ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৪)

সংখ্যা: ১৫৫তম সংখ্যা | বিভাগ:

—- হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম —–

প্রসঙ্গঃ শায়খ বা মুর্শিদ হচ্ছেন ক্বিবলায়ে কুলূব তথা অন্তরের ক্বিবলা। কাজেই নামাযের ক্বিবলার ন্যায় তাঁর তা’যীম-তাকরীম করবে।

কা’বা শরীফের দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায আদায় করা নামাযের অন্যতম রোকন বা শর্ত। আল্লাহ পাক বলেছেন,

فول وجهك شطر المسجد الحرام وحيث ما كنتم فولوا وجو هكم شطره.

অর্থঃ- “(হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনার চেহারা মুবারক মসজিদে হারামের দিকে ফিরান। আর তোমরা যেখানে থাকনা কেন সেদিকে (মসজিদে হারাম) মুখ ফিরাবে।” (সূরা বাক্বারা-১৪৪)

কাজেই যদি কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সেদিক হতে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে ক্বিবলা নির্ধারণ করে নামায আদায় করে তাহলে সে কাফিরে পরিণত হবে।

উল্লেখ্য যে, সালিক বা মুরীদ সকল আমলের জন্য ক্বিবলায়ে কুলূব তার মুর্শিদকে ক্বিবলা বানাবে।  অর্থাৎ তাঁর দিকে মুখ করেই যিকির-ফিকির, তাসবীহ-তাহলীল, দোয়া-দুরূদ, খানা-পিনা ইত্যাদি সকল কাজ সম্পাদন করবে। মোদ্দাকথা, তার সকল চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্যস্থল হবে তার শায়খ বা মুর্শিদ। কাজেই অন্তরের রোখ্কে সব সময় সেদিকেই নিবিষ্ট রাখা আবশ্যক।

আফজালুল আউলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “সাবধান! লক্ষ্য একদিকেই রাখবে। বিভিন্ন দিকে লক্ষ্য করা ক্ষতির কারণ।’ (মাকতুবাত শরীফ)

ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ যা কিছু হোক না কেন শায়খ ভিন্ন অন্য কারো নিকট হতে তা গ্রহণ করবেনা। এমনকি যদিও তা দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হয় এবং সেটা যদি সরাসরি আল্লাহ পাক থেকেও আসে বলে মনে হয় তবুও ধোকায় পড়বেনা।

মূলতঃ মুরীদ উসীলা বা মাধ্যমের মোহতাজ। উসীলা বা মাধ্যম তথা শায়খ ব্যতীত তা গ্রহণ করবে না। কারণ তাতে কোন নিরাপত্তা নেই। তাতে শয়তানের ধোকা, প্রতারণা থাকা অসম্ভব নয়।

আর শায়খ বা মুর্শিদের নিকট হতে প্রাপ্ত নিয়ামত শয়তানের ধোকা, ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত।

ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

মত্ত হলে একের মায়ায়, অন্যকে তো চায়না আর,

অন্যজনের আলিঙ্গনে শান্তি কি আর হয় তার!

তুলসী ফুলের লক্ষ তোড়া যদ্যপি দাও বুলবুলে,

গোলাপ ফুলের গন্ধ ছাড়া তার কি কভু মন ভোলে!

ভাস্করেরই কিরন পেয়ে কুমুদ যখন শান্তি পায়,

পূর্নেন্দুর নৃত্য হাসি তাহার কি আর মন ভুলায়।

তৃষ্ণাতুরের শুষ্ক পরান শীতল সলিল পায় যখন,

শর্করাদি ভক্ষণে কি তৃপ্তি তাহার হয় তখন। (মাকতুবাত শরীফ)

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আউলিয়ায়ে কিরামগণ বলেন, “বর্তমান জামানায় মানুষ ইল্মে তাছাউফের শিক্ষাকে ছেড়ে দেয়ার কারণে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত তথা নৈকট্য হতে বঞ্চিত।

আবার কিছু লোক তাছাউফ চর্চা করেন বটে কিন্তু তারাও অনেক ক্ষেত্রে জাহিরী আলিম, দুনিয়াদার মাওলানাদের ধোঁকা ও প্রতারণার শিকার। তারা তাদের তিরস্কারকে উপেক্ষা করতে পারেনা। ইল্মে তাছাউফের শিক্ষা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে সাহস পায়না। ফলে হাক্বীক্বতে পৌঁছতে পারেনা।

সব সময় স্মরণ রাখতে হবে যে, মুর্শিদের হাতে বাইয়াত হওয়া, তাঁর ছোহবত ইখতিয়ার করা তাঁর আদেশ-নিষেধমত জীবন-যাপন করা আল্লাহ পাক-এর আদেশ। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ। কাজেই অন্যান্য আদেশ-নিষেধ যেমন অকাট্ট এবং পালনীয় একইভাবে মুর্শিদের আদেশ-নিষেধও অকাট্ট এবং পালনীয়।

স্মর্তব্য, শায়খ বা মুর্শিদ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খলীফা বা প্রতিনিধি। কাজেই তাঁকে ক্বিবলা বানানোর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ক্বিবলা বানানো।

মহান আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

من يطع الر سول فقد اطا ع الله.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত (অনুসরণ) করলো, সে যেন আল্লাহ পাক-এরই ইতায়াত (অনুসরণ) করলো।” (সূরা নিসা-৮০)

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من اطاع محمدا فقد اطاع الله.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করলো, সে যেন আল্লাহ পাক-এরই ইতায়াত (অনুসরণ) করলো।” (মিশকাত শরীফ)

অর্থাৎ “আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে যেমন আল্লাহ পাক-এর ইতায়াত হতে পারে না। তেমনিভাবে আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেছাল শরীফের পর আউলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার ইতায়াত (অনুসরণ) ব্যতীত আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আল্লাহ পাক-এর ইতায়াত (অনুসরণ) করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,

يا يها الذ ين امنوا اطيعوا الله واطيعوا الر سول واولى الا مر منكم.

অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাক-এর ইতায়াত করো এবং রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করো। আর তোমাদের মধ্যে যারা উলীল আমর রয়েছেন তাঁদের ইতায়াত করো।” অর্থাৎ উলীল আমর তথা শায়খ বা মুর্শিদের ইতায়াতই হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আল্লাহ পাক-এর ইতায়াতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মনোনিবেশ করা শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা।

পূর্বাপর অনেক ছূফী-সাধক, দরবেশ দাবীদার গোমরাহ হয়েছে এবং হচ্ছে যারা নিজেদের ক্বিবলায়ে কুলূবকে নামাযের ক্বিবলার ন্যায় সম্মান-ইজ্জত করেনি। নিজেদের শায়খকে ক্বিবলা তথা চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্যস্থল বানাতে পারেনি তারা শায়খ ব্যতীত অন্যের নিকট নিয়ামতপ্রাপ্তির আশা পোষণ করতো। ফলে শয়তান অতি সহজেই তাদেরকে গোমরাহ্ করার ও গোমরাহীতে নিমজ্জিত রাখার প্রয়াস পেয়েছে।

মূলতঃ এধরনের লোক শায়খের মুরীদ নয়। বরং এরা স্বীয় নফসের মুরীদ। প্রবৃত্তি পূজারী। কারণ, যারা হাক্বীক্বী মুরীদ তারা কশ্মিনকালেও অন্যদিকে মনোনিবেশ করেনা। আর সেজন্যেই শয়তান কখনো তাদেরকে গোমরাহ করতে পারবেনা ইনশাআল্লাহ।

শয়তান আল্লাহ পাককে বলেছিলো,

قال فبعز تك لا غو ينهم اجمعين الا عباد ك منهم المخلصين.

অর্থঃ- “শয়তান বললো, আপনার ইজ্জতের কসম! অবশ্যই তাদের সকলকে গোমরাহ করবো। তবে তাদের মধ্যে যারা খালিছ ইখলাছপ্রাপ্ত তারা ব্যতীত।” (সূরা ছোয়াদ- ৮৩) অর্থাৎ তারা (একনিষ্ঠ মুরীদ) শয়তানের ধোকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত।

সাইয়্যিদুল আউলিয়া হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বাড়ীর নিকট দিয়ে একজন সালিক যাতায়াত করতো। তাঁর বাড়ীর নিকটবর্তী হলে উক্ত সালিক রুমাল দিয়ে তার মাথা ঢেকে রাখতো। একদিন হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি তাকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে; উত্তরে সে জানালো, ‘আমি অন্য একজন শায়খের মুরীদ। যদি আমার মন আপনার দিকে আকর্ষিত হয় এই আশঙ্কায় আমি মুখ ঢেকে এই এলাকা অতিক্রম করি।’ তার জাওয়াব শুনে হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি খুব খুশী হলেন। তাঁকে এবং তাঁর শায়খ উভয়কে ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ দান করলেন। ফলে তারা উভয়ই বড় ওলীআল্লাহ হিসেবে মাশহুর হলেন। মূলত: স্বীয় শায়খের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ্ থাকার কারণেই উক্ত মুরীদ এরূপ নিয়ামত লাভ করলেন।

পূর্ববর্তী সকল ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরামগণ নিজ নিজ শায়খ বা মুর্শিদকে ক্বিবলা বানিয়ে নিয়েছিলেন। নামাযের ক্বিবলার ন্যায় ক্বিবলায়ে কুলূবকে তা’যীম-তাকরীম করতেন।

শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম, হাক্বীমুল হাদীছ হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি  যখন কোন মাসয়ালার সঠিক ফায়সালা খুঁজতেন তখন ইমামে আ’যম, মুজাদ্দিদে মিল্লাত্ ওয়াদ্ দ্বীন, হাকিমুল হাদীছ হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর স্মরণাপন্ন হতেন। ওযূ করে দু’রাকয়াত নামায আদায় করতেন।

স্মর্তব্য যে, সেখানে গিয়ে তিনি স্বীয় মাযহাব ত্যাগ করতঃ হানাফী মাযহাব মত নামায আদায় করতেন। নামাযন্তে তাঁর মাজার শরীফের নিকট গিয়ে তাঁর উছীলা দিয়ে আল্লাহ পাক-এর নিকট দোয়া করতেন। আর সাথে সাথে তার সঠিক সমাধান পেয়ে যেতেন।” (সুবহানাল্লাহ)

অর্থাৎ ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি এত বড় ইমাম হওয়ার পরও ফিক্বহী মাসয়ালার ক্ষেত্রে ইমামে আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহিকে ক্বিবলা হিসেবে গ্রহণ করতেন, তা’যীম-তাকরিম করতেন।

(অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)