রসূন কোয়া কোয়া। কিন্তু সব রসূনের গোড়া যেমন এক তেমনি দেওবন্দিরা কেউ পীর ছাহেব, কেউ তাবলীগি, কেউ মুফতী, কেউ শাইখুল হাদীছ ইত্যাদি নামে থাকলেও আসলে সবার গোড়া তথা মতাদর্শ একই। একথা তারাও স্বীকার করে থাকে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক তৎপরতায় কিছু ভিন্নতা আছে বলে তারা প্রচারও করে থাকে। তবে রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রেও একটি বিষয়ে, জোট সরকারের অংশীদার হওয়ার পূর্বেও তাদের ঐক্যমত্য ছিলো। তাহলো- ‘ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হারাম।’ তথাকথিত শাইখুল হাদীছ থেকে তথাকথিত মুফতী আমিনী সবাই একথা বলেছেন। এমনকি এখনও অনেক ক্ষেত্রে বলছেন। যদিও জোট সরকার প্রধানের কাছে গিয়ে তারা সেকথা বেমালুম চেপে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের লিখনী, পত্রিকা এমনকি কিতাবে এখনও সেকথা জ্বলজ্বল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, তথাকথিত শাইখুল হাদীছ আজিজুল হক্বের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত পত্রিকা রহমানি পয়গাম। উক্ত রহমানী পয়গাম পত্রিকায় গণতন্ত্রকে ইসলামের দৃষ্টিতে একটি হারাম, কুফরী ও শিরেকী মতবাদ আখ্যা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, তখন তথাকথিত শাইখুল হাদীছের শাইখী রুমালের মধ্যে আজকের কমিনী, মাহিউদ্দীন, ইজহার গং সবাই ছিলো। অর্থাৎ তার ফতওয়া তখন সবারই ফতওয়া। যা আজকে ফতওয়া কিতাবাকারে ‘ফাতাওয়ায়ে রাহমানীয়া’ নামক কিতাবে ছাপা হয়েছে। এখাতে তা উল্লেখ করা গেলোঃ প্রচলিত গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের বিধান জিজ্ঞাসা: গণতন্ত্র একটি কুফুরীতন্ত্র, একথা সর্বস্বীকৃত। সে মতে বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলি যাদের গণতন্ত্রের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই ভিত্তিতে তাদেরকে কাফির বলা যাবে কিনা? এবং সে সমস্ত দলগুলিকে ভোট দেয়া জায়িয হবে কিনা? যদি ভোট দেয় তাহলে গণতন্ত্রের সমর্থন করার কারণে তাদেরকে কাফির বলা যাবে কিনা? গণতন্ত্র যে কুফরী ঐ বিষয়ে কুরআন-হাদীছের আলোকে প্রমাণ জানতে ইচ্ছুক। জবাব: গণতন্ত্রের দু’টি দিক রয়েছে। (এক) গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা, (দুই) গণতান্ত্রিক কর্মসূচী। (এক) গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা: গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় জনগণকে ক্ষমতার মূল উৎস মনে করা হয়। সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে জনতার যে কোন সিদ্ধান্ত এ তন্ত্র মতে চূড়ান্ত ও অপরিহার্য। এক কথায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে (নাউযুবিল্লাহ) খোদায়ী ফয়সালার স্থান দেয়া হয়, যার কোন সিদ্ধান্তই অগ্রাহ্য করা যাবেনা। শরীয়তের দৃষ্টিতে এসব চিন্তাধারা সবই হলো কুফরী চিন্তাধারা। যে ব্যক্তি বুঝে শুনে এসবের প্রতি আস্থাশীল হয় তার ঈমান চলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য কেউ যদি গণতন্ত্রের এসব মূল মন্ত্র না জেনে অপরের দেখাদেখি গণতন্ত্রকে সমর্থন করে তাহলে সে কুফরী তন্ত্রের সমর্থনকারী হিসাবে মারাত্মক গুণাহ্গার হবে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মূল মন্ত্রগুলো কুফরী হওয়ার প্রমাণ হলো যে, এগুলো কুরআন-হাদীছের স্পষ্ট বর্ণনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। নিম্নে কয়েকটি আয়াত শরীফ উল্লেখ করা হলো। আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন,
ان القوة لله جميعا.
“নিশ্চয়ই সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই।” (সূরা বাক্বারা-১৬৫) অন্যত্র ইরশাদ ফরমান,
ان الحكم الا لله.
“আল্লাহ তায়ালাই বিধানদাতা।” (সূরা ইউছূফ-৪০) অপর আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালার নিকট ধর্ম একমাত্র ইসলাম।” (সূরা আল ইমরান) আরো ইরশাদ হচ্ছে,
ومن يبتغ الخ
“যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম তালাশ করে (গ্রহণ করে) কস্মিনকালেও তা মেনে নেয়া হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা আলে ইমরান-৮৫) অন্য আয়াত শরীফে ঘোষিত হচ্ছে,
وما كان لمؤ من ولا مؤ منة الخ
“আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন বিষয় নির্ধারণ করলে, কোন ঈমানদার নর-নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বনের অধিকার নেই। যে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্যে পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” (সূরা আহযাব-৩৬) (দুই) গণতান্ত্রিক কর্মসূচী: (ক) গণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মসূচীর মধ্যে অন্যতম হলো ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশের উচ্চ দায়িত্বশীল পদের নির্বাচন। শরীয়তের দৃষ্টিতে গণভোটের এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ অসাঢ় ও অযৌক্তিক। সুতরাং তা নাজায়িয। কুরআন শরীফের বহু আয়াত শরীফে এ পদ্ধতির অসাঢ়তা প্রমাণ করতঃ বিরোধিতা করা হয়েছে। যার কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ الخ
“আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশের কথা মেনে নেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহ পাক-এর পথ থেকে বিপথগামী করে দিবে। তারা কেবল অলিক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক কথা বলে।” (সূরা আল আনআম-১১৬) অন্য আয়াত শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
وما يتبع اكثر هم الخ
তোমাদের অধিকাংশই শুধু অনুমানের উপর চলে, অথচ অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোন কাজেই আসে না।” (সূরা ইউনুছ-৩৬) অপর আয়াত শরীফে বলেন, “আপনি বলে দিন, অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের আধিক্য তোমাকে বিস্মিত করে।” (সূরা আল মায়িদা- ১০০) উক্ত আয়াত শরীফসমূহের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, জনগণের অধিকাংশ হবে মূর্খ, বোকা ও দায়িত্বহীন। আর প্রচলিত গণতন্ত্রে এদের অধিকাংশের রায়ের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সুতরাং তা নিশ্চিতভাবে ভুলই হবে। সুতরাং বাছ-বিচার ছাড়া সংখ্যাধিক্যকে মাপকাঠি বানালে তা সুনিশ্চিতভাবে ভ্রষ্ট হবে, বর্তমানে তাই হচ্ছে। (খ) গণতন্ত্রের অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে মিছিল, মিটিং, সভা, সেমিনার, প্রচার, বিজ্ঞাপন, বিবৃতি, হরতাল, বয়কট, অনশন, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদি। এ সবের মধ্য হতে প্রচলিত হরতাল ও মিথ্যাবিবৃতি এবং আমরণ অনশন শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়িয নেই। এছাড়া অন্য সব কর্মসূচী মূলত বৈধ। তবে যদি নিছক দলীয় ও নেতৃত্বের লোভে করা হয় তাহলে তা জায়িয হবেনা। তেমনিভাবে কাউকে বা জনসাধারণকে অহেতুক কষ্ট দিয়ে কোন কর্মসূচী পালন করা হলে তাও জায়িয হবেনা। বরং তাতে গুণাহ্ হবে। (ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া, ১ম খণ্ড, ১৫৫-১৫৭ পৃষ্ঠা) উল্লেখ্য, আজকের জোট সরকারের শরীকদার তথাকথিত শাইখুল হাদীছ, মুফতী আমিনী, নিজামী, সাঈদীগং সরকারকে এই বলে উত্তেজিত করতে চায় যে, আল বাইয়্যিনাতে গণতন্ত্র হারাম ফতওয়া দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা বুঝেনা যে, পরের জন্য কুয়া খুঁড়লে নিজেকেই সে কুয়ায় পড়তে হয়। আল বাইয়্যিনাতের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করলে সে অভিযোগ তাদের দিকেই নিবদ্ধ হয়। এ নিবন্ধে তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোটের পত্রিকা ও কিতাবে গণতন্ত্র হারাম সম্পর্কিত মন্তব্য পেশ করা হলেও এর আগে মওদুদী ও জামাতও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এমনকি মওদুদী তার ‘রাসায়েল ও মাসায়েল’ “কিতাবে সংসদীয় নির্বাচন হারাম, নির্বাচিত সাংসদ হারাম সে কথা বলেছে”- তাও উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, যেসব ইসলামের খোলসধারী, ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দূরভিসন্ধিমূলকভাবে চাচ্ছে যে, আল বাইয়্যিনাতের উপর সরকারের খড়গহস্ত নেমে আসুক, তাদের উচিৎ আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে নেয়া। এবং একথা ভালো করে মনে রাখা যে, পরের জন্য কুয়া খুঁড়লে নিজেকেই তাতে পড়তে হয়। তাদের মনে রাখা উচিত যে, আল বাইয়্যিনাত নিজ থেকে বা বানানো কোন কথা বলেন না। আল বাইয়্যিনাত শাশ্বত এবং সনাতন ও ছহীহ ইসলামের কথা নির্ভিকচিত্তে, দ্ব্যার্থহীনকণ্ঠে উচ্চারণ করে মাত্র। আর এটা অনিবার্য যে, যারাই আজকে ইসলামের নামে ধর্মব্যবসা করছে, তার পুঁজি হিসেবে প্রথমে তাদেরকে ইসলামের কথাই বলতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে আজকে আল বাইয়্যিনাতের ফতওয়াগুলোকে তাদেরকে প্রতিধ্বনি করেই ইসলামের লেবাছ তাদের গায়ে দেখাতে হয়েছে। অতঃপর সে লেবাছে লোক দেখানো পর্যায়ের ভিত্তি মজবুত হলেই তারা আজকের ধর্মব্যবসায়ে নামতে পেরেছে। কিন্তু শুরুতে তাদেরকেও আল বাইয়্যিনাতের পথেই চলতে হয়েছে। সে বিষয়ে আল বাইয়্যিনাত আল্লাহ পাক-এর রহমতে যথাযথ বাইয়্যিনাত তথা দলীল দেয়ার হিম্মত রাখে ইনশাআল্লাহ। -মুহম্মদ ওয়ালির্উ রহমান, ঢাকা।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫