কারো উপর ভর করে পাপের প্রচলন করার ইবলিসের কাহিনী ইতিহাসে অনেক পুরানো। কাবিলের দ্বারা- হত্যা, আমর বিন লুহাইর দ্বারা- মূর্তি পূজা, হযরত লুত আলাইহিস্ সালাম-এর ক্বওম দ্বারা সমকাম, জ্বলীলুল ক্বদর রসূল, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিক্ষেপকারীদের সর্দারের দ্বারা ব্যভিচার ও টিপ প্রথার প্রচলন, ইতিহাসে ইবলিসের এরকম বহু নজীর। আর সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে ভ্যালেনটাইন ডে. প্রবর্তনে ইবলিসের নতুন সংযোজন, ইবলিসের মুয়াজ্জিন শফিক রেহমান।
পাশাপাশি আজকের রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের উৎসব প্রবর্তনের অনুসন্ধানে গুটি কয়েক নামই চলে আসে।
সাতচল্লিশ পূবৃকালে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান পূর্ব বাংলাও হতো না। রমনায় কবি নজরুলও এসেছিলেন কিন্তু তারপরও কোন অনুষ্ঠান হয়নি।
এদিকে হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৭৭ সালের পহেলা জানুয়ারী থেকে ঢাকায় ইংরেজী নববর্ষের উৎসব চালু হয়।
রাজধানীতে এখন পহেলা বৈশাখের দু’টো প্রধান দিক। রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের সঙ্গীতানুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং জান্তব মুখোশের র্যালি।
রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ পালনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। ১৯৬৬,‘৬৭ এমনকি ‘৬৮-র কথাও অনেকে বলেন। আর রমনার বটমূলে সঙ্গীত তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। রমনার বটমূলে সানজীদা খাতুনের গান ও তার সাহায্যের আবেদন দিয়েই একার্যক্রম চালু হয়। এর আগে ছায়ানট ও শান্তিনিকেতনী স্টাইলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করত।
উল্লেখ্য শান্তিনিকেতনে এখনও পহেলা বৈশাখে ঢাকার মত মাতামাতি হয় না।
রমনার বটমূলে আজকের পহেলা বৈশাখ পালনের পটভূমিকা রয়েছে। কথিত সংস্কৃতকর্মীরা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় আইউব শাহীর বিরোধিতা করতে গিয়ে রবীন্দ্রতোষণকেই মুখ্য হাতিয়ার মনে করেছেন। অপরদিকে আইউব খান মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথই বুঝি বাঙালীর মূলমন্ত্র। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালন বাধাগ্রস্ত করা হয়।
বলা হয়, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনের প্রেরণার পটভূমিতে স্থাপিত হয় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। তারাই প্রথম রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৬৯-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের জঙ্গী সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেন। সব ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ। ছায়ানট পহেলা বৈশাখের নামে বাধ ভেঙে দেয়ার উৎসব আয়োজন করল।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, রমনার বটমূলে সঙ্গীত বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকারীরা অনেকটা আইউব বা পাকিস্তানী বিদ্বেষ চালিত হয়েই ঐসব কর্মকা-ের প্রতি আলাদা জোস দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু ইতিহাস বলে আইউব খান কিন্তু ধার্মিক ছিলেন না। মদ ও নারীও তার নিত্যসঙ্গী ছিল। ব্রিটিশরা মোহামেডান ল’তে যা করেনি আইউব খান তা করেছেন। তিনি সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের সনাহনী ইসলামী আইনে হস্তক্ষেপ করেছেন। বিয়ে, তালাক, ওয়ারিস সত্ত্বে মুসলিম শরীয় আইনের খিলাপ নিজস্ব আইন ঢুকিয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মডারেট সাজা, আমেরিকার নেক দৃষ্টি লাভ করা।
কাজেই আইউব খানের বিরোধিতা করতে গিয়ে সংস্কৃতির নামে ধর্মীয় বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন না মুসলমান হিসেবে এ বোধ ঠিক না।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা পূর্ব এ বোধ যেমন কাজ করেছে স্বাধীনতা উত্তরও সে একই চেতনা সক্রিয় হয়েছে।
১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের রাজাকার পূর্নবাসনের প্রেক্ষিতে একটা জিয়াউর রহমান বিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়। এদিকে রাজাকাররা ধর্মীয় আদর্শের কারণে নয় বরং আইউব খান মানসিকতা দ্বারা তাড়িত হয়ে ধর্মব্যবসার ফাঁদে ধর্মপ্রাণদের দৃষ্টিকাড়তে চায়।
রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের বিরোধিতা না করলেও নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে। এ মনোভাবের পৃষ্ঠপোষকতা করেন ধর্মব্যবসায়ীদের পূর্নবাসনকারী জিয়াউর রহমান।
ফলতঃ জিয়াউর রহমান ও ধর্মব্যবসায়ী রাজাকারদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আরো উদ্দামত্তার সাথে পহেলা বৈশাখ পালনের প্রক্রিয়া চলে।
এ প্রসঙ্গে আনু মাহমুদ সম্পাদি “পহেলা বৈশাখ বাঙালীর ঐতিহ্যের হক” পুস্তকে বলা হয়-
“বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তখন জিয়াউর রহমান জঙ্গি অভিযান শুরু করেছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব চাপিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান তাই পরিণত হয়েছিল প্রতিবাদী জনতা মিলনকেন্দ্রে।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নববর্ষের প্রভাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় আয়োজন করে সমাবেশের। অত্যন্ত গোপনে তৈরি হয় ব্যানার ও ফেস্টুন। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত, খ. ম. জাহাঙ্গীর, কামরুল আহসান খান, বাহালুল মজুনুন চুন্নু, মৃনাল সরকার প্রমুখ। বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে ছাত্র-ছাত্রীদের বড় মিছিলটি মিয়ে যায় রমনার বটমূলে হাজারো জনতার ভিড়ে। অন্য কোনও গন্তব্যের কথা আমরা ভাবতে পারিনি।
ওই নববর্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের শুভেচ্ছা কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্র ইউনিয়ন নেতবৃন্দ। এজন্য কৌশল ছিল অভিনব। জঙ্গি শাসকরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর আঘাত হানছে। তার জবাব দেয়া হয় শুভেচ্চা কার্ডে। ছোট ছোট কাগজে হাতে লেখা হয় “বাংলা ও বাঙালির জয় হোক”। তারপর স্ট্যাপলার পিনে লাগানো হয় বট ও অশ্বত্থ পাতায্ চৈত্রের শেষ দিনের গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসের রুমে রুমে পৌঁছে দেয়া হয় সংগ্রামী ছাত্রসমাজের নামের এই কার্ড। এতবড় আয়োজন গোয়েন্দাদের চোখ এড়ায়। নববষেৃর মিছিলের বিষয়টিও তারা জানতে পারেনি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওই কর্মসূচি অনূপ্রাণিত করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে চকান্ত মোকাবিলায় ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, এ কর্মসূচির মধ্যে সে সংকল্পের প্রমাণ পাওয়া যায়।
রমনার বটমূলে পরিচিত অনেকেই সেদিন আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিল” (পহেলা বৈশাখ বাঙালি ঐতিহ্যের বাহক, পৃষ্ঠা: ৮৯)
উল্লেখ্য, পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমলে একটা বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, জালিম পাকিস্তানী শাসকের জুলুম, তাদের ধর্ম ব্যবহারের পাশাপাশি ধর্মব্যবসায়ী, রাজাকার আল-বাদরদের নিজেদের ধর্মহীনতা কিন্তু দর্মপ্রাণদের দৃষ্টি কাড়তে ধর্মের মুখোশ ব্যবহারে প্রবণতা ও প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ারই এদেশের ধর্মবিরোধী অনেক মনোভাব ও সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে।
ধর্মহীন ধর্মব্যবসায়ীরা কোন সময়েই নিজেরা যেমন ধর্ম পালন করেনি তেমনি ধর্মের সারবত্তা, আদর্শ ও মর্যাদা ফুটিয়েও তুলতে পারেনি। ফলতঃ তাদের কারণে তথাকথিত প্রগতিবাদী ও সংস্কৃতিকর্মীরা ধর্মের প্রতি আকৃষ্টও হতে পারেনি। বরং ধর্মহীন ধর্মব্যবসায়ীদৈর মুখে ধর্মের আহবান শুনে ওরা ধর্মথেকে আরো দূরে সরে গেছে। আজকে রাজাকার, জামাতী, খারেজী, দেওবন্দীদের মুখে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকারীরা নিবৃত্ত হবার আহবান শুনে ওরা বরং আরো সোৎসাহে দ্বিগুণ বেগে ওদের সাংস্কৃতিক কর্মকা- চালিয়ে যাবার প্রেরণা পেয়েছে।
রাজাকার, জামাতী, খারেজী, দেওবন্দীদের অতীতের ঘৃণ্য কর্মকা- এবং ধর্মব্যবসার প্রক্রিয়ায় বর্তমান ধর্মহীনিতাই ওদেরকে এ সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে।
পহেলা বৈশাখ বৈশাখের বেপর্দা-বেহায়পনা নাজয়িয হলে খালেদা বিবির সাথে গো’আযম, মইত্যা-মুইজ্যা রাজাকার, মুজাহিদ, শাইখুল হদছ, কমিনী, মাহিউদ্দীন, আহমক শাফি, উবাই, সাঈদী ওরফে ইহুদী ইত্যাদির দেখা সাক্ষাত, নারী নেতৃত্ব এগুলো কি করে জায়িয হয় সে প্রশ্নের জবাব ওরা খুঁজে পায় না।
তাই এসব ধর্মব্যবসায়ীদের কারণেই ওরা ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারে না। ধমেৃর মর্ম বুঝতে পারে না। তখাকথিত সংস্কৃতিপনার অসারতা উপলব্ধি করতে পারে না। তারর মূলে থাকে ।ৈ ধর্মব্যবসায়ীদেরই ধর্মহীনতা। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েচে, “নিশ্চয়ই ধর্মব্যবসায়ীরা সৃষ্টির নিকৃষ্ট।”
-মুহম্মদ ওলীউল্লাহ, বাসাবো, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২