বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম স্লোগান হলো “বিদ্যুৎ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়”। তাই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই অধিকাংশই আত্মঘাতি। গত পরশু প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের সচেতন মহল জানিয়েছে, সরকার দেশকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে গিয়ে দেশের পরিবেশ প্রাকৃতি ও জনসংখ্যাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে গত ২৬ জুলাই ২০১৬ রাশিয়ার সাথে ঋণচুক্তি করেছে সরকার। সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার ঋণ, প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ সহায়তার উপর নির্ভর করে বিপুল ব্যয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে সচেতন ও বিশেষজ্ঞ মহলে বহুদিন ধরেই উদ্বেগ বিরাজ করছে। মূলত ৪টি কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি উঠেছে। প্রথমত, এর বিপুল ব্যয় ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বারবার ব্যয়বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ান কোম্পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও দেশে দক্ষ জনবলের ঘাটতি। তৃতীয়ত, তেজস্ক্রিয় দূষণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। চতুর্থত, বিদুৎকেন্দ্রে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট। এছাড়াও এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের উচ্চ দামও একটা আপত্তির বিষয়। এসব আপত্তি উপেক্ষা করেই ক্ষমতাসীন সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চালাচ্ছে সমানতালে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কতটুকু নিরাপদ পারমাণবিক বিদ্যুতের কথা ভাবলে প্রথমেই যে বিষটি সামনে চলে আসে তাহলো- এর নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত বিষয়সমূহ। বিজ্ঞানের যেকোনো আবিষ্কারই এক ধাক্কায় সফলতার মুখ দেখে না এবং সে কারণেই প্রতিটি প্রযুক্তিই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিখুঁত ও নিরাপদ হতে থাকে। প্রযুক্তি এবং আর্থিক সামর্থ্যে অগ্রসর দেশগুলো পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দেশই পরমাণু জ্বালানির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা রাশিয়ার উপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করে দেবে। কেননা শুধু রাশিয়ার প্রযুক্তি সহায়তাই নয়, বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য যে কাঁচামাল দরকার হবে (ইউরেনিয়াম), তার সরবরাহ নিশ্চিত করার এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য নেয়ার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সব সময় রাশিয়ার প্রতি ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। ফলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতেও সরকার রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না।
তেজস্ক্রিয়তা ছড়াবে পানিতে, গ্রাস করবে গোটা দেশ
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বর্জ্য নিষ্কাশনের সমস্যা ছাড়াও আর অনেক সমস্যা আছে। পারমাণবিক চুল্লিকে ঠান্ডা রাখার জন্য তাকে ঘিরে ঠান্ডা পানির প্রবাহ চালানো হয় (জাপানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল ওই পানি দিয়ে ঠান্ডা করার প্রযুক্তি বা কুলিং সিস্টেম অচল হয়ে পড়ায়)। জাপানের ফুকুশিমা ও আমেরিকার থ্রি মাইল আইল্যান্ডের ঘটনায় আমরা জানি তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পানি আশপাশের নদী-সাগরের পানির প্রবাহের সাথে মিশে বিস্তীর্ণ এলাকার, এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের জনগণকেও বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝে ফেলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, হঠাৎ করেই জাপানের মতো পরিণতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সেইসাথে পারমাণবিক বর্জ্য মাটির নীচে পুতে রাখতে পানি বায়ু উভয়ই ভয়ানকভাবে দূষিত হয়। ফলে এসব বর্জ্য লোকালয় ব্যতিত জায়গায় পুতে রাখতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এমন কোনো পরিত্যক্ত জায়গা নেই যেখানে এই বর্জ্য পুতে রাখা যাবে। আর এ নিয়ে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের কোনো চুক্তিও হয়নি। ফলে এ নিয়ে থেকে গেছে ধোয়াসা।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি সহজলভ্য?
হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, একই ক্ষমতার একটা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় পুঁজির চেয়ে একটা পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় পুঁজির পরিমাণ আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আবার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যত খরচ হয়, তার আয়ু শেষ হওয়ার পর তা নিরাপদে ভেঙে ফেলতে খরচ পড়ে নতুন চুল্লি বসানোর খরচের প্রায় সমান। অর্থাৎ খাজনার চেয়ে ব্যয় বেশি।
এখন কেউ যদি নিরাপত্তা ও ভাঙার খরচ বাদ দিয়ে শুধু নির্মাণ ব্যয়টাকেই দেখায় তাহলে সেটা হবে একটা নির্জলা মিথ্যাচার ও প্রতারণা।
এমনিতেই উচ্চমূল্যের এ পরমাণু বিদ্যুৎ আমাদের মতো দুর্নীতি-লুটপাটে আক্রান্ত দেশে আরো দামী হয়ে ওঠে। যেমনটা রূপপুরের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা)। এরপর শোনা গেল এতে ব্যয় হবে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার বা ২৪ হাজার থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই কয়েক ধাপে ব্যয় বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত ব্যয় এসে ঠেকেছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। এই ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কে বলতে পারে?
বলাবাহুল্য, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে এত আশঙ্কা ঘনীভূত হলেও সরকার পক্ষ মনে করছে- ‘এতে আশঙ্কার কিছু নেই’। বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালন ও রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক বলেছে- ‘এতে আশঙ্কার কিছু নেই’। কিন্তু সরকারের এই চিড়েভেজা বার্তায় আশঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা তা বলছেনা। যেভাবে অতীতে বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে অবহেলা এবং ব্যয় বাড়তে দেখা গেছে, সেই পরিণতি রূপপুরের হলে জাতিকে নিশ্চয়ই মস্তবড় মাশুল দিতে হবে।
যে কোন বিচারেই এটি একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। কারণ এই প্রকল্প ঘিরে রয়েছে অনেক ধরনের আশঙ্কা। আর এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করে যে আমরা বৈদ্যুতিক খাতে সক্ষম হবো তারো কোন আশা নেই। এই কেন্দ্রের বর্জ্যগুলো কোথায় যাবে সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর বর্জ্য তেজস্ক্রিয় এবং এটা ভয়ংকর। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিপদ রয়েছে। বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো এ থেকে বেরিয়ে আসছে। কারণ এই বিপদ মোকাবেলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর আমাদের দেশে যদি এর কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তা থেকে বেরিয়ে আসতে নানা ভয়ঙ্কর দুর্দশার মুখোমুখি হতে হবে।
কাজেই সরকারের উচিত, দেশের স্বার্থ ও এই প্রকল্পের বিপজ্জনকতার কথা বিবেচনা করে তা বাতিল করা। নাহলে এই প্রকল্প দেশের জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে। তাই দেশবাসীরও উচিত- এটিকে প্রতিহতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩৪
চাঁদ দেখা এবং নতুন চন্দ্রতারিখ শুরু নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা- ১
কোকাকোলা ও অন্যান্য কোমল পানীয় সম্পর্কে উন্মোচিত সত্য-১৮
কট্টর কমুনিস্ট মাওসেতুং এর নতুন ভাবশিষ্য ফুলতলীর লংমার্চ এবং তার শরয়ী পর্যালোচনা ও প্রসঙ্গ কথা