এসএসসি পরীক্ষার পাশাপাশি দাখিল পরীক্ষার ফলাফলও কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। উভয় ফলাফলের তুলনামূলক মান হার নির্ণয়- এ লিখার উদ্দেশ্য নয়। তবে যে কারণে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নামে একটি আলাদা বোর্ড ও দাখিল পরীক্ষা নামে একটি আলাদা পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, সে আঙ্গিকে সঙ্গত কিছু প্রশ্ন উত্থাপনই এ লিখার অবকাশ। সহজ কথায় বলতে গেলে সাধারণ শিক্ষার আবহেই এসএসসি পাঠ্যক্রম প্রক্রিয়া। পক্ষান্তরে তার সাথে আলাদাভাবে ইসলামী আদর্শ ও ইলম তথা আমলের সমন্বয়েই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম।
স্বভাবতই একজন মাদরাসা ছাত্র ইসলামী পোশাকে সজ্জিত থাকবেন, ইসলামী ইল্মে সমঝদার হবেন, ইসলামী আমলে উজ্জীবিত থাকবেন- তারা ছবি তুলবেন না, বেপর্দা হবেন না এটাই কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত।
যা শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে শুধু মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষক নয় এসব ইসলামী আক্বীদা ও আমল সাধারণ মানুষেরও অজানা নয়।
বিশেষতঃ বেপর্দা না হওয়া ও ছবি না তোলা,- এটা যে ইসলামের মূল শিক্ষা, তা সাধারণ মুসলমানও জানে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান অবাক দৃষ্টিতে দেখল, সামান্য ফলাফল প্রকাশের প্রক্রিয়ায় সব একাকার। দাখিল মাদরাসা সুপার তার ডান পাশে বেপর্দা মহিলা ছাত্রী, বামপাশে ছাত্রদের নিয়ে ছবির পোজ দিচ্ছেন। আবার মাদরাসা বেপর্দা শিক্ষক ও বেপর্দা শিক্ষিকাও এক সাথে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন।
সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠে, এই বেপর্দাই যদি হয় তাদের আমল ও প্রবৃত্তি তাহলে আবার আলাদা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের দরকার কি?
তারা ওজর আপত্তি প্রকাশ করে থাকেন যে, সরকার তাদেরকে ছবি তুলতে বাধ্য করে। কিন্তু ফল প্রকাশের পর ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ ছবির জন্য পোজ দেয়া- এক্ষেত্রে তো সরকার তাদেরকে আদৌ বাধ্য করেনি। তবে এখন স্বর্তঃস্ফূর্তভাবে ছবির জন্য পোজ দেয়া কেন?
তারা কি মাদরাসা কারিকুলামের অধীনে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ তথা সিহাহ্্ সত্তার অন্তর্ভূক্ত হাদীছ শরীফের গ্রন্থগুলোতে ছবি তোলার বিরুদ্ধে হাজার হাজার হাদীছ শীফ পড়ছেন ও পড়াচ্ছেন না। পরীক্ষার খাতায় লিখছে না? তারপরেও যদি তারা ছবি তুলেন, তবে আর তাদের মাদ্্রাাসয় পড়ার বা পড়ানোর দরকার কি? তাহেল কি তারা ঐ সব হাদীছ শরীফের মুখোমুখী হবেন না- “কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে, যে তার ইল্্ম দ্বারা কোন ফায়দা হাছিল করতে পারেনি। আরো বর্ণিত আছে, “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে যে ছবি তুলে বা আঁকে।”
এর পাশাপাশি একটি দিক হল যে, বর্তমান মাদ্্রাসা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কারো বুকে বা মাথায়, মন এবং মস্তিষ্কে আসলে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ও মুহব্বত নেই।
পাশাপাশি তাদের দুনিয়াবী ইলম বলতেও কিছু নেই। তারা সবাই ‘ইবনুল ওয়াক্ত’ বা ‘সময়ের সন্তান’। সময়ের প্রবাহ যেদিকে চলছে, যুগের মানসিকতা যেদিকে ধাবিত হচ্ছে সেদিকেই তাদের আমল-আক্বীদা। যদি তাই হয়ে থাকে তবে আবার মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নামে আলাদা কার্যক্রমের দরকার কি?
এটা কি ইসলামের নামে তামাশা ও নিখাদ ধর্মব্যবসা নয়। এবারে বেশি হলেও গেল কয়েকবার থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষকরাও কথিত জিপিএ-৫ পাওয়ায় তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলী ফাঁক করে ইংরেজী ঠরপঃড়ৎু-এর ‘ঠ’ বর্ণ প্রতীক প্রকাশ করছে। অথচ তাদের জানা উচিত ছিল যে, এটা অমুসলিম বা বিধর্মীদের রীতি।
এটা পুরোই ইউরোপীয় কালচার। ইউরোপেই এর উৎপত্তি। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তি বিজয় লাভ করার পর সৈন্যরা ফ্রান্সের ইটজএঅঘউণ বন্দরে নামার আগে উপস্থিত অভ্যর্থনাকারীদের জয় বা ঠরপঃড়ৎু লাভ করার প্রতীক হিসেবে এই ‘ঠ’ চিহ প্রদর্শন করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির সৈন্যদের দ্বারাই তাদের ঠরপঃড়ৎু নিদর্শন হিসেবে তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলীকে ফাঁক করে এই ‘ঠ’ চিহ প্রদর্শনের ব্যাপক প্রচলন হয়।
আর সেখান থেকেই কালক্রমে এখন বাংলাদেশীদের মাঝেও তা সংক্রমিত হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে মহাদুর্নীতিবাজ ও অপরাধী জেলখানা থেকে আদালতে যাওয়ার সময়ও আঙ্গুলী ফাঁক করে ‘ঠ’ চিহ দেখাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, পড়াশোনা একটা প্রক্রিয়া। ভাল ফলাফল লাভ একটা সাফল্য বটে। কিন্তু এটা কোন যুদ্ধে জয় লাভ করা মত বিষয় নয়। এটা যদি জয় হয় তবে পরাজয় বরণ করল কারা। আর ছাত্ররা কার বিরুদ্ধে জয় লাভ করল এবং কাকে তাদের ঠরপঃড়ৎু দেখাচ্ছে। কাজেই সাম্প্রতিককালে স্কুল ছাত্রদের এই ‘ঠ’ চিহ প্রদর্শন অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক এবং অনৈসলামিকও বটে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য বিধর্মীদের রীতি থেকে পরহেজ হয়ে ইসলামী আদর্শ ও মুসরমানদের তাহজীব-তমুদ্দুন ফুটিয়ে তোলাই তো মাদরাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনিবার্য করণীয়। কিন্তু তা না করে তারা যখন দুনিয়াবী ফ্যাশন তথা স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের স্রোতেই ভেসে চলছেন, তাহলে মাদরাসা নামে চলাটা কি প্রকাশ্য মুনাফেকী নয়?
অথচ এখনও হাজার হাজার স্কুল-ছাত্র, শিক্ষক রয়েছেন, যারা ভাল ফলাফলের কথা শুনে প্রথমে ভাল করে ওযু করে দু’রাকায়াত শুকরিয়ার নামায পড়ে আল্লাহ পাক-এর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।
কথা ছিল মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে এই অনুভূতি ও কালচার আরো শক্ত এবং ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হবে এবং তা স্কুল ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝেও প্রভাব বিস্তার করবে। তারাও তা অনুশীলন করবে।
কিন্তু তার পরিবর্তে মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষকরাই যখন তাদের মত অঙ্গুলীর দ্বারা ‘ঠ’ চিহ প্রদর্শন করে উল্লাস করে; তখন তারা যে ইসলামী আদর্শ ভ্রষ্ট হয়েছে তা খুব সহজেই বলা যায়: তাদের দ্বারা যে মুসলমানদের তাহজীব-তমুদ্দুন বিকাশের কোন আশা নেই, সে কথা নিশ্চিতই ধরা যায়। তারা যে উলামায়ে হক্ব হতেও পারবে না- তাও দ্বিধাদ্বন্দহীনভাবে উল্লেখ করা যায়। তবে তারা কি?
মূলতঃ তারাই হাদীছ শরীফে উল্লিখিত নিকৃষ্ট ধর্মব্যবসায়ী, যারা দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া হাছিল করে। মাদরাসায় তারা পড়াচ্ছে নিহায়েত রিযিকের সন্ধানে। চাকুরি হিসেবে ও তার খাতিরে। যে কারণে ৩ জন শিক্ষক থাকলে ৩০ জন দেখানো এবং ৩০ জন ছাত্র থাকলে ৩০০ ছাত্র দেখানোসহ নানা দুর্নীতি তাদের হরহামেশা কীর্তি।
পাশাপাশি স্কুল-কলেজের পড়ার তুলনায় মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষা অনেক সহজ হওয়ায় এবং এখন থেকে উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি হওয়াও অনেক সহজ হওয়ায় তারা মাদ্্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই কাজ করছে ব্যবসায়ীক মনোবৃত্তি। যাকে কেবল ধর্মব্যবসাই বলা যেতে পারে।
অতীত ইতিহাসেও এর নজীর রয়েছে। বাগদাদের প্রখ্যাত নিজাম-উল-মূলক রহমতুল্লাহি আলাইহি মাদরাসা হাজির হয়ে প্রত্যেক ছাত্রকে ডাকলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, তাদের কার কি উদ্দেশ্য? কেউ বলল- কাজী হওয়া, কেউ বলল- ওয়ায়েজ হওয়া ইত্যাদি। সবারই উত্তর এ রকম।
অতপর হযরত নিজাম-উল-মুলক রহমতুল্লাহি আলাইহি পুরো মাদরাসা ঘুরতে ঘুরতে মাদরাসা এক কোণে স্থানে মহামনোযোগে এক ছাত্রকে পড়াশোনা করতে দেখলেন। তিনি তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলে ছাত্র জবাব দিলেন তাকে ডিস্টার্ব বা বিরক্ত না করার জন্য। এরপর তাকেও যখন একই প্রশ্ন করা হলো- তখন তিনি জবাব দিলেন, “খালিছ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির জন্যই তিনি মাদ্্রাসায় পড়ছেন। দ্বীন-ইসলামকে বুলন্দ করার জন্য।” তখন হযরত নিজাম-উল-মূলক রহমুতল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আজকে যদি এ ছাত্র না থাকতো, তবে আমি গোটা মাদ্্রাসাকেই ভেঙে দিতাম।’
উল্লেখ্য, মহান ছাত্রটি ছিলেন সে যামানার মুজাদ্দিদ, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, খুলুছিয়তবিহীনভাবে পড়ে আজকের গোট মাদরাসা-শিক্ষক-ছাত্ররাই দৃশ্যতঃ মাদরাসা না ভাঙলেও আসলে তারাই ভেঙে দিচ্ছে মাদ্্রাসা শিক্ষার ফযীলত, রূহানীয়ত ও বরকত। যার কারণে আজ সমাজে নেই আলিম সমাজের ভূমিকা ও সম্মান।
বলাবাহুল্য, ইলমে তাছাউফ তথা রূহানীয়ত না থাকলে এমনটিই হওয়া অতি স্বাভাবিক। মাদরাসা ছাত্র ও শিক্ষক সবারই তাই উচিত বর্তমান যামানার মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম, ইমামুল আইম্মাহ, কুতুবুল আলম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম হযরত রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর নেক ছোহবতে হাজির হয়ে রূহানীয়ত ও খুলুছিয়ত অর্জন করা। হাক্বীক্বী ইসলাম বুলন্দের কারিগর হওয়া। আল্লাহ পাক আমাদের কবুল করুন। (আমীন)
-মুহম্মদ ওয়ালীউর রহমান, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২