সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলাম ও মুসলমানের জন্য মুনাফিকদেরকে সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ কাফির, মুশরিক তথা ইহুদী-খ্রিস্টান, হিন্দু-বৌদ্ধ এদেরকে প্রকাশ্যেই চেনা যায়। এদের শত্রুতা দেখা যায়। ফলতঃ এদের আক্রমণকে সহজেই প্রতিহত করা যায়। কিন্তু মুনাফিক ইসলামের লেবাসে থাকে। মুসলমানের মাঝে মুসলমানদের বেশে থাকে। তারা মুসলমানের মাঝে থেকেই মুসলমানের প্রভূত ক্ষতি করার অবাধ সুযোগ পায়। তদ্রুপ ধর্মের নাম ব্যবহার না করে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা যে ইসলামী দল নয় তা সাধারণভাবেই বোঝা যায়। কিন্তু ধর্মের লেবাসে যেসব তথাকথিত ইসলামী দল রয়েছে তারা যে সম্পূর্ণ অনৈসলামী তা বোঝা সাধারন মানুষের জন্য খুবই দায়। কুরআন সুন্নাহয় নির্বাচনকে সমর্থন করা হয়নি। কিন্তু তারা পরেও তথাকথিত ইসলামী দলগুলো ইসলামের নামেই ইসলামী দলের ব্যানারে নির্বাচন করে যাচ্ছে। অথচ তারা যে ইসলামের অনুসারী দাবীদার সে ইসলামে নির্বাচন সমর্থন করে না আদৌ। অর্থাৎ তারা প্রচলিত নির্বাচন চলমান রাজনীতির বাহক হতে পারে কিন্তু ইসলামী আদর্শের ধারক বা প্রতীক হতে পারে না। কোন মাওলানা দাবীদারদের জন্য দাড়ি-মোচ চেছে সিনেমা হলে যাওয়া যেমন বেমানান তেমনি মাওলানা, মুফতী তথা পীর দাবী করে ইসলামের নামে নির্বাচন করাও তার চেয়ে বেশী বিসদৃশ বা বেখাপ্পা তথা খারাপ। নির্বাচনকে বলা হয় সংবিধান নির্দেশিত নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া। এ দিক থেকে বাংলাদেশের তাবত নামধারী ইসলামিক দল নিজেদেরকে বাংলাদেশ সংবিধানের আজ্ঞাবহ দাস তথা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে প্রতিভাত করে থাকেন। তারা নিজেদেরকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির তল্পীবাহক তথা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দাবী করে থাকেন। তারা যদি এই দাবীতে সত্য প্রমাণিত হতেন তাহলে কাজটি শরীয়তের খিলাফ হলেও তারা ফাসিকেরতবকায়ই সীমাবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু তারা যখন দাবীতে এক আর কাজে ভিন্ন প্রমাণ করেন তখন প্রমাণিত হয় যে, তারা আবারো মুনাফিকী করছেন। উল্লেখ্য, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ২০ (১) ধারায় বলা আছে- কোন ব্যক্তিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হাসিলের জন্য ধর্মভিত্তিক বা ধর্মের নামে গঠিত কোন সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোন সংঘ বা ইউনিয়ন গঠন করতে বা এর সদস্য হতে বা অন্যভাবে এর তৎপরতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।’’
সংশ্লিষ্ট ধারার আগের অংশটিতে অর্থাৎ ১৯ (১) ধারায় বলা আছে, ‘‘এ ধারায় বর্ণিত ‘সংঘ’ (শব্দ) ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করে।’’ এই আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫-এর পরবর্তীকালে এর প্রয়োগের কোনো উদ্যোগ কখনো নেয়া হয়নি। এমনকি আশির দশকের প্রথমার্ধ্বে পুলিশের একজন শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা আইনটির প্রতি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। এরপর থেকে বহুল পরিচিত ও আলোচিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট অংশটির প্রতি দৃষ্টি দিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বড়কর্তারা পর্যন্ত ভয় পান। অথচ সরকার বিনা বিচারে আটক রাখা ছাড়াও বিভিন্নভাবে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ ব্যবহার করে চলেছে।সচিবালয়, বঙ্গভবন, বন্দর, প্রধানমন্ত্রীর দফতর, সংসদ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এসব এলাকায় জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত প্রতিহত করতে আইনটির ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ আইনের ক্ষমতাবলেই সরকার বিভিন্ন সময়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে ধ্বংসাত্মক বিবেচনা করলে নিষিদ্ধ করে। অর্থাৎ আইনটি সরকার কিংবা সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টির আড়ালে পড়ে থাকা কোনো আইন নয়। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে ব্যবহারের ধারাগুলো উপেক্ষা করে আসা হয়েছে। আইনটিকে পরীক্ষা করে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন- সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পরও এটা একটি বলবৎ আইন। সংবিধানসম্মত এ আইনটির অস্তিত্ব থাকার পরও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার দাবিতে যারা সোচ্চার তারাও কখনো আদালতের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য অগ্রসর হননি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেআইনি কাজ যাতে চলতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা ওই আইনেই সরকারকে দেয়া আছে। কিভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং কি শাস্তি হবে সে কথাও আইনে উল্লেখ আছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক তৎপরতা বা ধর্মীয় জঙ্গী সংগঠন প্রতিহত করতে কোনো নতুন আইন তৈরীর প্রয়োজন নেই।
আইনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ধর্মভিত্তিক বা ধর্মের নামে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন গঠন করা হলে সরকারের করণীয় সম্পর্কিত নির্দেশ বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ (১) ধারায় এভাবে রয়েছে, ‘‘যে ক্ষেত্রে সরকার সন্তুষ্ট হন যে, (১) উপ-ধারার বিধান লঙ্ঘন করে সংঘ বা ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে, বা সংঘ বা ইউনিয়ন কাজ চালাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বক্তব্য শ্রবণের পর সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা করবেন যে, তেমন সংঘ বা ইউনিয়ন (১) উপ-ধারার বিধান লঙ্ঘন করে গঠন করা হয়েছে, বা বিধান লঙ্ঘন করে চালানো হচ্ছে; এবং এ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট সংঘ বা ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে বলে গণ্য হবে; এবং এর সমস্ত সম্পত্তি ও তহবিল সরকারের বাজেয়াপ্ত হবে।’’ এরপরও যদি কেউ এ ধরনের কোনো দল বা সংগঠনের কাজ অব্যাহত রাখে, আইনে তার শাস্তির বিধানও রাখা আছে। ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘উপ-ধারা (২) অনুসারে একটি সংঘ বা ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেয়ার পর যদি কোন ব্যক্তি সে সংঘ বা ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিতি করেন, বা তেমন সংঘ বা ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করেন, তাহলে তিনি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে উভয় উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’’ বিশেষ ক্ষমতা আইনের কিছু অংশ বিভিন্ন সময়ে সংশোধন করা হলেও এই ধারা এখনো বলবৎ রয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন হিসেবে এর জন্য বিধানগুলো সরকার প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা সত্ত্বেও এই বিধানটির প্রতি দৃষ্টি না দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারা একত্রে যুক্ত করে পড়লে অবশ্যই ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বাংলাদেশে থাকতে পারে না। ধর্মের ভিত্তিতে বা ধর্মীয় চিন্তায় কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্রে এ আইনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ইসলামের নামে সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই এ প্রতিবন্ধকতা প্রযোজ্য। সরকার ওই আইনের ২০(২) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকি সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার পরও যদি কেউ এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো দায়িত্বে থাকে, তার অপরাধ আমলযোগ্য। সংশ্লিষ্ট আইনের ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হবে এবং সে শাস্তি পাবে।
উল্লেখ্য, বাস্তবে এ ধরনের সংগঠন পরিচালনা করে প্রচলিত আইন লঙ্ঘনের দায়ে কারাগারে যাওয়ার পরিবর্তে অনেকেই এখন রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে রয়েছেন। বেআইনী এই তৎপরতা বছরের পর বছর চলতে থাকায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়াও এখন দেশে ধর্মের নামে সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদী সংগঠনও বিপজ্জনকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এ অবস্থা মোকাবেলায় নতুন কঠোর আইন প্রণয়নের কথা প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন।অথচ দ-বিধি ছাড়াও অনুরূপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনার্থে ধ্বংসাত্মক সংগঠন মোকাবেলার আইন বলবৎ রয়েছে।
অপরদিকে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যতঃ জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী নয় বলে গর্বকারী এবং বাংলাদেশে প্রচলিত গণতন্ত্রের আদর্শবাদী ও সংবিধানের আজ্ঞাবহ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলনকারী বলে ঢাকঢোল প্রচারকারী। তাদের প্রচারিত ও দাবীকৃত সে নীতিমালার আঙ্গিকেই তাহলে তাদের এক্ষনি ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি তথা ধর্মভিত্তিক দল বা ধর্মের নামে রাজনীতি করা ছেড়ে দেয়া উচিত। নচেৎ সেটা হবে ধর্মের নামে স্পষ্টতঃ মুনাফিকী।
-মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, বাসাবো, ঢাকা।
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫