সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিডিয়া বিষয়ক এনজিও’র পরিসংখ্যানে বিষয়টি ধরা পড়েছে। ‘আমেরিকানরা যদি জানতো’ নামের এনজিওটির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, পাশ্চাত্যের মিডিয়াসমূহ অসৎ উদ্দেশ্যে ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যকার সংঘাতের খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে পক্ষপাতিত্ব, বর্জন ও বৈষম্যের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি নিউজ নেটওয়ার্ক এবং পাশ্চাত্যের কয়েকটি সংবাদ সংস্থার উপর জরিপ পরিচালনা করলে ফিলিস্তিনীদের হতাহতের খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে বর্জন ও বৈষম্য-বিশৃঙ্খলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এর ফলে দর্শক-শ্রোতারা ফিলিস্তিন-ইসরাইলের সংঘাতের ব্যাপারে গভীর বিকৃতির শিকার হয় এবং বাস্তবে কী ঘটছে সে অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত এশিয়া মিডিয়া সম্মেলন ২০০৬-এ ‘ইফ আমেরিকানস্ নিউ’-এর নির্বাহী পরিচালক আলিসন উইয়ার এসব কথা বলেন।
ইসরাইলের মানবাধিকার সংগঠন বিটি সালেমের হিসেবে সেপ্টেম্বর ২০০০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০০১ পর্যন্ত ইসরাইলীদের সাথে ফিলিস্তিনীদের সংঘাতে ১৬৫ ইসরাইলী এবং ৫৪৯ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়। কিন্তু আলিসন উইয়ারের সংস্থা তদন্ত করে দেখতে পায় যে, পাশ্চাত্যের বেশীর ভাগ মিডিয়ায় প্রায় সংবাদ পরিবেশনেই প্রকৃত সংখ্যাকে গোপন করে ইসরাইলীদের মৃতের সংখ্যাকে ফিলিস্তিনীদের চেয়ে তিনগুণ বেশী দেখানো হয়েছে। এছাড়া ইসরাইলীদের মৃতের সংবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হলেও ফিলিস্তিনীদের মৃতের খবর প্রায় চেপে যাওয়া হয়েছে।
উইয়ার বলেন, এভাবে শ্রোতাদেরকে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এসব বিকৃতি অবশ্য কালানুক্রমিক বিকৃতিও তৈরী করেছে। দেখানো হয়েছে যে, ইসরাইলী সৈন্যরা প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে অথচ বাস্তবতা হলো ইসরাইলের অভ্যন্তরে কোন ইহুদী নিহত হওয়ার আগেই পশ্চিম তীর ও গাজায় বহু ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে।
২০০১ সালে এ্যমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (এআই) এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘কমপক্ষে ৪৭০ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বেশীর ভাগই ইসরাইলী নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা করেছে সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে অবৈধভাবে। কারণ সে সময় ইসরাইলী সৈন্য বা তাদের অন্য কারো জীবন কোন হুমকির মুখে ছিল না।
এছাড়াও দেখা যায়, পাশ্চাত্য মিডিয়াসমূহ ‘নিহত শিশুদের পরিসংখ্যান নিয়েও জালিয়াতি করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, সেপ্টেম্বর ২০০০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০০১ সাল পর্যন্ত ইসরাইলী শিশু নিহত হয়েছে মাত্র ২৮ জন এবং ফিলিস্তিনী শিশু নিহত হয়েছে ১৩১ জন। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই ইসরাইলী নিহত শিশুদের সংখ্যা ফিলিস্তিনী নিহত শিশুদের তুলনায় অনেক বেশী দেখানো হয়েছে।
২০০৪ সালের একটি সময়ে যখন মাত্র ৮ জন ইসরাইলী শিশুর বিপরীতে ১৭৯ জন ফিলিস্তিনী শিশুকে হত্যা করা হয়, তখন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে ইসরাইলী নিহত শিশুদের সংখ্যা ফিলিস্তিনী নিহত শিশুদের সংখ্যার চেয়ে সাতগুণ বেশী দেখানো হয়েছে। উইয়ার বলেন, উদ্বেগেরে বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের মিথ্যা, ভারসাম্যহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট বিশৃঙ্খল রিপোর্ট প্রকাশ অব্যাহতভাবে চলছে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইহুদীবাদী তথা ইহুদী নিয়ন্ত্রিত এ প্রচার মাধ্যমের কাছে শুধু মুসলিম বিশ্বই নয়, খোদ আমেরিকাই রীতিমত নতজানু ও পর্যুদস্ত।
সাংবাদিক এরিক অল্টারম্যানের মতে, মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পণ্ডিতদের বিতর্ক সেসব লোকের মধ্যে সীমিত, যারা ইসরাইলের সমালোচনা করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি ৬১ জন কলাম লেখক ও মন্তব্য লেখকের একটি তালিকা তৈরি করেন, যারা ইসরাইলের অনুসারী প্রতিক্রিয়াশীল সমালোচক। অপরদিকে তিনি শুধু পাঁচজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব পেয়েছেন, যারা অব্যাহতভাবে ইসরাইল কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন কিংবা সমর্থন করেন আরবদের অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলো কচিৎ ইসরাইলী নীতি চ্যালেঞ্জ করে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় কিংবা মন্তব্য পেশ করে। কিন্তু মতামতের স্থিতিটি প্রতিপক্ষের অনুকূলেই যায়। মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে ইসরাইল বিরোধী কোনো লেখা প্রকাশ করার কল্পনা করাও কঠিন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ওয়াশিংটন টাইমস নিয়মিত ইসরাইলকে জোরালো সমর্থন করে সম্পাদকীয় লিখে। কমেন্টারি, নিউ রিপাবলিক ও ইউকলি স্ট্যান্ডার্ডের মতো সাময়িকীগুলো সব ক্ষেত্রে ইসরাইলকে রক্ষা করে চলে।
সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করে পক্ষপাতদুষ্ট সম্পাদকীয়। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা কচিৎ ইসরাইলের সমালোচনা প্রকাশ করে এবং কখনো কখনো স্বীকার করে ফিলিস্তিনীরা সত্যি সত্যিই দুর্ভোগে আছে। তাদের বৈধ অধিকার আছে দুর্ভোগের ব্যাপারে নালিশ জানানোর। তবে পত্রিকাটির দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ নয়।
সংবাদ প্রতিবেদন বরং অধিকতর নিরপেক্ষ। কারণ, সাংবাদিকরা চেষ্টা করেন বস্তুনিষ্ঠ থাকতে। তারপরও অধিকৃত ফিলিস্তিনীদের ঘটনাবলি প্রকাশ করা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় ইসরাইলী অবস্থানের বাইরে গিয়ে। ইসরাইলের বিপক্ষে যায় এমন সংবাদ প্রকাশ নিরুৎসাহিত করার জন্য ইসরাইলি লবি চিঠি লেখা অভিযান চালায়। এই লবি যেসব খবর ইসরাইলবিরোধী বলে মনে করে, সেগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। এসব সংবাদ সংস্থা বয়কট করে। সিএনএনের একজন নির্বাহী বলেছেন, ২০০৩ সালের মে মাসে একটা স্টোরির প্রতিবাদে মাত্র এক দিনে তার কাছে ৬ হাজার প্রতিবাদী ই-মেইল আসে। ইসরাইলের সমর্থক ‘কমিটি ফর অ্যাকুরেট মিডিল ইস্ট রিপোর্টিং ইন আমেরিকা’ (CAMERA) ৩৩টি শহরের ‘ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও স্টেশন-এর সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করে। এই লবি কন্ট্রিবিউটরদের প্ররোচিত করে পাবলিক রেডিও স্টেশন থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য, যদি না এ স্টেশন ইসরাইলের প্রতি সহমর্মী হয়। বোস্টনের পাবলিক রেডিও স্টেশন WBUR এ ধরনের উদ্যোগের ফলে ১০ লাখ ডলারের কন্ট্রিবিউশন হারায়। পাশাপাশি কংগ্রেসে ইসরাইলের মিত্ররাও পাবলিক রেডিও স্টেশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
ইসরাইলী পক্ষ ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর ওপরও প্রাধান্য বিস্তার করে। এই থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লবি ১৯৮৫ সালে এর নিজস্ব ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ গড়ে তুলেছে। তখন মার্কিন ইনডিকের সহায়তায় গড়ে ওঠে WINEP । যদিও এই WINEP এবং ইসরাইলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তবুও এটি দাবি করে, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বৈষম্যহীন ও বাস্তবসম্মত অভিমতই এটি দিয়ে থাকে। আসলে এটি পরিচালিত হয় ইসরাইলী এজেন্ডার গোঁড়া সমর্থকদের দিয়ে। এর তহবিলও যোগায় এরাই।
এ লবির প্রভাব বিস্তার করা হয় WINEP-এর কর্মকাণ্ডের বাইরেও। বিগত ২৫ বছরে ইসরাইল-সমর্থক শক্তিগুলো ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি, ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, হাডসন ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট ফর ফরেন পলিসি অ্যানালাইসিস এবং ডিউইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স (JINSA) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রাধান্য গড়ে তুলেছে। এসব থিঙ্ক ট্যাঙ্কে যুক্তরাষ্টের ইসরাইল ঘেষা নীতির সমালোচকদের নিয়োগ দেয়া হয়না বললেই চলে।
-মুহম্মদ আলম মৃধা, ঢাকা
বিৃটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে বিৃটিশ ভূমিকা-১৫