ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮০)

সংখ্যা: ১৩২তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালিম

পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থানের আদব     

প্রসঙ্গ : দরবার শরীফের প্রত্যেকটি বিষয় এবং বস্তুর প্রতি ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব সর্বদা বজায় রাখা। হযরত বিশর হাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি। যিনি “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” লিখিত এক টুকরা কাগজকে সম্মান-ইজ্জত করার কারণে আল্লাহ পাক-এর মাহবুবে পরিগণিত হলেন। এতদিন যিনি ছিলেন সকল নাজায়িয-হারাম কাজে জড়িত এখন তিনি হলেন সর্বপ্রকার নেক কাজের সাথে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট।

পক্ষান্তরে ইল্ম ও আলিমের প্রতি যখন মুহব্বত, তা’যীম-তাকরীম উঠে যায়, শিক্ষাপোকরণের হুরমত-ইজ্জতের প্রতি লক্ষ্য থাকে না, তখনই তার ইল্ম হয় বরকত শূন্য। অর্থাৎ সে ইল্মের দ্বারা ফায়দা হাছিল করতে পারেনা। আস্তে আস্তে ইল্ম তার থেকে সলব হয়ে যায়। আর যখন আলিম তথা উস্তাযের অবাধ্য হয় কিংবা বিদ্বেষ পোষণ করে তখন ইল্ম ও হিকমত হতে চির বঞ্চিত হয়ে যায়।

 আর ইল্মে তাসাউফ? যার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধি হয়। আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত-মুহব্বত হাছিল হয়। তায়াল্লুক মায়াল্লাহ (আল্লাহ পাক-এর সাথে সম্পর্ক) তায়াল্লুক মার্য়া রসূল (আল্লাহ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে সম্পর্ক) পয়দা হয়। পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর নেক দৃষ্টি, ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ ব্যতীত যা হাছিল করা সম্ভব নয়। সেই ইল্মে তাসাউফ যিনি শিক্ষা দেন সেই পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর প্রতি কতটুকু মুহব্বত রাখতে হবে, সুধারণা পোষণ করতে হবে, তাঁর তা’যীম-তাকরীম করতে হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর সেই  ইল্ম যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়া হয় সেই প্রতিষ্ঠান তথা দরবার শরীফ ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় এবং বস্তুর কতটুকু হুরমত-ইজ্জত বজায় রাখতে হবে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়েনা। অর্থাৎ ইল্মে লাদুন্নী (আল্লাহ পাক কোন মাধ্যম ব্যতীত যে ইল্ম দান করেন) হাছিল করা তথা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি ছাত্র হওয়ার জন্য কি পরিমাণ যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। কতটুকু আদব বা শিষ্টচারিতা থাকা অপরিহার্য তা ফিকির যোগ্য। মূলতঃ দরবার শরীফের প্রত্যেকটি বিষয় এবং বস্তুর প্রতি ভদ্রতা, নম্রতা, বিনয়ভাব বজায় রাখা মুরীদের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত। যুগে যুগে আওলিয়ায়ে কিরামগণ স্বীয় মুরীদ-মুতাকিদীনগণকে সেই বিনয়-নম্রতা হাছিলের জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং তা হাছিলের উপায়ও বলে দিয়েছেন।

ইমামে রব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি জনৈক মুরীদকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, “আমি আপনার আরও উচ্চ মর্তবা লাভের আশা করেছিলাম। আল্লাহ পাক যা কিছু দান করেন, আদব ও অনুগ্রহ ভেবে তা গ্রহণ করা উচিত এবং বিনীত ও বিনম্র হয়ে কান্নাকাটি করে উচ্চ মাকাম প্রার্থনা করা দরকার। শিশুদের মত আখরোট ও মুনাক্কা পেয়ে ভুলবেন না। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উচ্চ মনোবৃত্তিধারীগণকে ভালবাসেন।” (মাকতুবাত শরীফ)

  ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী একদা জিজ্ঞাসিত হলেন যে, ‘কিভাবে এরূপ বিনীত-বিনম্র হওয়া যাবে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বীয় পীর ছাহেবের প্রতি সু-ধারণা রেখে ছোহবত ইখতিয়ার এবং বেশি বেশি যিকির-ফিকির করলে বিনীত-বিনম্র হতে পারবে।’

আল্লাহ পাক যামানার মহান ইমাম ও মুজাদ্দিদ-এর উছীলায় আমাদেরকে সেই বিনয়, নম্রতা বজায় রাখার তাওফীক দান করুন। (আমীন)  ১৬। দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখবে। দরবার শরীফের আমানতসমূহের কখনও খিয়ানত করবে না।      সব বিষয়ের আমানত রক্ষা করা দরবার শরীফের অন্যতম আদব। মনে রাখতে হবে যে, পেঁচা কখনো সূর্যের আলো দেখতে পায়না। তেমনি সাধারণ মানুষও কখনো আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুপ্ত মা’রিফাত-মুহব্বতের রহস্যসমূহ উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ পাক বলেন,

ولقد ذرانا لجهنم كثيرا من الجن والانس لهم قلوب لايفقهون بها ولهم اعين لايبصرون بها ولهم اذان لايسمعون بها اولئك كالانعام بل هم اضل اولئك هم الغفلون.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই অনেক জ্বিন ও ইনসান রয়েছে যারা জাহান্নামে যাবে। তাদের অন্তর আছে কিন্তু অনুধাবন করতে পারেনা, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা দেখতে পায় না, তাদের কান আছে তা দ্বারা শুনতে পায়না। এই সমস্ত লোকেরাই হচ্ছে চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বরং তারা তার চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট। আর এরাই হচ্ছে গাফিল বা অমনোযোগী।” (সূরা আ’রাফ/১৭৯) এই গাফিল শ্রেণীর লোক কখনও আল্লাহ পাক-এর মারিফাত-মুহব্বতের বিষয় উপলব্ধি করতে পারবে না।     আওলিয়ায়ে কিরাম তথা পীর ছাহেবগণের দরবার শরীফ আল্লাহ পাক-এর মা’রিফাত-মুহব্বতের গুপ্ত রহস্যে পরিপূর্ণ। সুতরাং তার আমানত রক্ষা করা সকলের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। উল্লেখ্য যে, পীর ছাহেবের দরবার শরীফের আমানতের খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণে অতীতে অনেকেই বাতিনী নিয়ামত হতে বঞ্চিত হয়েছে, বর্তমানেও অনেকে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। মূলতঃ আমানতদার হওয়া মু’মিন-মুত্তাক্বীগণের বিশেষগুণ। হাক্বীক্বী মুসলমানের আলামতও বটে।  কেননা, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لا ايمان لمن لا امانة له.

অর্থঃ- “যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই।”(দাইলামী, ক্বাবাস/২৪১) তিনি আরো বলেন,

ثلاث من كن فيه فهو منافق وان صام وصلى وزعم انه مسلم اذا حدث كذب واذا وعد اخلف واذا ائتمن خان.

অর্থঃ- “তিনটি স্বভাব যার মাঝে বিদ্যমান সে মুনাফিকের অন্তর্ভুক্ত। যদিও সে রোজা রাখে, নামায পড়ে এবং মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়ঃ ১. যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, ২. ওয়াদা করলে খিলাফ করে, ৩. আমানত রাখলে খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) করে।” (তাফসীরে বায়যাবী ২/২৪৪) উল্লেখ্য যে, আমানতের খিয়ানত করাকে মুনাফিকের আলামত বা নিদর্শন বলে অভিহিত করা হয়েছে।           আর মুনাফিক (কপটচারী) কখনও আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত, রেযামন্দি-সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারে না। কাফির-মুশরিকের চেয়েও নিকৃষ্ট হচ্ছে মুনাফিক। কাফির-মুশরিকের চেয়ে বেশী শাস্তি হবে মুনাফিকদের। জাহান্নামের সর্বনিম্নে স্থান হবে তাদের।  এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,

ان المنفقين فى الدرك الاسفل من النار ولئ تجد لهم نصيرا.

অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। আর তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবেন না।” (সূরা নিসা/১৪৫)        কাজেই নিফাক বা কপটতা হতে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত থাকা এবং সর্বক্ষেত্রে আমানতদার হওয়া বা আমানত রক্ষা করা মুরীদ বা সালিকের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।  আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

يايها الذين امنوا لاتخونوا الله والرسول وتخونوا امنتكم وانتم تعلمون.

অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাক এবং তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে খিয়ানত করনা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তোমাদের পরস্পরের মাঝে রক্ষিত আমানতেরও খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) করোনা।” (সূরা আনফাল/২৭)

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৮)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)

   ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮) 

  ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮২)