প্রসঙ্গঃ বাঙালী তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম পক্ষের শক্তির সমন্বয় এবং জাতীয়তাবাদের নামে অতীতের ইসলামী দাবীদারদের বিভ্রান্তি (৭)

সংখ্যা: ১৬৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “আল্লাহ পাক-এর ফযল বা নিয়ামত, আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন।”

ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, রাজারবাগ শরীফের মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকে আল্লাহ পাক বর্তমান পনের শতকের ‘মুজাদ্দিদ’ তথা ‘মুজাদ্দিদে আ’যম’ হিসেবে কবুল করেছেন।

কিন্তু জামাতী, ওহাবী, খারিজীদের তা মানতে বড়ই অনীহা। দুরূহ কষ্ট। অথচ ‘আবু দাউদ শরীফের’ হাদীছ শরীফে, আখিরী রসূল, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে এই উম্মতের মাঝে একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন। তিনি উম্মাহ্র মাঝে জমে থাকা সব বেশরা, বিদ্য়াত দূর করবেন।”

উদ্ধৃত হাদীছ শরীফের আলোকে দেখা যায়, বর্তমান তো বটেই বিগত শতকেরও অনেক মশহুর ওলীআল্লাহ, নামি দামী মুফতী, মুহাদ্দিছ, শাইখুল হাদীছ তারাও মুজাদ্দিদে আ’যম রাজারবাগ শরীফের মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর তাজদীদের ভীষণ মুহতাজ। ঘুরিয়ে বললে, মুজাদ্দিদে আ’যম-এর তাজদীদের প্রেক্ষিতে তাদের অজ্ঞতা, অবিমৃষ্যকারীতা, যুগের প্রেক্ষিতে উদ্ভাবিত মতবাদ সম্পর্কে তাদের দুঃখজনক বিভ্রান্তি আমাদেরকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে। করুণভাবে শিহরিত করে। নিদারুণ দুঃখে ভারাক্রান্ত করে। অনুভূতিতে বিষাদ জন্মায় যে, তাদের গলদের সূচনা ও ধারাবাহিকতায়ই আজকে উম্মাহ্র এ করুণ পরিণতি।

প্রসঙ্গত: “জাতীয়তাবাদী ও ইসলাম পক্ষের শক্তির ঐক্য চাই”- এ শ্লোগানধারী জামাতীরা যে কুফরী করেছে তা এ নিবন্ধে ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। পাশাপাশি জামাতীদের পূর্বে ওহাবী, দেওবন্দী, খারিজীরাও যে জাতীয়তাবাদ তত্ত্ব গ্রহণ করে মহা ভুল করেছিলো তা গত সংখ্যায় পত্রস্থ হয়েছে।

বিশেষতঃ দেওবন্দীদের পরম গুরু, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল তথাকথিত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেবও মুসলমানদেরকে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের আহবান করে মহা ভুল করেছিলেন তা গত সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পাক যার হিদায়েত চান সে হিদায়েত পায়। কিন্তু যে গোমরাহীর উপর দৃঢ় থাকে সে কখনও (ওলীয়ে মুর্শিদ) হিদায়েত পায়না।’

হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেবের অবস্থা হয়েছিলো তদ্রুপ। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ তত্ত্বে তিনি এমনই মশগুল ছিলেন যে, সমসাময়িক অনেকে তাকে হিদায়েতের দিকে ডাকলেও তিনি উল্টো গোমরাহীর উপরই মহা দৃঢ় ছিলেন। থাকতে পছন্দ করেছেন।

সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ সমর্থন ও প্রচার করতে হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেব অবশেষে কুরআন শরীফে বর্ণিত ‘ক্বওম’ শব্দের অবতারণা করেছেন এবং তার নির্লজ্জ ও নির্মম অপব্যাখ্যা করেছেন। যার দাঁতভাঙ্গা খ-নমূলক জবাব গত ১৬৮তম সংখ্যায় দেয়া হয়েছে।

ক্বওম শব্দের অবতারণায় সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ সমর্থনের প্রেক্ষিতে প্রতিভাত হয় যে, আসলে মাদানী ছাহেবের, জাতি ও জাতীয়তাবাদ এর সংজ্ঞা, উৎপত্তি সম্পর্কে কোন ধারণা বা ইলম-কালাম বলতে কিছুই ছিলনা।

সম্পূর্ণ মূর্খ বা জাহিল থেকেই তিনি কংগ্রেসের কৃপাদৃষ্টি লাভ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হাছিলের জন্য এ ব্যাপারে একের পর এক জেহালতি ও অনৈসলামিক বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদের দ্বিধাবিভক্ত ও দুদর্শাগ্রস্ত করে গেছেন। যা আজকে তার উপর গুনাহে জারিয়ার মত বর্তাচ্ছে। (নাঊজুবিল্লাহ)

যে ‘ক্বওম’ শব্দের অবতারণায় তিনি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ সমর্থনের অপপ্রয়াস চালিয়েছেন; সে ‘ক্বওম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বিগত বিশ-ত্রিশ হাজার বছরের আগের ইতিহাসকে উপলক্ষ করে। পক্ষান্তরে জাতি ও জাতীয়তাবাদের ইতিহাস হলো ইদানিংকালের।

অর্থাৎ আজকের জাতি বা জাতীয়তাবাদ ধারণার কোন অস্তিত্বই ছিল না তখন; তারপরেও ধর্মব্যবসায়ীর মতই আজকের জাতীয়তাবাদ গ্রহন করে থাকে মাদানী ছাহেব সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত ক্বওম শব্দের অপব্যাখ্যা করে তার মতবাদ দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।

দেওবন্দীদের কাছে এত বড় বুযূর্গের এত বড় জালিয়াতি ও এতবড় জেহালতি সত্যিই খুব দুঃখজনক।

 ঊ.ঐ. ঈধৎৎ সহ সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত যে “মধ্যযুগ শেষ হওয়ার আগে আধুনিক অর্থে জাতির উদ্ভব হয়নি।” মূলত: জাতি ও জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি হয় ষোড়শ শতাব্দীরও পরে।

জাতি ও জাতীয়তাবাদের ধারণা মূলতঃ ইংরেজদের থেকেই প্রসার লাভ করে।

জাতি হিসেবে যারা সংহত হয়েছিল তাদের মধ্যে ইংরেজরা অন্যতম। কতকগুলো ঐতিহাসিক কারণে অন্য অনেক দেশের আগে ইংল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয় পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ হবার ফলে জনসাধারণ ক্রমবর্ধমান হারে পারস্পরিক বিনিময়ঘটিত সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছিল এবং তার ফলে কথিত জাতীয় অর্থনীতির উদ্ভব হচ্ছিল। এর ফলে এখানে কথিত গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারাও আগে উদ্ভূত হয়। এই ভাব-ধারা রাষ্ট্র ও সমাজ এবং ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কিত সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধবাদী।

কালক্রমে অন্য দেশের জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের উপযোগী ঐতিহাসিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের বিকাশ এবং বাইরের প্রভাব এই দুই কারণে এই ঘটনা ঘটে।

ইতিহাসবিদদের মতে, সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস মূলতঃ জাতিগঠনের ইতিহাস। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বাধাবিঘœ অতিক্রম করে সৃজ্যমান জাতিদের পরিপূর্ণ জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভের ইতিহাস এবং ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতিদের মধ্যে আত্মরক্ষা এবং আত্মবিস্তারের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সংগ্রামের ইতিহাস। জাতিগঠনের প্রক্রিয়া বিংশ শতকেও চলেছে।

খৃস্টীয় যুগের প্রথম ১৫শ’ বছরব্যাপী কথিত সর্বজনীন বিশ্ব রাষ্ট্রের আদর্শ চালু ছিল। কোনো আলাদা রাজনৈতিক সত্ত্বার প্রতি আনুগত্যবোধ ছিল না। রোম সাম্রাজ্যকে সর্বজনীন বিশ্ব রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে ধরা হত। মনে করা হত শুধু ছোট্ট রোম সাম্রাজ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল খৃস্টীয় প্রজাতন্ত্রেই তার অস্তিত্ব রয়েছে। খৃস্টীয় দৃষ্টিতে এটাই পরে বিশ্ব সভ্যতা ও নীতি হিসেবে গৃহীত ও অনুসৃত হত।

যেমন রাষ্ট্রকে তেমনি সভ্যতাকেও জাতীয় পরিচয় দ্বারা চিহ্নিত  করা হত না। জাতির মতই ধর্ম দিয়ে সভ্যতার নামকরণ করা হত। খৃস্টান ধর্মানুসারী সবার সভ্যতা- খৃস্টীয় সভ্যতা, ইসলাম ধর্মানুসারী সবার সভ্যতা- মুসলিম সভ্যতা এবং ভারতের হিন্দুদের গড়ে তোলা সভ্যতা- হিন্দু সভ্যতা। ভাষাকেও ধর্মের সঙ্গে জড়ানো হত, খৃষ্টীয়  এলাকায় ল্যাটিন অথবা গ্রীক,  মুসলিম এলাকায় আরবী অথবা ফার্সী চিরায়ত যুগে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা সকল মানুষের জন্য সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে নির্দিষ্ট হত। আরো পরে ইউরোপে ফরাসী সভ্যতা তাবৎ শিক্ষিত মানুষের জন্য অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। আঠার শতকের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। সভ্যতা জাতীয় পরিচয়ে চিহ্নিত হয়নি।

আঠার শতক থেকে এ ধারণা প্রবল হয়ে উঠে যে, সাধারণ মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য জাতীয় ভাষাই সবচেয়ে উত্তম। অন্য দেশের বা অন্য জাতি ও যুগের ভাষা যত উন্নতই হোকনা কেন সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের জন্য তা সহায়ক নয়। আঠার শতকের শেষার্ধ থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা জাতীয় রূপ গ্রহণ করতে থাকে। এর পাশাপাশি মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচারে জাতীয় ছাপ পড়তে শুরু করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কবি সাহিত্যিকগণ সবার আগে কথিত জাতীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা জনগণের মুখের ভাষার উন্নয়নসাধন করেন এবং একে শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চার উপযোগী করে তোলেন। এভাবে কথিত জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয় এবং জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দাবি উত্থাপন ক্ষেত্র তৈরি হয়।

জাতীয় চেতনার প্রথম বিকাশ ঘটে ইংল্যান্ডে পিউরিটান বিপ্লবকে কেন্দ্র করে। ইংরেজ কবি জন মিলটনের কাব্যে তার প্রকাশ ঘটে। রাজনৈতিক চিন্তার জগতে তা চূড়ান্ত রূপ পায় জন লকের দর্শনে। পরবর্তী শতাব্দীতে এই চেতনা ফ্রান্স ও বৃটিশ শাসিত আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে। আমেরিকায় উপনিবেশকারী বৃটিশরা পিউরিটান বিপ্লবের প্রভাবে এবং জন লক ও সমসাময়িক ফরাসী দার্শনিকদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তারা টমাস জেফারসন ও টমাস পেইন-এর লেখা থেকেও প্রেরণা লাভ করে।

আমেরিকায় জাতীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম স্বাধীনতা প্রাপ্তির (১৭৭৬) মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামোগত রূপ লাভ করে। আমেরিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য ফরাসী জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের উৎসাহিত করে। তারা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ সংগ্রামেরই চূড়ান্ত রূপ ১৮৮৯ সালের কথিত ফরাসী বিপ্লব।

বর্ণিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকেও প্রতিভাত হয় যে আসলে জাতিগত ধারণা, জাতীয়তাবাদের চেতনা সবই আধুনিক কালের। বিশেষতঃ ইংরেজদের থেকেই এর উৎপত্তি ইংরেজদের থেকেই এর বিকাশ।

বলার অপেক্ষা রাখেনা এ বিচারে দেওবন্দীদের কথিত মহাবুযূর্গ মাদানী ছাহেব মূলতঃ একজন আশাদ্দুদ দরজার অজ্ঞ এবং ইংরেজ প্রবর্তিত জাতি ও জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কুরআন শরীফে উল্লিখিত ‘ক্বওম’ শব্দের সাথে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা করার অপপ্রয়াসে তিনি একজন ধর্মব্যাবসায়ীও বটে। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই ধর্মব্যবসায়ীরা সৃষ্টির নিকৃষ্ট।” (মিশকাত)

পাশাপাশি পাক-ভারতে মুলমানদের মাঝে ইংরেজ প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদ প্রচলনের প্রয়াসের প্রেক্ষিতে মাদানী ছাহেবের পরকালীন পরিণতি সম্পর্কেও আঁচ করা যায়। কারণ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে তার হাশর-নশর তার সাথে হবে।” বুখারী শরীফ। (নাঊজুবিল্লাহ)

-মুহম্মদ তারিফুর রহমান, ঢাকা।

ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২

কোকাকোলা ও অন্যান্য কোমল পানীয় সম্পর্কে উন্মোচিত সত্য-১৮

‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’- একটি সূক্ষ্ম ও গভীর ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া অথচ নিশ্চুপ তথাকথিত খতীব, মহিউদ্দীন, আমিনী ও শাইখুল হাদীছ গং তথা তাবত ধর্মব্যবসায়ীরা- (১)

মওদুদীর নীতি থেকেও যারা পথভ্রষ্ট সেই জামাত- জামাতীদের জন্যও ভয়ঙ্কর মুনাফিক॥ আর সাধারণের জন্য তো বলারই অপেক্ষা রাখেনা

প্রসঙ্গঃ আমেরিকায় ইহুদী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ- ২