কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “আল্লাহ পাক-এর নিয়ামত, আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন।” ইমামুল আইম্মা, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকে আল্লাহ পাক বর্তমান পনের শতকের ‘মুজাদ্দিদ’ তথা ‘মুজাদ্দিদে আ’যম’ হিসেবে কবুল করেছেন। কিন্তু জামাতী, ওহাবী, খারিজীদের তা মানতে বড়ই অনীহা। দুরূহ কষ্ট। অথচ ‘আবু দাউদ শরীফের’ হাদীছ শরীফে, আখিরী রসূল, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে এই উম্মতের মাঝে একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন। তিনি উম্মাহ্র মাঝে জমে থাকা সব বেশরা, বিদ্য়াত দূর করবেন।” উদ্ধৃত হাদীছ শরীফের আলোকে দেখা যায়, বর্তমানে তো বটেই বিগত শতকেরও অনেক মশহুর ওলীআল্লাহ, নামি দামী মুফতী, মুহাদ্দিছ, শাইখুল হাদীছ তারাও মুজাদ্দিদে আ’যম রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর তাজদীদের ভীষণ মুহতাজ। ঘুরিয়ে বললে, মুজাদ্দিদে আ’যমের তাজদীদের প্রেক্ষিতে তাদের অজ্ঞতা, অবিমৃষ্যকারীতা, যুগের প্রেক্ষিতে উদ্ভাবিত মতবাদ সম্পর্কে তাদের দুঃখজনক বিভ্রান্তি আমাদেরকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে। করুণভাবে শিহরিত করে। নিদারুণ দুঃখে ভারাক্রান্ত করে। অনুভূতিতে বিষাদ জন্মায় যে, তাদের গলদের সূচনা ও ধারাবাহিকতায়ই আজকে উম্মাহ্র এ করুণ পরিণতি। উল্লেখ্য, ‘জাতীয়তাবাদী’ ও ‘ইসলাম পক্ষের শক্তির ঐক্য চাই’- এ বক্তব্যের আলোকে আজকের জামাতীরা জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে ইসলামের দৃষ্টিতে যে কুফরী করেছে তা গত কয়েক সংখ্যায় তাদের জন্মদাতা মওদুদীর বক্তব্যের আলোকেও প্রমাণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ জামাতীদের পাশাপাশি ওহাবী, খারিজী, দেওবন্দীরাও যে এ বিষয়ে জামাতীদের চেয়েও মহা গুমরাহী, বিভ্রান্তি ও চরম ভুলের মধ্যে রয়েছে; তাদের পরম গুরুজন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল হোসাইন আহমদ মাদানী লিখিত ‘একজাতি তত্ত্ব ও ইসলাম’ নামক পুস্তিকা তার প্রামাণ্য দলীল। এখানে জ্ঞাতব্য যে, হোসাইন আহমদ মাদানী সমগ্র ভারতের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, ব্রাহ্মসহ অন্য সব ধর্মাবলাম্বীদের নিয়ে এক ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। তার এ গরল বক্তব্যের কেউ কেউ খ-নমূলক জবাব দিলেও ভারতবাসীর স্বদেশিকতা তথা এক ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রচারকে মুসলমানের জন্য নাজায়িয ও হারাম প্রমাণ করার পরও তিনি তার বিরোধিতা করেন।
বরং ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটাচ্ছে তার বিরোধিতাকে তিনি ব্রিটিশদের দালাল বলে মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে ‘একজাতি তত্ত্ব ও ইসলাম’ পুস্তিকার সূচনাতেই তিনি লিখেন, “একজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা এবং উহাকে ন্যায়-নীতির বিপরীত প্রমাণ করার প্রসঙ্গে যাহা কিছু প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার ভুল-ত্রুটি দেখাইয়া দেয়া এখন জরুরী মনে হইতেছে। কংগ্রেস ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভারতবাসীর নিকট স্বদেশিকতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের দাবী করিয়া যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা ও সাধনা করিতেছে। উহার বিরোধী শক্তিসমূহ উহার অস্বীকারযোগ্য হওয়া বরং নাজায়েজ ও হারাম হওয়ার কথা প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে। বস্তুত ব্রিটিশ কূটনীতিকদের যাদু প্রভাবে যারা পক্ষাঘাৎগ্রস্ত হইয়াছে তাহারা এই কথা কবুল করিবে বলিয়া আশা করা যায় না।” হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ পাক যার ভালাই চান, তাকে দ্বীনি সমঝ দেন।” হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেব দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন বটে। কিন্তু তার মধ্যে যে আদৌ দ্বীনি সমঝ বলতে কিছু ছিলো না তা তার উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা আরো পরিস্কার হয়। পাশাপাশি আরো প্রমাণিত হয় যে, আসলে থানভী থেকে শুরু করে গোটা দেওবন্দী সিলসিলাই দ্বীনি সমঝবিহীন। মূলতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি আদব ও মুহব্বতের ঘাটতি, সুন্নতের আমলহীনতা তথা তাছাউফে দখলশূন্যতাই এর পেছনে কারণ। একই তবক্বায় থাকার কারণেই হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেন নিচের কথা বলতে পেরোছিলো, “কংগ্রেস যে সম্মিলিত জাতীয়তাকে ভারতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহে, তাহাতেও সে এমন কোন কাজ করিতে চাহে না, যাহার ফলে ভারতবাসীদের ধর্ম কিংবা সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ব্যক্তিগত আইনের উপর কোনরূপ ক্ষতিকর প্রভাব পড়িতে পারে। সম্মিলিত স্বার্থ ও দেশীয় প্রয়োজনের সহিত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিকে বিদেশী শাসকবর্গ নিজেদের করায়ত্ত করিয়া রাখিয়া ভারতের অধিবাসীদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করিয়াছে। বিঘোষিত এলাকা, মিউনিসিপ্যাল বোর্ড, জিলা বোর্ড, কাউন্সিল, এসেম্বলী ইত্যাদিতে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যাপার হিসাবে সিদ্ধান্ত করা হয়। এইগুলির ক্ষেত্রে কোন জাতি বা ধর্ম মিলিয়া যাওয়ার কোন কথা নাই।” হোসাইন আহমদ মাদানী ছাহেবের এ বক্তব্যে প্রতিভাত হয় যে, আসলে মাদানী ছাহেব সমসাময়িক ইতিহাস, হিন্দু-মুসলমান মনমানসিকতা, সংস্কৃতি সম্পর্কে অমার্জনীয় অজ্ঞ এবং নীতিহীন বেখবর ছিলেন। মূলত সম-সাময়িক বিষয়, ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে কাট্টা মূর্খ থেকেই ফতওয়া দেয়া দেওবন্দী সিলসিলার মজ্জাগত অভ্যাস। ইতিহাস বলে, উনবিংশ শতকে বাংলার মুসলমান ইংরেজ শাসনের উপর খুশী ছিলো না। এ যুগে তারা পড়েছেন অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে। তাছাড়া ইংরেজী শাসন ছিলো বিধর্মী শাসন। তাই মুসলমানরা হয়েছেন এ যুগে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধি। অন্যদিকে এ সময় হিন্দুরা করেছেন ইংরেজী শাসনের সহযোগিতা; তাদের কাছে ব্রিটিশ শাসনকে মনে হয়েছে দেবতার আশীর্বাদ। কবি ঈশ্বরগুপ্ত (১৮১১-১৮৫৯) লিখেছেন, “চিরকাল যেন হয় ব্রিটিশের জয়, ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়। এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়, শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয়।” উনবিংশ শতকের এই সব ঘটনা এখন বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে যে, বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমানদের মন মানসিকতা এ সময় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে থাকে, যা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছে। এ সময় থেকে হিন্দু-মুসলিম, দু’টি ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব ঘটে। এদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে হিন্দু মানসে একটা বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবোধের উন্মোষ ঘটতে থাকে, যাকে বলা চলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ইংরেজ আমলেই হিন্দুরা দেখতে থাকে এক বিশুদ্ধ হিন্দু রাজত্ব কায়েমের স্বপ্ন। যার ফলে কেবল ইংরেজ শাসনেরই অবসান ঘটবে না, ভারত ফিরে যাবে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতায়, হিন্দুদের কাছে ইংরেজদের মতো মুসলমানরাও এদেশে বহিরাগত ও বিধর্মী। তাদের সম্বন্ধেও গ্রহণ করতে হবে একই ধরনের নীতি। হিন্দুদের মধ্যে এক দল চায় বল প্রয়োগের মাধ্যমে ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে শাসন ক্ষমতা অধিকার করতে। যার ফলে শুরু হয় বিখ্যাত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। বাংলায় এই আন্দোলন লাভ করে এক অভূতপূর্ব গতি। সন্ত্রাসবাদীরা ইংরেজকে তাড়াবার শক্তি লাভ করবার জন্যে নিয়মিত করতেন কালী পূজা। আত্মশুদ্ধির জন্য করতেন গীতা পাঠ। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) উপন্যাস আনন্দ মঠ ছিলো এদেশের কাছে দেশপ্রেমের অন্যতম উৎসাহদাতা বই। যাতে ইংরেজকে নয়, মুসলমানকেই শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। আনন্দ মঠের স্বাধীনতা সংগ্রাম হলো বিশেষভাবে মুসলমানদের বিপক্ষে। এ প্রসঙ্গে মুজাফ্ফর আহমদ তার বিখ্যাত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমার মনে যে অবস্থা ছিলো, আর যে রোমাঞ্চ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে ছিলো তাতে আমার পক্ষে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলে যোগ দেয়া অসম্ভব ছিলো না। কিন্তু তার পথে দুস্তর বাধা ছিলো। বঙ্কিম চন্ত্র চট্টপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূলমন্ত্র ছিলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গান। তাতে আছে, “বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে ত্বমহি দুর্গা দশ প্রহরণ ধারিনী।” ইত্যাদি। একেশ্বরবাদী কোন মুসলিম ছেলে কি করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারতো? এই কথাটি হিন্দু কংগ্রেস নেতাও কোনদিন বুঝতে পারেন নি। বাংলাদেশেরে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন বলা হয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিলো। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিলো। উদ্দেশ্যে ছিলো হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্র কুমার ঘোষও আন্দামান হতে ফেরার পরে এই কথাই লিখেছিলেন। তার সেই বই এখন দুষ্প্রাপ্য। উনিশশ’ বিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মধ্যে সাধারণ পরিবর্তন শুরু হয়েছিলো। তবুও আমি ১৯২৩-২৪ সালে তাদের একজন বড় নেতাকে দেখেছি, যে বিকেলে তিনি জেলে এলেন, তার পরেই সকলেই জেল অফিসে একটা বিশেষ আকর্ষক কালীর ছবি বানানোর জন্য অর্ডার পাঠালেন। বাঙ্গালী হিন্দুরা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন আরম্ভ করেন ১৯০৫ সালের কাছাকাছি থেকে। সন্ত্রাসবাদীরা ইংরেজদের মেরে তাড়িয়ে দেখতেন এক বিশুদ্ধ হিন্দুরাজ্যগঠনের স্বপ্ন। বাংলার মুসলমান এতে যোগ দেয়নি। দিতেও পারেনি। সারা ভারত ইংরেজ আমলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে ঢেউ উঠে, তা মুসলমানদের ভীত করে তোলে। কবি রবি ঠাকুর, হিন্দু বঙ্গ প্রতিষ্ঠার মানসে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে অখ- বঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছেন বটে, কিন্তু তা যে ব্রিটিশ আমলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের জন্যে সম্ভব ছিলো না এবং তা তারই বিভিন্ন বিভিন্ন লেখায় পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। কবির ভাষায়- ‘আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি আমার নায়েব তার বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞাসা করলেন এ কেন’ — তখন জবাব পেলেম, যেসব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসতেও দিতে হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথাতো অনেকদিন ধরে চলে এসেছে, অনেকদিন মুসলমান এটা মেনে এসেছে। জাজিম তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিমপাতা আসনে অন্যে বসেছে। তারপর এদের ডেকে একদিন বলেছি, আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলত হবে। হঠাৎ দেখি অপরপক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ টুপি মাথায় দিয়ে বললো, আমরা পৃথক।” তাই শুধু প্রাক-ব্রিটিশ যুগে নয়, ব্রিটিশ আমলেও তাই সমগ্র বাংলার একটি সংস্কৃতির অধিকারী কোন সুসংবন্ধ সমাজ গড়ে উঠতে পারেনি। সংস্কৃতি ও জাতিত্বের দ্বন্দ্ব মূলত ছিলো ধর্মগত, যদিও এর প্রকাশ ঘটেছে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে, অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্প্রদায় ভিত্তিক হওয়ায়। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের খোলাখুলি আহ্বান ছিলো- “যবনদের ঔদ্ধত্য ধুলিস্যাৎ করিবার সুযোগ আসিয়াছে। এখন আমাদের সম্মুখে অনেক উজ্জ্বল আশা। বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হইবার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানেরা লুপ্ত হইয়া যাইবে, কেননা, তাহারা বাংলা পড়িতে বা লিখিতে এখনও সক্ষম নয়, কোনদিনই হইবেও না।” উল্লেখ্য, বাংলা চর্চার ক্ষেত্রেও পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়নি ব্রিটিশ আমলে। ইংরেজ আমলে কোম্পানীর শাসন থেকে সুবিধা অর্জন করে যারা জমিদারী লাভ করেছিলো তারা ছিলো হিন্দু এবং এদের থেকেই কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটে।
এ কারণে কলকাতা ও তার পার্শ¦বর্তী অঞ্চলের ভাষাই বাংলা গদ্য সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ড ভাষার মর্যাদা পায়। পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীর ভাষা, যার বেশির ভাগই ছিলো মুসলমান, সাহিত্যজ্ঞান থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হয়। ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণের ফলে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু তাদের জাতীয়তাবোধ ধর্মনিরপেক্ষ না হয়ে বরং হিন্দু পুনরুত্থানবাদের জন্ম দেয়। রামমোহন, মাইকেল, মধুসূধন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, কেশব চন্দ্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর- এরা সবাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করলেও তা হিন্দু ধর্মবোধের মধ্যে অবলোকন করেছিলো মুসলমানের সংস্কৃতি ও জীবনবোধ বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও জীববোধের মধ্যে সন্নিবেশিত করার কোনো প্রয়াস তাদের চেষ্টায় লক্ষণীয় নয়। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বহু আগেই ১৯০৫ সালে একবার বঙ্গ বিভক্তির ফলে স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো পূর্ব বাংলা নামে যা বাঙ্গালী হিন্দু জাতীয়তাবাদের চাপে টিকে থাকতে পারেনি। আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যে হিন্দু জাতীয়তাবোধেরই নামান্তর ছিলো, ভুদেবচন্দ্রের একটি লেখায় তা পরিস্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে- “ভারতীয় জাতীয়তার যে আদর্শ হিন্দু গড়িয়া তুলিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ হিন্দু জাতীয়তা, তাহাতে স্বতন্ত্র সত্ত্বাবিশিষ্ট অন্য সম্প্রদায়ের স্থান নাই। জৈন ও শিখদিগকে যখন সাধারণ হিন্দু সমাজের অন্তর্নিবিষ্ট বলিয়াই বোধ হয়, কালে এখানকার মুসলমানেরাও যে ভারত সমাজের মধ্যে একটি বর্ণ বিশেষরূপে লক্ষিত হইবে তাহার বিশেষ সম্ভাবনা।” এই বিশেষ সম্ভাবনাকে দূরীভূত করতেই বঙ্গভঙ্গ হয়েছিলো। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আমলে হিন্দু বঙ্গ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিলো তার প্রমাণ মেলে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে- হোসাইন আহমদ মাদানীর কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যেই। কংগ্রেসের কর্মসূচী ছিলো নিম্নরূপ- (ক) রাখী বন্ধন উৎসব- প্রত্যেকের বাহুতে লাল ফিতা বাধিতে হইবে। ইহা ভাতৃত্বের প্রতীক। ইহা প্রাচীন ভারতীয় (মানে হিন্দু) প্রথার পুনঃপ্রবর্তন। (খ) ১৯শে অক্টোবর উপবাসবৃত পালন করিতে হইব। খুব সকালে সকলকে খালি পায়ে হাটিয়া আত্মশুদ্ধির গঙ্গাস্নানে যাইতে হইবে ইত্যাদি শুধু এই মুসলিম বিরোধী কর্ম তালিকাই নয় উগ্র মুসলিম বিদ্বেষমূলক একটি সংগীত ‘জাতীয় সংগীত’ বলিয়া এই আন্দোলনের ভিতর দিয়া চালু করা হইলো। উহা বঙ্কিমচন্দ্রের সুবিখ্যাত ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত। বাঙ্গালী হিন্দু জাতীয়তাবাদ যদি ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদ দ্বারা অভিষিক্ত না হতো তবে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গের যে অখ-তা রক্ষা করা হয়েছিলো, পাকিস্তান সৃষ্টির সময় যখন বঙ্গ আবার বিভক্ত হচ্ছিলো, তখন বাংলার হিন্দু ভারতীয় জাতিসত্ত্বার দ্বারা এত আকৃষ্ট ছিলো যে, পাকিস্তান সৃষ্টির সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলাকে ছেড়ে দিতে তাদের এতটুকু বাধেনি। এ বিষয়টা ‘সওগাত’ এর মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। “আজ আমরা শুধু বিস্ময় ও কৌতুকের সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে, হিন্দু সমাজের স্বার্থে বাংলা প্রদেশটিকে দ্বিখন্ডিত করিতেও বাঙ্গালী হিন্দু ভ্রাতাদের আপত্তি নাই, অথচ বর্তমান বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এই বাঙ্গালী হিন্দুরাই তদানীন্তন বড় লাট লর্ড কার্জনের ব্যবস্থিত বঙ্গভঙ্গ রদ করিবার জন্য কী ভীষণ আন্দোলনই না চালাইয়াছিলেন। তারা বলিতে লাগিলেন, বাংলা এক ও অবিভাজ্য, তাকে দ্বী-খন্ডিত করিয়া বাঙ্গালী হইতে বাঙ্গালী হিন্দু ভ্রাতাদের মনের কথা ছিলো না। তখন বাংলায় যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু ছিলো, তাতে হিন্দুরাই আধিপত্য করিতেন, মুসলিমরা পড়িয়াছিলেন উপেক্ষার আস্তাকুঁড়ে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে হিন্দুরা এরূপ প্রাধান্য পান নাই। পাইয়াছিলেন মুসলিমেরা। তাই অখন্ড বাংলার জন্য বাঙ্গালী হিন্দুর প্রাণ কাঁদিয়া উঠিয়াছিলো। আজ আর সে অবস্থা নাই। বাংলায় আজ মুসলিমরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং সংখ্যার দিক দিয়া তাহাদের এই গুরুত্বের আইনের দ্বারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে প্রতিফলিত হইতে পারিয়াছে। সুতরাং বাংলার অখন্ডের মধ্যে বাঙ্গালী মুসলিমকে আজ যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হইতে হটাইবার উপায় নেই, তখন অন্তত পশ্চিমবঙ্গকে সমগ্র প্রদেশ ইহতে কাটিয়া আলাদা করা হউক। কেননা, পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং সেখানে স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র স্থাপিত হইলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে তাহাদের আধিপত্য হইবে। বাংলার অখন্ড সত্ত্বা রক্ষার জন্য বাঙ্গালী হিন্দু ভ্রাতাদের মাথাব্যথা হওয়া না হওয়ার মূল রহস্য যদি এটাই হয় তাহা হইলে ভৌগলিক, সামরিক প্রভৃতি নানা বিষয়ক যুক্তি দিয়া আজ যে তাহারা অখন্ড ভারতের প্রতি দরদ দেখাইতেছেন, সেগুলির অসাঢ়ত্ব সহজেই লোকচক্ষে ধরা পড়িবে।” হোসাইন আহমদ মাদানীর কংগ্রেস রাজনীতির এ দিকটি পর্যবেক্ষণ করে রাজনীতিবিদ আবুলগ মনসুর আহমদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন- “কংগ্রেস আজ ভারতের চল্লিশ কোটি লোককে এক জাতি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একমাত্র ইংরেজ বিদ্বেষই যদি ‘জাতিত্বে’র মাপকাঠি হয়, তবে গোটা ভারতবাসী নিশ্চয় এক জাতি। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকেমুক্তি পাবার প্রবল বাসনা ‘জাতিত্বে’র খুটিনাটির দিকে ভারতবাসী এতকাল মন ফেরাতে পারেনি। তবু ১৯২৫ সালে মরহুম ডাঃ আনসারীর নেতৃত্বে সমস্ত কংগ্রেসী মুসলিম অবশিষ্ট প্রাদেশিক পূর্ণ স্বায়স্তশাসন দাবি করেন। মিঃ জিন্নাহ্রর চৌদ্দ দফার কথা তুললামনা। খোদ কংগ্রেসী মুসলমানদের দাবির কথাই বললাম। এ দাবির প্রতিও কংগ্রেসী হিন্দু নেতারা কান দেননি। ১৯২৮ সালের নেহেরু রিপোর্ট ভারতের জন্য এককেন্দ্রিক গভর্নমেন্টের সুপারিশ করেন। আলী ভাইয়ের মত কংগ্রেস নেতারাও কংগ্রেস ত্যাগ করেন। কংগ্রেস স্বমতে অটল থাকেন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন স্বীকৃত হয়েছে। অথচ কংগ্রেস উহা ধ্বংস করার সংকল্প করেন।” উল্লেখ্য, জাতীয়তাবাদের সাথে যেমন জাতীয় স্বাধীনতার সম্পর্ক, তেমনি সম্পর্ক জাতীয় সংস্কৃতির। আর জাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে ছোট-বড় নানা উপাদান থাকলেও এর মূল উপাদান ধর্ম। প্রাচ্য দেশে ধর্ম সমাজ জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে থাকে বলেই ‘ডিসকভারী অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে পন্ডিত জওয়াহরলাল নেহেরু বলতে পেরেছিলেন, হিন্দু ধর্মই (হিন্দুইজম) ভারতীয় সংস্কৃতির মূল প্রবাহ। আমরা ভেবে আশ্চর্য হই, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীর পক্ষে হিন্দুদের এতসব প্রকাশ্য প্রমাণ, মুসলমানদের প্রতি তাদের নির্মমরোষ ও অত্যাচারের এতসব জ্বলন্ত ইতিহাস, সমসাময়িক তথ্য ও বক্তব্য থাকার পরও মাদানী ছাহেব কি করে কংগ্রেসের এত নির্লজ্জ দালালী করতে পারলেন?
চরম মুসলমান বিদ্বেষী হিন্দুদের সাথে থেকে এক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা সাজতে পারলেন?
তার তো অন্ততঃ কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের এই বিষয়টি জানা থাকা উচিত ছিলো যে, ‘সব কাফিরের ধর্ম এক’ বা সব কাফিরই মূলত: ইসলাম বিদ্বেষী। মূলতঃ কংগ্রেসের নির্লজ্জ দালালী হোসাইন আহমদ মাদানীর অন্তর থেকে শেষ ইসলামী অনুভূতিটুকুও বিদূরিত করেছিলো। (নাউযুবিল্লাহ) প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মাদানী ছাহেব যেমন চরম ভুল ও কুফরী করেছিলো এক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা সেজে তেমনি তার উত্তরসূরী বর্তমান দেওবন্দী, খারিজীরা একইভাবে কুফরী ও ভুল করছে ইসলামের নামে হারাম গণতন্ত্র ও নির্বাচন করে। কথায় বলে, “যেমনি উস্তাদ, তেমনি শিষ্য।”
-মুহম্মদ তারীফুর রহমান, ঢাকা।
ব্রিটিশ গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি এবং ওহাবী মতবাদের নেপথ্যে ব্রিটিশ ভূমিকা-৩২