এখন আখিরী যামানা। এ যামানায় সবই সম্ভব। এ সব সম্ভবের সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে কথিত ‘গণতন্ত্র’ ও গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন পদ্ধতি। গণতন্ত্রে আইন সভা সার্বভৌম। আর এ সার্বভৌম আইন সভা আল্লাহ পাক এবং তাঁর রসূল আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে পারে। ইসলামের উপর আঘাত হানতে পারে। ইসলামী বিধি-বিধানের উপর হুকুম জারি করতে পারে। এই আইন সভা ইসলামী আইনকে প্রতিস্থাপিত করে সেখানে অনৈসলামী আইন জারি করতে পারে। গণতান্ত্রিক আইনসভা নমরূদ-ফিরআউন বা তার চেয়েও বেশী এতটাই শক্তিশালী। প্রসঙ্গতঃ ইংল্যান্ডের আইন সভাকে বলা হয় যে, এটা স্বামীকে স্ত্রী আর স্ত্রীকে স্বামী বানানো ছাড়া অর্থাৎ ছেলেকে মেয়ে বা মেয়েকে ছেলে বানানো ছাড়া আর সবকিছু করতে পারে। বলাবাহুল্য, গণতন্ত্রের এই সব কিছু করার ক্ষমতা তথা সব সম্ভবের ধারা এতই প্রবল যে, যারাই এ মিছিলে যোগ দেয় তারাই সেরূপ মানসিকতার হয়। এমনকি ইসলামের লেবাসধারী যারা রয়েছে তারাও যখন ইসলামের নামে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শরীক হয় তাদের দ্বারাও তখন সব অসম্ভব সম্ভব হয়। ইসলামের লেবাসে থাকলেও তাদের দ্বারাই তখন খোদ ইসলামের উপর আঘাত হানাও সম্ভব হয়। তাদের দ্বারাও ইসলামের বিপক্ষে তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়। ইসলাম বিরোধি আইন প্রণয়নে প্রচেষ্ট হওয়া সম্ভব হয়। উল্লেখ্য, মোগল রাজত্বের সময় মুসলিম আইন সর্বত্র ব্যবহৃত হত। বিট্রিশ আমলেও প্রথম দিকে পূর্ব প্রচলিত রীতি অনুযায়ীই চলে। এবং তখন হানাফী আইন মোতাবিক দেওয়ানী এবং ফৌজদারী আদালত ব্যবহৃত হতে থাকে। পরবর্তীকালে ইংরেজগণ ৗটথলফর্টধমভ ১১ মত ১৭৭২ দ্বারা এবং ৗটথলফর্টধমভ মত ১৭৮০ দ্বারা এর ক্ষেত্রকে সীমিত করলেও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন দেওয়ানী আদালতে চলতে লাগলো। অতঃপর এই উপমহাদেশে মুসলিম আইন নানাবিধ বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়। প্রসঙ্গতঃ ১৯৩৬ সালের ওদটলধটদ ইর্ড এ বলা হয়, “বিপরীতমূখী কোন রেয়াজ, রীতি অথবা প্রথা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর পাওনা, কোন চুক্তি অথবা দানপত্রের মাধ্যমে কিংবা ব্যক্তিগত আইনের যে কোন ব্যবস্থায় প্রাপ্ত অথবা গৃহীত ব্যক্তিগত সম্পত্তিসহ মহিলাদের বিশেষ সম্পত্তি, বিবাহ, তালাক, –, জিহার, লিয়ান, খুলা ও মুবা বিবাহসহ বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণ-পোষণ, যৌতুক, অভিভাবক্ত, দান ট্রাস্ট ও ট্রাস্ট সম্পত্তি এবং ওয়াক্ফ যাবতীয় ক্ষেত্রে মুসলমান বাদী-বিবাদীর মকদ্দমায় মীমাংসার মাধ্যম হিসাবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি কার্যকরী হবে।” উল্লেখ্য, খ্রীষ্টান বিট্রিশ সরকার মুসলিম আইনের প্রতি যতটুকু প্রতিশ্রুতিশীল ছিল পরবর্তীতে অনেক মুসলিম সরকারও মুসলিম আইনের প্রতি ততটুকু শ্রদ্ধা ও আস্থা ব্যক্ত করেনি। তা জারি রাখেননি। ১৮৯৪ সালে আব্দুল ফাতাহ বনাম রাসময় একটি মামলার উদ্ভব হয়। মামলাটি ছিল ওয়াক্ফ নিয়ে। ব্রিটিশ সরকার যেহেতু ইসলাম সম্পর্কে প্রাজ্ঞ ছিলোনা সেহেতু তারা মনে করেছিলো যে, পরিবার এবং বংশধরদিগের কল্যাণের সঙ্গে কৃত ওয়াক্ফ বৈধ নয়। বিবৃত মামলায় যে ওয়াকফের বিচার হয়েছিলো তাতে এই ছিল যে, ঐ ওয়াকফের স্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফের সন্তান-সন্ততিগণ বংশ পরস্পরা ভোগ করবে এবং যদি শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ জীবিত না থাকে তাহলে তা বিধবা, ইয়াতীম, ভিক্ষুক এবং দরিদ্রের সেবায় ব্যয়িত হবে। কিন্তু যেহেতু এই ওয়াকফে নিজস্ব পরিবার, সন্তানের কথা বলা হয় সেহেতু ব্রিটিশ সরকার তা বুঝতে অসমর্থ হয়। পরবর্তীতে যখন তাদের কাছে এই হাদীছ শরীফ পেশ করা হয় যে, দান-খয়রাতের শ্রেষ্ঠ খাত হলো নিজস্ব পরিবার তথা আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করা। তখন ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল সে হাদীছ শরীফ মেনে নেয়। এবং ১৯১৩ সালে নতুন করে ওয়াক্ফ আইন বিধিবদ্ধ হয় এবং শর্ত সেখানে সংরক্ষিত হয় যদ্বারা বংশধরদের জন্য কল্যাণের জন্য বৈধভাবে ওয়াক্ফ করতে সমর্থ হয়। এ এক তাৎপর্যযুক্ত ঘটনা। এর মধ্যে নছীহতের অবকাশ আছে। এর মধ্যে মানদ-ের তুলা রয়েছে। খোদ বৃটিশও মুসলমানদের ধর্মীয় আইনকে পরিবর্তন করেনি। না বুঝে মন্তব্য করলেও যখন তাদের কাছে হাদীছ শরীফ পেশ করা হয়েছে তখন তারা মেনে নিয়েছে। দু’শ বছরেও বেশী সংগ্রম করার পর আমরা বৃটিশের বিরুদ্ধে আযাদী লাভ করেছি। ধর্মের নামে অধর্ম করার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান থেকেও জুদা হয়েছি। লাভ করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আলহামুদিল্লাহ্। কিন্তু দুঃখ যে, এতকিছুর পরও এদেশে মৌলিক কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও এদেশে বৃটিশ প্রদত্ত ১৮৬০ সালের ফৌজদারী আইন ও ১৯০৮ সালের দেওয়ানী আইনই চলছে। অথচ কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান, “যারা আল্লাহপাক-এর আইন ছাড়া অন্য আইন চালু করে তারা ফাসিক, জালিম, কাফির।” এতদ্বপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করেন তাদের প্রধান প্রচারনা হলো যে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ঐসব অনৈসলামী আইন, পরিবর্তন করবেন। সবক্ষেত্রে ইসলামী আইন জারি করবেন। মূলতঃ এ প্রচারণার পাশে একটা কথা খুব শক্তভাবে এসে যায়। তা হলো যে দেশে বিরাজমান যে সব ইসলামী আইন রয়েছে সেগুলো পরিবর্তনের প্রশ্নই উঠেনা বরং যেগুলো অনৈসলামী রয়েছে সেগুলো তারা ইসলামী করবেন। ইসলামের নামে যারা গণতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন এটাই তাদের মোদ্দাকথা। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রকে ধোকাবাজদের সরকার বলা হয়ে থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে ইসলামের নামে যারা দলভিত্তিক রাজনীতি করেছেন তারাও কঠিন ধোকাবাজদের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। অথচ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে বা যারা ধোকা দেয় সে বা তারা আমার উম্মত নয়।” এদেশের সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতায় গেলে কি করবে তার প্রতিশ্রুতি দেয়। যাকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বলে। বলাবাহুল্য, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন নিয়ে সব সাধারণ রাজনৈতিক দলেরই সমালোচনা রয়েছে তারা কেউ পুর্ণ প্রতিশ্রুতি পালন করেন না। তবে একেবারেই ফাঁকা কেউ যাননি বা যান না। এক্ষেত্রে ৪০%, ৫০%, ৬০% …. ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন মন্তব্য শোনা যায়। তবে যে কথা এযাবত তাদের ক্ষেত্রে শোনা যায়নি তাহলো যে তারা আজ পর্যন্ত কেউ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুরো পালন না করলেও অন্ততঃ প্রতিশ্রুতি পালনের বিপক্ষে যাননি। চাকরির কোটা বাড়াতে না পারলেও কমাননি। কিন্তু ইসলামের নাম বেসাতীকারী তথাকথিত ইসলামিক দলগুলো তাই করছে। তারা নির্বাচনের প্রাক্কালে আল্লাহ পাক-এর আইন কায়েমের যে প্রচারণা চালিয়েছিলো আজ আল্লাহ পাক-এর আইন চালুর পরিবর্তে উল্টো যা চালু ছিলো তাও রহিত করছে। যে কাজ বৃটিশ করেনি, যে কাজ জালিম পাকিরাও করেনি, আইয়ূব খানও করেনি সে কাজ আজ তারা করছে। অথচ নির্বাচনের পূর্বে তারাও আইয়ূব খানের তালাক আইন, মীরাস আইনের সমালোচনা করেছিলো। আইয়ূব খান প্রণীত তিন তালাক দিলে তালাক হয়না- এই আইনের সংশোধন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। অথচ আজ তার সংশোধন তো দূরের কথা বরং তালাকের ক্ষেত্রে আরো এক অনৈসলামী বিধান তারা বিধিবদ্ধ করতে যাচ্ছে। গত ২৪শে সেপ্টেম্বর/২০০৪ পত্রিকান্তরে বলা হয়, “নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশ সরকার দেশে প্রচলিত বিবাহ আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন আইনে বাংলাদেশের নারীরাও পারিবারিক আইনে তালাক দেয়ার অধিকার পাবে।” (সব জাতীয় দৈনিক) উল্লেখ্য, ইসলামে নারী নেতৃত্ব নাজায়িয হলেও জোটভুক্ত তথাকথিত ইসলামী দলগুলো এ সমর্থন করেছেন এই বলে যে, তার মাধ্যমে তারা দেশে পর্যায়ক্রমে ইসলামী আইন জারি করবেন। কিন্তু জোট সরকারের তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পরও তারা পূর্ব আলোচিত বিয়ে, তালাকের আইনের ক্ষেত্রেও কোন চাপ তৈরী করেননি এবং দৃশ্যমান কোন প্রতিবাদও জানাননি। এমনকি সরকারের তরফ থেকে সদ্য যা বলা হলো, তার কোন প্রতিবাদও তারা জানালেন না। কোন বক্তব্য বিবৃতিও তারা দিলেন না। অথচ তথাকথিত শাইখুল হাদীছ, মুফতী, মাওলানা, মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির ও খতীব হবার সুবাদে তাদের জানা রয়েছে, “যে যার সাথে চলে তার কাজের দায়ভারও সমানভাবে প্রযোজ্য হয়।” তাদের আরো জানা রয়েছে যে, “কোন অন্যায় দেখলে যারা প্রতিবাদ করেনা তারা বোবা শয়তান।” উল্লেখ্য, সরকারের প্রচলিত সব অনৈসলামী আইনের প্রতিবাদ জানাবেন- এটাই ইসলাম নামধারী দলগুলোর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, তাদেরকে মন্ত্রীত্ব কেন দেয়া হচ্ছেনা অথবা তাদেরকে না বলে মন্ত্রণালয় কেন পরিবর্তন করা হলো, শক্তিশালী মন্ত্রণালয়ের চেয়ে দুর্বল মন্ত্রণালয় দেয়া হলো এসব রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুন্নের ব্যাপারেই তারা প্রতিবাদমুখর রয়েছেন। ইসলামী আইন জারি, অনৈসলামী আইন বন্ধ বা নতুন অনৈসলামী আইনের প্রতিবাদে তাদের আদৌ কোন তৎপরতা নেই। ইসলাম রক্ষার চেয়ে তারা এখন সরকার প্রধানের মন রক্ষায়ই বেশী সচেষ্ট। তারা ভাবছেন, তালাকের নতুন আইনের প্রতিবাদ জানালে বুশের নেক নজর থেকে সরকার বঞ্চিত হতে পারে। আর সরকারের বিচ্যুতি হলে তাদের বর্তমান বখরা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কিনা শুধু সরকার নয় বুশই আজকে তাদের খোদা হয়ে গেছে। তাই সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তালাকের নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় তারা এতটা নিশ্চুপ হয়ে আছে। অথচ এটা যে মুসলমানদের ধর্মের সম্পূর্ণ খেলাফ, সে সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকেও বলা হয়েছে। পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, “এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রচলিত যে পারিবারিক আইন আছে সেটা ধর্মভিত্তিক এবং সেটা পরিবর্তন করতে গেলে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বলে সরকার এতদিন বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বলে জানালেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী বেগম খুরশীদ জাহান হক।” উল্লেখ্য, ধর্মভিত্তিক এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বলে যে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে, বৃটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের এযাবতকালের সরকার। কিন্তু বর্তমান জোট সরকার তা কার্যকর করতে চাইছে কোন খুটির বলে? মূলতঃ এরা হচ্ছে তার অন্তর্ভুক্ত নামধারী শাইখুল হাদীছ, মুফতী, মাওলানা, মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির তথা খতীব গং। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারা সবই সম্ভব। ইসলামকে এরা রাজনৈতিক হাতিয়ারূপে ব্যবহার করছে মাত্র। নির্বাচনের পূর্বে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও আজ সে প্রতিশ্রুতি পালনে তারা যে ব্যর্থ হচ্ছে তাই নয়। বরং সে প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে এখন তারা কাজ করছে। তারাই এখন দেশে বিদ্যমান সীমিত কিছু ইসলামী আইন তুলে দেয়ার সহায়ক শক্তিরূপে প্রতিভাত হচ্ছে। হায়! আখিরী যামানা। -মুহম্মদ ওয়ালীর্উ রহমান, ঢাকা।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর ছবি তোলা, রাখা, আঁকা, দেখা হারাম’ মুজাদ্দিদে আ’যমের অনবদ্য তাজদীদ