‘বাদশাহ্র কথা, কথার বাদশাহ্।’ এ প্রবাদের ব্যাখ্যা খুব সহজ। কোন বিষয়ে বাদশাহ্ উজির-নাযির, আমীর-উমরাহ্ বিভিন্ন মতামত দিচ্ছে। কেউ বলছে এটা হবে, কেউ বলছে ওটা হবে, কেউ বলছে সেটা হবে। হঠাৎ বাদশাহ্ সবাইকে থামিয়ে বলছে যে- ‘না, এটা এভাবে হবে।’ সবাই তখন থমকে গেল এবং অম্লানবদনে বাদশাহ্র কথাই মেনে নিল। এজন্য বলা হয়, ‘বাদশাহ্র কথা কথার বাদশাহ্।’ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, দুনিয়ার বাদশাহ্র কথাই যদি কথার বাদশাহ্ হতে পারে তবে সব বাদশাহ্র বাদশাহী থেকে যার মর্যাদা-মর্তবা আলীশান, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কথা মুবারক তাহলে কতটুকু গুরুত্ব বহন করতে পারে?
মূলতঃ তাঁর কথা মুবারককে কথা বলা হয়না। বলা হয়, হাদীছ শরীফ। আর হাদীছ শরীফ শোনা মাত্রই মুসলমান হৃদয়ে এক খোদায়ী অনুভূতি তৈরী হয়। কারণ, হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করা কুফরী। আর পৃথিবীর সমস্ত মখলুকাতের কথাকে এক পাল্লায় রাখা হলে তার যে ওজন হবে আর আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি কথা মোবারক অপর পাল্লায় রাখা হলে তার ওজন লক্ষ-কুটিগুণ বেশী ভারী হবে।
উল্লেখ্য, মুসলমান হওয়া মাত্রই গরীব-ধনী, আলিম-জাহিল, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কতগুলো হাদীছ শরীফ সবারই জানা রয়েছে। যেমন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত।’ ‘মথ্যা বলা মহাপাপ।’ ‘ইল্ম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয’ ইত্যাদি। বস্তুতঃ এসব হাদীছ শরীফ সম্পর্কে যেমন কারো দ্বিমত নেই তেমনি প্রসঙ্গতঃ আরো একটি হাদীছ শরীফ রয়েছে সেটি সম্পর্কেও মুসলমান মাত্রই কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি হচ্ছে- ‘দাইয়্যূস বেহেশ্তে প্রবেশ করতে পারবেনা।’ মূলতঃ দাইয়্যূস ঐ ব্যক্তি যে নিজে পর্দা করেনা এবং তার অধীনস্থ মহিলাদেরও পর্দা করায়না। বলাবাহুল্য, এই হাদীছ শরীফ সবারই জানা ও মানা। সুতরাং একে অস্বীকারের কোন উপায় নেই। প্রাসঙ্গিক অন্য হাদীছ শরীফে আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে সম্বোধন করে বলেন, “তুমি দৃষ্টিকে অনুসরণ করনা। অর্থাৎ কোন বেগানা মহিলার প্রতি দৃষ্টি দিওনা, কারণ, তোমার প্রথম দৃষ্টি (যা অনিচ্ছা সত্ত্বে পতিত হয়) তা ক্ষমা করা হবে, কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি ক্ষমা করা হবে না। অর্থাৎ পরবর্তী প্রতি দৃষ্টিতে একটি করে কবীরা গুনাহ লিখা হবে।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, দারিমী, মিশকাত, মিরকাত) এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন, “অনন্তর যে বিন্দুতম নেক কাজ করবে সে তা প্রত্যক্ষ করবে আর যে বিন্দুতম পাপ কাজ করবে সেও তা প্রত্যক্ষ করবে।” এই আয়াত শরীফের তাফসীরে বলা হয়ে থাকে যে, ক্বিয়ামতের ময়দানে যদি কারো আমলনামায় তার কৃত সব পাপ কাজের পরিমাণ থেকে বিন্দুতম নেক কাজ বেশী হয় তবে সে জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে কারো আমালনামায় মোট নেক কাজ থেকে যদি বিন্দুতম পাপ কাজ বেশী হয় তবে সে জাহান্নামে যাবে। এতদ্বপ্রেক্ষিতে “দাইয়্যূস বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেনা” এ হাদীছ শরীফের অর্থ অনুধাবন করা সহজতর হয়। কারণ, যামানার মুজাদ্দিদ ও ইমাম, ইমামুল আইম্মা, বাহরুল উলূম রাজারবাগ শরীফের মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর তাজদীদী ও গবেষণাধর্মী মুবারক ক্বওল হচ্ছে যে, “প্রত্যেক মানুষ পুরুষ কিংবা মহিলা হোক. সে প্রতি দু’সেকেন্ডে পাঁচটি করে চোখের পলক বা দৃষ্টি ফেলে থাকে। সে হিসেবে প্রতি মিনিটে ১৫০টি পলক বা দৃষ্টি করে থাকে। আর ঘন্টা হিসেবে প্রতি ঘন্টায় ৯০০০ (নয় হাজার) পলক বা দৃষ্টি করে থাকে। সে হিসেবে বেগানা পুরুষ ও মহিলা পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার কারণে তাদের উভয়ের প্রতি এক মিনিটে তিনশ’টি এবং এক ঘন্টায় আঠার হাজার কবীরাহ্ গুণাহ্ লিখা হয়।” যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে যারা দাইয়্যূস, যারা অহরহ মেয়েলোকের সাথে উঠা-বসা করে থাকে, মিছিল-মিটিং করে থাকে, একই গাড়ীতে পাশাপাশি উপবেশন করে থাকে, ঘন ঘন একান্ত সাক্ষাৎ করে থাকে তারা যে তাহলে দৈনিক কত হাজার কবীরাহ্ গুণাহ্ করে থাকে তা আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন। মূলতঃ বিন্দু পরিমাণ পাপ কাজ বেশী হওয়ার কারণে যদি বান্দা জাহান্নামী হতে পারে তাহলে বেপর্দা তথা দাইয়্যূস হওয়ার কারণে ঘন্টায় আঠার হাজার কবীরাহ্ গুণাহে গুণাহ্গার হবার ফলে সে যে কত বড় মহা গুনাহ্গার তথা প্রকাশ্য জাহান্নামের কাঠি রূপে সাব্যস্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারণ ঘন্টায় আঠারো হাজার কবীরাহ্ গুণাহ্ করলে স্বভাবতই তার পক্ষে এমন কোন নেক কাজ করা সম্ভব নয় যা কিনা তার এত বেশী পাপ কাজকে অতিক্রম করতে পারে। অর্থাৎ তার নেক থেকে পাপের বোঝা অনেক বেশী হয়ে যায়। যা তাকে জাহান্নামে ঢেলে দেয়। উল্লেখ্য, দুনিয়াতেই বিশেষ কিছু জাহান্নামীদের চিহ্নিত করা যায়। যেমন, হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “আমার নামে যে মিথ্যা কথা বলে সে যেন দুনিয়াতেই তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” অর্থাৎ কোন লোক সে যে পরিচয়েই থাকুক সে যদি আল্লাহ্র রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা বলে তাহলে তাকে দুনিয়াতেই জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেয়া যায়। তদ্রুপ কোন ব্যক্তি সে শাইখূল হাদীছ বা মুফতি বা মাওলানা বা মুফাচ্ছিরে কুরআন যাই হয়ে থাকুন না কেন, এসব পরিচয়ের পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় যদি হয় বেপর্দা ব্যক্তি বা বেগানা মেয়েলোকের সাথে সাক্ষাতকারী, তার দিকে তাকানেওয়ালা, তার সাথে বসনেওয়ালা; তাহলে তার অন্য যত আমলই থাকুক, তার অবস্থান যাই হয়ে থাকুক, হাদীছ শরীফের ভাষায় তাকে স্পষ্টরূপে ঘোষণা করতে হয় দাইয়্যূসরূপে। আর হাদীছ শরীফে এটাই স্পষ্টভাবে লেখা আছে যে “দাইয়্যূস কখনো বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” অর্থাৎ দাইয়ি্যূস মাত্রই জাহান্নামী। উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফে এত শক্তভাবে বর্ণনার কারণ, বেহেশতের দরজায় এটা লেখা থাকার কারণ মূলতঃ এটাই যে, দুনিয়ার মানুষ যেন এ কথাই গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে, দাইয়্যূস আল্লাহ্ পাক ও তার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এতই ঘৃণার পাত্র, অপছন্দের পাত্র যে সে যত বড়ই আবেদ আর আলিম দাবীদার হয়ে থাকুন না কেন সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। অর্থাৎ সে হবে জাহান্নামী। “যে আমার নামে মিথ্যা কথা বলল সে যেন দুনিয়াতেই তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।” এ হাদীছ শরীফের মত দাইয়্যূস ব্যক্তিও দুনিয়াতেই চিহ্নিত, ঘোষিত ও স্বীকৃত জাহান্নামী ব্যক্তি।
কাজেই এরূপ জাহান্নামী ব্যক্তিই যদি শাইখুল হাদীস, মাওলানা, মুফতী মুফাস্সিরে কুরআন আর খতীব পরিচয়ে থাকে তবে কি তারা অনুসরণীয় পাত্র, শ্রদ্ধার পাত্র থাকতে পারে? আল্লাহ্ পাক ও তার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি বিশ্বাস রাখার কারণেই বা যে কুরআন সুন্নাহ স্বীকার করার কারণেই আমরা মুসলমান দাবী করি; সে কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে যে দাইয়্যূস প্রকাশ্য জাহান্নামী, ঈমানের দাবীর ফলেই যে সে আমাদেরও ঘৃণার পাত্র হওয়ার যোগ্য তা বলাই বাহুল্য।
-মুহম্মদ তারীফুর রহমান, ঢাকা।