এবারের বন্যায় দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের ৫৭ বছর বয়স্ক মুহম্মদ আলী আক্কাসের বোধোদয় হয়েছে। তার অভিব্যক্তি দৈনিক প্রথম আলোর কুমিল্লা প্রতিনিধি তুলে ধরেছেন। আলী আক্কাস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, ‘ইলেক্শন আইলে হগলতে কত্ত আদর কইর্যা, সন্মান কইরা, জনদরদী হইয়া ভোট চায়, আমাগো দুখ্যে-সুখ্যে সাথী ইহবো। এহন বইন্যায় আমাগো থাওনের জাগা ডুবাইছে, রান্দনের চুলা ডুবাইছে। একজন নেতাও ঢাহাত্তে নাইম্যা আইছে না। আমাগো এমপি রইছে বিদেশ বইয়া, সাবেক দুই-দুই মন্ত্রী কিছু দেওন থাক দূরের কথা, আমাগো করুণ অবস্থা দেখতেও আইল না।’ (দৈনিক প্রথম আলো ২৯ জুলাই ’০৪, পৃষ্ঠা ৪) আক্কাস আলী এখন বুঝেছেন, ইলেক্শনের সময়, ভোট চাওয়ার সময় নেতাদের আদর, সম্মান, প্রতিশ্রুতি সবই কেবল লোক দেখানো। একই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, ঢাকার লালবাগের পাঁচ সন্তানের মা জরিনা বেগম। তিনি বলেছেন, ‘আইজ পর্যন্ত কেউ একমুট চাইল দেয় নাই। এইহানে কেউ সাহায্য করিতে আহেনা।’ একই বাড়ির নূর মুহম্মদ বলেছেন, ‘বড় শখ কইরা ভোট দিছিলাম, অত কষ্টে আছি, একদিন আইয়া আমাগো কেউ দেখলোও না।’ (দৈনিক মানবজমিন ৭ আগস্ট ’০৪, পৃষ্ঠা ৩)
মূলতঃ এটা কেবল একজন আক্কাস আলী, একজন জরিনা বেগম, একজন নূর মুহম্মদের বিচ্ছিন্ন অনুভূতি নয়। এটা সামগ্রিক বাস্তব চিত্র। ভোটের রাজনীতিতে লোক দেখানো প্রবণতা সব ভোট প্রার্থীর নিকটই অপরিহার্য পন্থা বা অনুশীলন বলে বিবেচিত।
এদিকে যেখানে ত্রাণ তৎপরতা পৌঁছেছে সেখানকার চিত্রও বেদনাদায়ক। পত্রিকায় এসেছে, ‘ভোটার তালিকা দেখে তৈরী হচ্ছে এ তালিকা। বরং অনেকেই বলেছেন, ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় তাদের ি প দেয়া হয়নি। এজন্য তারা ত্রাণ থেকে হয়েছেন বঞ্চিত।’ (দৈনিক মানবজমিন ৫ আগস্ট’ ০৪, ১৭ পৃষ্ঠা) পত্রিকান্তরে আরো রিপোর্ট করা হয়, “কিন্তু তালিকা প্রণয়নকালে চেয়ারম্যান বা মেম্বররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত দুঃস্থদের বাদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার জন্য অনেক মেম্বার প্রকৃত বন্যার্তদের নাম তালিকাভুক্ত না করে নিজেদের আত্মীয় বা পছন্দসই ব্যক্তিদের ত্রাণ দিচ্ছেন। (প্রথম আলো ৬ আগস্ট ’০৪, ৪ পৃষ্ঠা) অনেক সংসদ সদস্য আবার ত্রাণকার্ডে ছাপিয়ে দিয়েছেন নিজের ও দলের নেতার ছবি। (দৈনিক সংবাদ ৭ আগস্ট ’০৪)
অর্থাৎ এখন থেকেই ভোটের রাজনীতিতে প্রচারমুখী হয়েছেন তারা। কথিত ত্রাণ কার্যক্রমের পিছনে পুরোটাই কাজ করছে তাদের লোক দেখানো মনোবৃত্তি। এই লোক দেখানো মনোবৃত্তি খোদ পি.য়ম থেকে পিয়ন পর্যন্ত এত প্রকটভাবে সঞ্চরিত হয়েছে যে, মানবতা, নৈতিকতা, ধার্মিকতা এখন মহাবিপন্ন। এ কারণেই লোক দেখানো প্রবণতা ইসলামে চরমভাবে ঘৃণিত ও মহা অপরাধ তথা শিরক সমতুল্য গুণাহ্ বলে বিবেচিত। ইসলামের পরিভাষায় এটাকে রিয়া বলা হয়। যে প্রসঙ্গে এই নিবন্ধে পরে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
পত্রিকান্তরে মন্তব্য করা হয়, “সরকারী ত্রাণ কার্যক্রম টেলিভিশনের ক্যামেরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সরকারের ত্রাণ তৎপরতা পুরোটাই প্রায় লোক দেখানো। সরকারীভাবে দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ত্রাণতৎপরতা চালানো হচ্ছে বটে; কিন্তু টেলিভিশনের ক্যামেরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ত্রাণ বিতরণ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী এই ধরণের ত্রাণ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছেন। (দৈনিক সংবাদ ৩ আগস্ট, ’০৪, ৪ পৃষ্ঠা) একই নিবন্ধে আরো মন্তব্য করা হয়, “আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ততক্ষণই ত্রাণ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেন যতক্ষণ টিভি ক্যামেরা থাকে।” (দৈনিক সংবাদ, ৩ আগস্ট ’০৪, ৪ পৃষ্ঠা)
টিভি ক্যামেরা নির্ভর এই ত্রাণতৎপরতা কতটা লোক দেখানো তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরো একটি খবরে। “প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেই শাড়ি হয়ে গেল হাওয়া, চাল হয়ে গেল অর্ধেক” শীর্ষক খবরে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জের বন্যার্তদের প্রত্যেককে নিজ হাতে দশ কেজি চাল এবং একটি করে শাড়ি ত্রাণ হিসেবে দান করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর অপেক্ষমান বানভাসিদের পাঁচ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এমনকি পরে অনেকেই শূন্য হাতে ফিরে যায়। ঘটনাটি জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।” (দৈনিক সংবাদ ২৫ জুলাই ’০৪, ১ম পৃষ্ঠা) উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর শাড়ি-লুঙ্গি, দশ কেজি চালের ত্রাণ দেয়ার চিত্রই টিভি ক্যামেরায় দেখানো হয়েছে। পরে শাড়ি হাওয়া হয়ে যাওয়া বা চাল অর্ধেক ও কম হয়ে যাওয়ার বিষয়টি টিভি ক্যামেরায় আসেনি। মূলতঃ এই ত্রাণ বিতরণ এখন সম্পূর্ণই ক্যামেরা নির্ভর হয়ে পড়েছে। এবং এই ক্যামেরা নির্ভর লোক দেখানো ত্রাণ প্রবণতা সবার মাঝেই খুব করে জেঁকে বসেছে। এ সম্পর্কে পত্রিকায় মন্ত্রব্য করা হয়েছে, “ত্রাণ বিতরণ এবং ক্যামেরা সংকট”
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোতে এখন ক্যামেরা সংকট দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য ধারণ করার হিড়িক পড়াই এ সংকটের মূল কারণ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রী, এমপি, এনজিও এবং বিভিন্ন রাজনীতিকরা ত্রাণ বিতণের তারিখের ২/৩ দিন আগেই টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানদের সঙ্গে কন্ট্রাক করছেন। তারপর ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য ধারণ করার সময় সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানদের মোটা অংকের বখশিশ দেয়া হচ্ছে। তারপরও সময়মতো ক্যামেরা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজের ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে বিটিভি ও বেসরকারী চ্যানেলগুলোতে সরবরাহ করছেন। সঙ্গে থাকে মোটা অংকের বখশিশ। বেসরকারী চ্যানেলের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা জানালেন, ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য ধারণের হিড়িকের কারণে চ্যানেলগুলোতে এখন ক্যামেরা সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে হেলিকপ্টার ভাড়া করেও টিভি রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানদের ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য ধারণ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ফলে রাজনীতিকদের পকেটের টাকা দুর্গতের জন্য ত্রাণ ক্রয় করতে যা খরচ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে সেটা টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় প্রচারে।” (দৈনিক ইনকিলাব ১৩ আগস্ট, ’০৪, ১৪ পৃষ্ঠা)
বলাবাহুল্য, এই লোক দেখানো ত্রাণ তৎপরতা এখন ত্রাণ বাণিজ্যে পর্যবসিত হয়েছে। পত্রিকান্তরে মন্তব্য করা হয়, “এদিকে ত্রাণ বিতরণের নামে অধিকাংশ সংগঠন শুরু করেছেন বন্যাবাণিজ্য। একপোয়া থেকে এক কেজি চিড়া, চিনির ছোট ছোট দু’থেকে তিন শ’ প্যাকেট নিয়ে নৌকা ভাড়া করে ব্যানার এবং স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসব সংগঠন ফটোসেশন করে ত্রাণ বিতরণের নামে এক ধরনের তামাশা করছে বিড়ম্বিত মানুষদের নিয়ে। সরেজমিনের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে বন্যা দুর্গত অসহায় মানুষদের এ ধরনের নানা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মোল্লাচর ইউনিয়নের চিথুলিয়া দিগর গ্রামের দিন মজুর এরফান আলী জানালেন, সগ্লে খালি কি একনা ইলিপ দেয় আর বাহারি ফটো খিচি চলি যায়।” (জনকক্ত ১ আগস্ট ’০৪, পৃষ্ঠা ১৩) এরচেয়েও মারাত্মক খবর এসেছে পত্রিকায়। এতে বলা হয়, ঢাকার কামরাঙ্গীচরের বন্যা উপদ্রুত একটি এলাকায় কোন একটি সংস্থার কর্মকর্তারা ত্রাণ বিতরণ না করেই শুধু পত্রিকায় ছবি তোলার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পোঁজ দিয়ে দায়িত্ব চুকে ঢাকায় ফেরত গেছেন। আরও বহু সংস্থার লোকজনও ঐ একই কাজ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। (দৈনিক জনকক্ত ৭ আগস্ট, ’০৪, ৬ পৃষ্ঠা)
মূলতঃ এই লোক দেখানো প্রবণতা মানুষকে কতটুকু অমানুষের পর্যায়ে ঠেলে দিতে পারে এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র। এজন্যই লোক দেখানো প্রবণতা তথা ‘রিয়া’ ইসলামে চরমভাবে ঘৃণিত ও নিন্দিত এবং মহা অপরাধযোগ্য শাস্তি বলে বিবেচিত। মহান আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আখিরাতে প্রতিদান পেতে চায় তাকে তা বেশী করেই দেয়া হয়। এবং যে ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রতিদান পেতে চায় তাকে দুনিয়াই তা দেয়া হয়। কিন্তু পরকালে তার জন্য কিছুই রাখা হয় না।” এ আয়াত শরীফের মর্মমূল থেকেই ইসলামী পরিভাষায় ‘রিয়া’র ধারণা উৎসরিত হয়েছে। রূয়্যাত শব্দমূল্য থেকে ‘রিয়া’ শব্দের উৎপত্তি। শরীয়তের পরিভাষায় কোনো কাজের পিছনে অন্তরে লোক দেখানো মনোবৃত্তিকেই ‘রিয়া’ বলা হয়। ‘রিয়া’র সহযোগী প্রবণতা হলো, আত্মপ্রসাদ লাভ করা। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয় উজব। অন্য কারো কাছে, নিজের কাছে নিজের বুযূর্গী বা দানের কথা প্রকাশ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করাকেই উজব বা আত্মম্ভরিতা বলে। মূলতঃ রিয়া ও উজব পাশাপাশি চলে। আর এ দু’টোই নেক কাজকে বরবাদ করে দেয়। হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় ‘মিনহাজুল আবিদীন’ কিতাবে বলেন, “রিয়া, উজব মুহূর্তের মধ্যে আবির্ভূত হয়ে সত্তর বছরের ইবাদত মাটি করে দেয়।”
বর্ণিত রয়েছে, এক ব্যক্তি হযরত ছূফীয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও তাঁর মুরীদ-মুতাক্বিদদের দাওয়াত করলেন। তাদের সামনে সে, ঘরের লোকদের বললো, আগের হজ্বের যে খেজুর এনেছি তাই নিয়ে এসো, পরের হজ্বের খেজুর এনো না। হযরত ছূফীয়ান ছাওরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে হতভাগা! তুমি তো একথা বলে তোমার দু’টো হজ্বই বরবাদ করলে।’ এজন্য হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে, এমনভাবে দান করো যে, ডান হাত দান করলে বাম হাত যেনো না জানে।” বলাবাহুল্য, এসব ওয়াজ বাঙ্গালী মুসলমানদের কাছে প্রায় বিস্মৃত হলেও নতুন মোটেও নয়। কারণ এগুলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। আবহমানকাল ধরে উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ এসব ওয়াজ করে আসছেন। তার রেশ এখনো ক্ষীণ হলেও একেবারেই মৃত নয়। ঈমানী চেতনায় বরং তা জীবন্মৃত হলেও বেঁচে আছে বলে বলা যায়।
আলিমরা নবীগণের ওয়ারিছ। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী থেকে পিয়ন কেউ নিজেকে আলিম হিসেবে প্রচার করেনা, দাবী করেনা। সুতরাং ইসলামী মূল্যবোধের ধারণা প্রাপ্তিতে ও শিক্ষার জন্য তারা আলিমদের মুখাপেক্ষী। আলিমরা নিজেদের মাঝে ধারণকৃত আদর্শের দ্যুতিতে সাধারণের মাঝে ইসলামী নৈতিকতার প্রভাব বলয় তৈরী করবেন এটাই সার্বজনীনভাবে কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত। খিলাফতের যুগে এর উদাহরণ একটি নয়, লক্ষ লক্ষ। আরবের বুকে এক নিভৃত এলাকায় পড়ে ছিলো এক অসহায় বুড়ি। ফারুকে আ’যম, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখনো দ্বিতীয় খলীফা হননি কিন্তু দুর্গতদের সেবায় তখন থেকেই তিনি ছিলেন বেমেছাল ভাবে নিবেদিত। এই প্রবণতায় একদিন তিনি খোঁজ পেলেন সেই অসহায় অনাথ বুড়ির। কিন্তু গিয়ে দেখলেন তার আগেই কে যেন যতœ করে সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়ে গেছে। এভাবে যখনই তিনি যেতেন তখনই তিনি দেখতেন তাঁর যাওয়ার আগেই বুড়ির সব চাহিদা পূরণ হয়ে গেছে।
এদিকে এই সাহায্যদাতাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলে বুড়ি কখনও বলতে পারতো না। কারণ, সাহায্যকারী তার নাম বলতেন না। কিন্তু একদিন তার ব্যতিক্রম ঘটলো। খলীফাতু রসূলিল্লাহ, আফজালুল নাছ বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইন্তিকাল করার পর এই মহান সাহায্যকারীকে আর দেখা গেলনা।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখন বুঝলেন যে, এই মহান সাহায্যকারী অন্য কেউ নয় স্বয়ং প্রথম খলীফা আফজালুন্ নাছ বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
একইভাবে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জীবনেও এরকম কাহিনী ভরপুর। তিনিও রাতের আধারে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতেন। অসহায়-অনাথদের ছদ্মাবেশে সাহায্য করতেন। তবে নিজের নাম জাহির করতেন না কখনও।
বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের তথাকথিত ইসলামী রাজনীতিকগণ এদেশের সাধারণ মানুষকে খিলাফতের সেই স্বর্ণযুগের কাহিনী বলে খিলাফতের সুখ-স্বপ্ন দেখিয়ে ইসলামের নামে রাজনীতি করছেন। কিন্তু খিলাফতের কথা বললেও তারা আসলে করছেন ইসলামের নামে ভোটের রাজনীতি। তাই যেক্ষেত্রে আশাপ্রদ ছিলো যে, খেলাফত প্রতিষ্ঠার পথে খলীফাদের অনুকরণে তারাও নিবেদিত হবেন। তাঁদের আদর্শ অনুসরণে তারাও দান-দক্ষিণা যাই করবেন তা একেবারেই নিশ্চুপে করবেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা, লোক দেখানো প্রবণতা বা ‘রিয়া’র অভিশাপ হতে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবেন। তাদের সেই অনুপম চরিত্র দেখে ‘ডান হাত দান করলে বাম হাত যেন না জানে,’ তাদের এই অমিয় নছীহত শুনে এই লেখার প্রথমে বর্ণিত লোক দেখানো মনোবৃত্তির রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও হুঁশ হবে। পরকালে লোক দেখানো কার্যক্রমের পরিণতি সম্পর্কে অবগত হয়ে তারা শিহরিত হয়ে উঠবে এবং সর্বোপরি লোক দেখানো আমলের লজ্জা জেনে অবশেষে তারাও নিবৃত্ত হবে। মূলতঃ এ আশাবাদ একান্তই ইসলামের কথা, হক্ব কথা, ন্যায্য কথা। কিন্তু সেই ন্যায্য কথাকে নির্লজ্জভাবে, নির্বিচারে দলিত মথিত করে দিয়েছে আমাদের তথাকথিত ইসলামী রাজনীতিকগণ। ইসলাম ফেলে, ভোটের রাজনীতিতে মশগুল হয়ে তারাও এখন লোক দেখানো প্রবণতার প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়েছে। দুনিয়াবী রাজনৈতিক নেতাদের মতই ক্যামেরাবন্দী হয়ে টিভি-পত্রিকায় ছবি ছাপানোর প্রক্রিয়াই তারা তথাকথিত ত্রাণ তৎপরতা দেখিয়েছেন এবং পত্র-পত্রিকায় তা ফলাও করে প্রচারও করেছেন। ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় তথাকথিত শাইখুল হাদীছ জানিয়েছে যে, ‘তারা এক লাখ টাকার ত্রাণ দিয়েছে।’ (৬ আগস্ট, পৃষ্ঠা ৮) তথাকথিত মুফতী আমিনী জানিয়েছে, ‘সে এ পর্যন্ত ৬০ লাখ টাকার ত্রাণ দিয়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট, ৮ পৃষ্ঠা) তথাকথিত মাওলানা মাহিউদ্দীন খান জানিয়েছে, ‘তারা ৩০-৩৫ লাখ টাকার ত্রাণ দিয়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট, ৮ পৃষ্ঠা) তথাকথিত মুফতী ইজহার জানিয়েছে, ‘সে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার ত্রাণ দিয়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট, ৮ পৃষ্ঠা) তথাকথিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব জাফরুল্লাহ বলেছে, ‘তারা কাপড়, বিস্কিট ও চাল দিয়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট, ৮ পৃষ্ঠা) এই তো গেল তথাকথিত জাহিরী মাওলানাদের কথা। কিন্তু এরপর যারা ছূফী বা পীর ছাহেব বলে দাবী করে তারাও দুনিয়াবী রাজনীতিকদের মতই লোক দেখানো কর্মকা- হতে কোন অংশৈ কম যাননি। তথাকথিত চর্মনাই পীরেরর উক্তি- ‘সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত আমরা ৫০ লাখ টাকার ত্রাণ দিয়েছি।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট, ৮ পৃষ্ঠা) পত্রিকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে সে শুধু এই কথাই প্রচার করেনি বরং ঠিক প্রকাশ্যে বেপর্দা হয়ে, দুনিয়াবী মন্ত্রীদের কায়দায় ত্রাণের প্যাকেটে হালকা হাত ছুঁয়ে দিব্যি ফটোসেশন করেছে।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ আগস্ট ’০৪)
উল্লেখ্য, এই সময় চর্মনাই পীরসহ তার ঘনিষ্টজন ও মহিলারা একাকার হয়ে গিয়েছিলো। নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চর্মনাই পীরের অবস্থানের পর্দার আদর্শের কোন কর্মসূচীই তার ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় ছিলোনা।
একইভাবে ত্রাণ বিতরণের নামে ফটোসেশন করেছে, পত্রিকায় ছবি ছাপিয়েছে বায়তুশ শরফের তথাকথিত পীর কুতুবউদ্দীন ছাহেব। অর্থাৎ কিনা কি জাহিরী মুফতী-মাওলানা তথা শাইখুল হাদীছ অথবা নামধারী পীর ছাহেব কেউই লোক দেখানো প্রবৃত্তি বা প্রবণতা হতে নিজেকে হেফাযত করতে পারেনি। লোক দেখানো প্রবণতা বা রিয়া যে গোপন র্শিক হাদীছ শরীফের সেই সতর্কবাণী দ্বারা তারা সচেতন হননি। অন্ধকার রাতের কালো পাথরের পিপীলিকার পদচারণা হতেও সূক্ষ্মভাবে রিয়া বা লোক দেখানো প্রবণতা অন্তরে জেগে বসতে পারে- হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এই নছীহত বাণী দ্বারা তারা আদৌ বিচলিত হননি।
‘রিয়া’ বা লোক দেখানো প্রবণতার মারাত্মক পরিণতি ও বিশেষ কুফল সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ্র আমোঘ নির্দেশ দ্বারা তারা আদৌ উজ্জীবিত হয়নি বরং অন্যান্য দুনিয়াবী রাজনীতিক মন্ত্রী-এমপিদের মত তারাও ভেসে গেছেন লোক দেখানো প্রবণতায়, রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী তথা উদ্দেশ্য পূরণের মওকায়। যার দ্বারা আবারো প্রতিভাত হলো যে, আসলে দুনিয়াবী অন্যান্য রাজনীতিকদের সাথে তাহাদের কোনই পার্থক্য নেই। দুনিয়াবী অন্যান্য রাজনীতিকদের মত তারাও ভোটের রাজনীতি করছেন মাত্র। তবে তা আরও কদর্যভাবে। কারণ, ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা হাছিলের জন্য তাহারা ইসলামকেও লেবাস বা খোলস এবং হাতিয়ার বা কৌশলরূপে ব্যবহার করছেন মাত্র। পাশাপাশি আরো প্রতীয়মান হয় যে, ভোটের রাজনীতি আর ইসলাম কখনও এক নয়। ভোটের রাজনীতি করতে গেলে নানাবিধ অনৈসলামী অনুষঙ্গ অনিবার্যভাবে জড়িয়ে যায়। ভোটের রাজনীতি করতে গেলে যেহেতু লোকের উপর নির্ভর করতে হয়, লোকের খেয়াল-খুশীকে মূল্যায়ন করতে হয় সুতরাং তখন লোক দেখানো প্রবণতা আবশ্যক হয়ে পরে। আর এই লোক দেখানো প্রবণতার প্রবাহে চাপা পরে আর্ত-মানবতা। সক্রিয় হয়ে উঠে স্বার্থবাদী প্রবণতা। ভোটের রাজনীতির পীঠস্থান আমেরিকা হতে কেনিয়া পর্যন্ত সব জায়গাই একই অবস্থা।
বলাবাহুল্য, ক্লিনটনের ইরাক আক্রমন আর বুশের আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের পিছনে ছিল এই লোক দেখানো প্রবণতা।
ক্লিনটনের মনিকা নিউনস্কি কেলেঙ্কারীর সময় জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য, বুশের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার দায় থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য তথা নির্বাচনের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরীর জন্যই ছিল মুসলিম দেশসমূহে তাদের এই পৈশাচিক আক্রমণ। অর্থাৎ যার মূলে ছিল ভোটারদের মন আকর্ষণ তথা লোক দেখানো প্রবণতার অনুশীলন। বলাবাহুল্য, রাজনীতি করতে গিয়ে আমাদের দেশের তথাকথিত ইসলামী রাজনৈতিকগণ ইসলাম ছেড়ে এখন এই লোক দেখানো প্রবণতা তথা ‘রিয়া’র মাঝে বিলকুল মশগুল হয়ে এক একজন মহা ‘রিয়াকারে’ পরিণত হয়েছে। মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক-এর দরবারে এসব ‘রিয়াকারের’ জন্য লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা ভিন্ন অন্য কিছুই প্রাপ্য নেই। এরা আল্লাহ পাক-এর ইসলাম করেনা। এরা করে লোক দেখানো ইসলাম। যার দ্বারা তাদের ইসলামের নামে রাজনীতির ভিত্তিই রচনা হয়, মুসলমান বা ইসলামের নয়।
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, বাসাবো, ঢাকা।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি তোলা, রাখা, আঁকা, দেখা হারাম’ মুজাদ্দিদে আ’যমের অনবদ্য তাজদীদ