রচার করে যে দেশে চাঁদ দেখা যায়নি সে সময় সকল বিচার বিশ্লেষণ উপেক্ষা করে, হাদীছ শরীফের নীতি অমান্য করে কেউ যদি মনগড়া সিদ্ধান্ত দিয়ে বসে যে চাঁদ দেখা গেছে, তবে সে চরম পর্যায়ের জাহিল। মূলত সমাজে বিভ্রান্তি এবং ফিৎনা সৃষ্টিই তার মূল উদ্দেশ্য। এদের না আছে হাদীছ শরীফের জ্ঞান, না আছে চাঁদ দেখা বিষয়ক জ্ঞান।
দুই এর ব্যখ্যাঃ আমরা যদি কোন খোলা মাঠের দিকে তাকাই যেখানে আকাশটা যমিনের সঙ্গে মিলে আছে বলে মনে হয় তাকেই দিগন্ত বলে। দিগন্তরেখার কাছে যেখানে সূর্য অস্ত যায় সেখানে যদি আমরা বাঁকা চাঁদ দেখতে পারি তবে আমাদের জানালা থেকেই তা দেখতে পাব। (যদি সামনে কোন বাধা না থাকে)। কাউকে সু-উচ্চ দালানে কিংবা পাহাড়ে আরোহণের প্রয়োজন হয় না। হিলাল বা বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য ১৫-৩৫ মিনিট ধৈর্য্য ধরতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৫০ মিনিট এবং উচু অক্ষাংশের দেশসমূহে আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ২৯ দিনের চাঁদ থাকে দিগন্তরেখার খুব কাছে এবং ৩০ দিনের পুরনো চাঁদ হয় তুলনায় বড় এবং অবস্থান করে উঁচু আকাশে। বাঁকা চাঁদ যদি আমরা সন্ধ্যায় বা সূর্যাস্তের পর দেখতে পাই, প্রকৃতপক্ষে তা ঐ দিনই সূর্যোদয়ের কিছু সময় পর আকাশে উদয় হয় এবং সারাদিন সূর্যের সামান্য পূর্বদিকে অবস্থান করার কারণে সূর্য যখন অস্ত যায় তখন চাঁদের অস্ত যেতে কিছু সময় বাকী থাকে। এ সময়টা হচ্ছে প্রায় ৫০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে যদি বাঁকা চাঁদ দেখা যায় তবে সেটাই হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রথম চাঁদ বা চাঁদের গণনা হিসেবে প্রথম তারিখ। সুতরাং রাত ৯টার পর, কখনও রাত ১১টার পর দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেছে বলে যে খবর প্রচার করা হয়, তা একশত ভাগ মিথ্যা। কোন শিক্ষিত, সচেতন, ধার্মিক ব্যক্তি এ ধরনের প্রচারণা চালাতে পারে না। যারা প্রচার করে তারা হয় অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত অথবা মুনাফাভোগী এবং সজ্ঞানে সমাজে ফিৎনা সৃষ্টিকারী। আমরা যদি আরেকটু বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখতে পাই, সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার সাথে উত্তর পশ্চিমে অর্থাৎ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওয়ের সূর্য অস্ত যাবার সর্বোচ্চ সময়ের পার্থক্য + ৮ মিনিট এবং পূর্বে অর্থাৎ খগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটিতে – ৭ মিনিট। অর্থাৎ ঢাকায় সূর্য অস্ত যাবার সর্বোচ্চ ৭ মিনিট পূর্বে সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটিতে সূর্য অস্ত যায় এবং পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁয়ে সর্বোচ্চ ৮ মিনিট পর সূর্য অস্ত যায়। সুতরাং ঢাকায় চাঁদ দেখা কমিটি চাঁদ দেখার খবর প্রচারের জন্য সূর্যাস্তের পর সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসে অপেক্ষা করতে পারে। এর মধ্যে দেখা না গেলে সেদিন আর কোনভাবেই চাঁদ দেখা সম্ভব নয়। মোবাইলের যুগে এ তথ্য প্রাপ্তি সাথে সাথেই সম্ভব। অর্থাৎ চাঁদ দর্শনকারী দেখারত অবস্থাতেই চাঁদ দেখা কমিটিকে জানাতে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে সূর্য অস্ত যাবার পর ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পর চাঁদ দেখার খবর প্রচার করা সত্যি হাস্যকর।
তিন এর ব্যাখ্যাঃ প্রায়শতই একটি হাদীছ শরীফের উদ্ধৃতি দেয়া হয় যে, প্রত্যেক মুসলমানের সাক্ষ্য গহণযোগ্য। এখানে সাক্ষ্য দেবার প্রেক্ষাপট এবং মুসলমানের যোগ্যতা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তা ছাড়া যখন চাঁদ দেখার দাবীর এবং বাস্তব আস্থার সঙ্গে নিশ্চিত অসঙ্গতি ধরা পড়ে অর্থাৎ চাঁদটি যেখানে ছিলনা, সেখানে দেখেছে বলে সাক্ষী দাবী করছে, অথবা চাঁদটি সূর্যাস্তের পূর্বেই অস্তগিয়েছিল, কিংবা সূর্যাস্তের সময় আকাশের উজ্জলতার দরুন একই অঞ্চলের অসংখ্য মুসলমানের পক্ষে তা দেখতে পাওয়া সম্ভব হয়নি বা অন্য এলাকাতেও দেখা যায়নি, তখন সাক্ষী অবশ্যই বাতিলযোগ্য। অর্থাৎ, অমাবস্যার পর কোন দেশে যখন সন্ধ্যা হচ্ছে, সেই সময় যদি চাঁদ সেই দেশের উপর দেখা যাওয়ার আকৃতিতে না আসে তবে তা দেখা সম্ভব হবেনা। তখন সেই অঞ্চল থেকে চাঁদ দেখার দাবী করার অর্থ হচ্ছে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। আবার যদি কোন অঞ্চলের সারা এলাকা জুড়ে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন থাকে বা বৃষ্টি বাদলা থাকে সে অঞ্চলে নতুন চাঁদ দেখার দাবীটা একদিকে কতটা হাস্যকর অপরদিকে কতটা যুক্তিসঙ্গত তা ভাববার বিষয়। এ সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই চাঁদ দেখার দাবী উপেক্ষা করা হবে যদিনা প্রথম দেখার স্থানের পশ্চিমের কোনস্থান থেকে দেখার দাবী সমর্থিত না হয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং অনেক কাজী সাহেব অনেক সাক্ষীকে তাদের ত্রুটির জন্য বাতিল করেছেন। বর্তমানেও অনেক দেশের মুফতি অন্যদেশের ভুল সিদ্ধান্ত কে বাতিল করেছেন। তার ভাল উদাহরণ হচ্ছে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে শুক্রবার সৌদি আরবের বহু শহরের ঈদের চাঁদ দেখার দাবীকে উপেক্ষা করে (যেহেতু সেদিন সেখানে চাঁদ দেখা যায়নি) মিশর ৯ তারিখ রবিবার ঈদ পালন করে।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কোন অঞ্চলে চাঁদ দেখতে পাবার কোন প্রকার সম্ভাবনা না থাকলে হঠাৎ করেই একজন সাক্ষী দাড় করিয়ে দিয়ে, অথবা তার মিথ্যা সাক্ষ্য প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করে চাঁদ দেখার দাবীর সত্যতা কখনই প্রমাণ করা যাবে না। এ ধরনের কাজ করার চেষ্টা হচ্ছে নেহায়েত মুর্খতা, শঠতা এবং মু’মিনদের সঙ্গে বৈরিতা। অথচ ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে রমাদ্বানের চাঁদ নিয়ে হুবহু এই কাজটি করেছে তথাকথিত মুফতি কমিনী। আগামীতে এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে তাকে দূরে থাকার জন্য বলা হল। এ ধরনের অজ্ঞতাপূর্ণ কাজ শুধু সমাজে অশান্তিরই জন্ম দেয়, অনৈক্য আর বিভেদের সৃষ্টি করে।
হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন সৌদি আরবে রোযা শুরু করলে পরের দিন আমাদের দেশে শুরু হবে না কেন? এর উত্তর অনেক ব্যপক। আগামী সংখ্যাতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়াস চালাবো ইনশআল্লাহ।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫