ফতওয়া বিভাগ- গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ  কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মুর্তি তৈরী করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-৩

সংখ্যা: ১৭১তম সংখ্যা | বিভাগ:

প্রকাশিত ফতওয়াসমূহ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীনের জন্যে এবং অসংখ্য দুরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহ্মতে “গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী এবং হানাফী মাযহাব-এর অনুসরণে প্রকাশিত একমাত্র দলীল ভিত্তিক যামানার তাজদীদী মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় যথাক্রমে ১. টুপির ফতওয়া (২য় সংখ্যা) ২. অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান (৩য় সংখ্যা) ৩. নিয়ত করে মাজার শরীফ যিয়ারত করা (৪র্থ সংখ্যা) ৪. ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া (৫ম-৭ম সংখ্যা) ৫. জুমুয়ার নামায ফরযে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া (৮ম-১০ম সংখ্যা) ৬. মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী সম্পর্কে ফতওয়া (১১তম সংখ্যা) ৭. কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১২তম সংখ্যা) ৮. তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৩তম সংখ্যা) ৯. ফরয নামাযের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৪-২০তম সংখ্যা) ১০. ইন্জেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২১-২২তম সংখ্যা) ১১. তারাবীহ্-এর নামাযে বা অন্যান্য সময় কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২৩-২৪তম সংখ্যা) ১২. তারাবীহ্ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (২৫-২৯তম সংখ্যা) ১৩. দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৩০-৩৪তম সংখ্যা) ১৪. প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৩৫-৪৬তম সংখ্যা) ১৫. আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৪৭-৫০তম সংখ্যা) ১৬. দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীন-এর শরয়ী ফায়সালা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৫১-৫২তম সংখ্যা) ১৭. খাছ সুন্নতী টুপি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৫৩-৫৯তম সংখ্যা) ১৮. নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৬০-৮২তম সংখ্যা) ১৯. ইমামাহ্ বা পাগড়ী মুবারকের আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়া (৮৩-৯৬তম সংখ্যা) ২০. শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (৯৭-১০০তম সংখ্যা)  ২১. জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১০১-১১১তম সংখ্যায়) এবং  ২২. হিজাব বা পর্দা ফরযে আইন হওয়ার প্রমাণ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১১২-১৩১তম সংখ্যা) ২৩. খাছ সুন্নতী ক্বমীছ বা কোর্তা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৪০তম সংখ্যা) ২৪. হানাফী মাযহাব মতে ফজর নামাযে কুনূত বা কুনূতে নাযেলা পাঠ করা নাজায়িয ও নামায ফাসিদ হওয়ার কারণ এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৩২-১৫২তম সংখ্যা) ২৫. ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বকাপ ফুটবল বা খেলাধুলা’র শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট ফতওয়া (১৫৫তম সংখ্যা) ২৬. হানাফী মাযহাব মতে পুরুষের জন্য লাল রংয়ের পোশাক তথা রুমাল, পাগড়ী, কোর্তা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি পরিধান বা ব্যবহার করা হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া (১৫৩-১৬০তম সংখ্যা) ২৭.  এবং ১৬১তম সংখ্যা থেকে ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া পেশ করার পাশাপাশি ১৬৮তম সংখ্যা থেকে-

২৮তম ফতওয়া হিসেবে

“কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মুর্তি তৈরী করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্ট প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক-এর দরবারে বেশুমার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মুর্তি তৈরী করা, করানো ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম নাজায়িয হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ

 সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফরী, শিরিকী ও বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায়  বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক তাজদীদী মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় এ যাবৎ যত লেখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে” এমন সব লেখাই পত্রস্থ  হয়, যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ ও হিফাযতকরণে বিশেষ সহায়ক।  বর্তমানে ইহুদীদের এজেন্ট হিসেবে মুসলমানদের ঈমান আমলের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করছে যারা, তারা হলো- ‘ওহাবী সম্প্রদায়’। ইহুদীদের এজেন্ট ওহাবী মতাবলম্বী উলামায়ে ‘ছূ’রা হারাম টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, কিতাবাদি ও বক্তব্য বা বিবৃতির মাধ্যমে একের পর এক হারামকে হালাল, হালালকে হারাম, জায়িযকে নাজায়িয, নাজায়িযকে জায়িয বলে প্রচার করছে।  স্মরনীয় যে, ইহুদীদের এজেন্ট, ওহাবী মতাবলম্বী দাজ্জালে কায্যাব তথা উলামায়ে ‘ছূ’রা প্রচার করছে “ছবি তোলার ব্যাপারে ধর্মীয় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই” (নাউযুবিল্লাহ)। সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, “নির্বাচন কমিশনার বলেছে, ছবি তোলার বিরুদ্ধে বললে জেল-জরিমানা হবে, নির্বাচন কমিশনার ভোটার আই. ডি কার্ডের জন্য ছবিকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং ছবির পক্ষে মসজিদে মসজিদে প্রচারণা চালাবে বলেও মন্তব্য করেছে।  আর উলামায়ে ‘ছূ’রা তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছে যে, “রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে পুরুষ-মহিলা সকলের জন্যই ছবি তোলা জায়িয।” (নাউযুবিল্লাহ) শুধু তাই নয় তারা নিজেরাও অহরহ ছবি তুলে বা তোলায়। অথচ তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, চরম বিভ্রান্তিকর ও কুফরীমূলক। তাদের এ বক্তব্যের কারণে তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত কুফরীমূলক বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তেক্বাদী বা আক্বীদাগত ও আ’মালী বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হচ্ছে। কারণ, তাদের উক্ত বক্তব্যের কারণে যারা এ আক্বীদা পোষণ করবে যে, “রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ছবি তোলা জায়িয” তারা ঈমান হারা হয়ে কাট্টা কাফির ও চির জাহান্নামী হবে। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম বা নাজায়িযকে হালাল বা জায়িয বলা কুফরী। কেননা কিতাবে স্পষ্টই উল্লেখ আছে যে,

استحلال المعصية كفر.

 অর্থাৎ, “গুণাহের কাজ বা হারামকে হালাল মনে করা কুফরী।” (শরহে আক্বাঈদে নাসাফী)       অতএব বলার আর অপেক্ষাই রাখেনা যে, উলামায়ে “ছূ”দের উক্ত বক্তব্য সাধারণ মুসলমানদের আক্বীদা বা ঈমানের জন্য বিশেষভাবে হুমকিস্বরূপ।  অনরূপ “ছবি তোলার ব্যাপারে ধর্মীয় কোন নিষেধ নেই বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সকলের জন্য ছবি তোলা জায়িয” উলামায়ে “ছূ”দর এ কুফরীমূলক বক্তব্য সাধারণ মুসলমানদের আমলের ক্ষেত্রেও বিশেষ ক্ষতির কারণ। কেননা যারা তাদের উক্ত বক্তব্যের কারণে ছবি তুলবে (যদিও হারাম জেনেই তুলুক না কেন) তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত কাজে তথা হারাম কাজে মশগুল হবে যা শক্ত আযাব বা কঠিন গুণাহের কারণ। কেননা হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

قال حدثنا الاعمش عن مسلم قال كنا مع مسروق فى دار يسار بن نمير فراى فى صفته تماثيل فقال سمعت عبد الله قال سمعت النبى صلى الله عليه وسلم يقول ان اشد الناس عذابا عند الله المصورون.

 অর্থঃ হযরত আ’মাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মুসলিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মাসরুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর সঙ্গে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম, তিনি তাঁর ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখতে পেলেন, অতঃপর বললেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ্র নিকট শুনেছি, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ্ পাক কঠিন শাস্তি দেবেন, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি তোলে বা আঁকে।” (বুখারী শরীফ ২য় জিঃ, পৃঃ৮৮০)  উক্ত হাদীছ শরীফের ব্যাখ্যায় “উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারীতে” উল্লেখ আছে,

وان كاهن ورد فى حق عاص فيكون اشد عذابا من غيره من العصاة ويكون ذلك ذالا على المعصية المذكورة. وفى التوضيح قال اصحابنا وغيرهم صورة الحيوان حرام اشد التجريم وهم من الكبائر.

অর্থঃ “তাওজীহ্” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত উলামায়ে কিরাম বলেন, জীব জন্তুর ছবি বা প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা নিষেধ, বরং কঠোর নিষিদ্ধ কাজ (অর্থাৎ হারাম) এটা কবীরাহ্ গুনাহ্। অতএব, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উলমায়ে “ছূ”দের উক্ত বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ছবি তুলে প্রকাশ্য হারাম কাজে মশগুল হয়ে কঠিন আযাবের পাত্র হবে যা আমলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ক্ষতিকর। কাজেই যারা এ ধরণের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী ও কুফরী বক্তব্য প্রদানকারী তারা ও হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণ ঈমান ও আমলকে যেন হিফাযত করতে পারে। অর্থাৎ মূর্তি বা ছবিসহ সকল বিষয়ে আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করতে পারে এবং কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজাম, ইজমা ও ক্বিয়াস মোতাবেক আমল করে আল্লাহ্ পাক-এর রেজামন্দী হাছিল করতে পারে। সে জন্যই “কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে প্রাণীর মুর্তি তৈরী করা ও ছবি আঁকা, তোলা, তোলানো, রাখা, রাখানো, দেখা, দেখানো হারাম- নাজায়িয হওয়ার অকাট্ট প্রমাণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়াটি” পুণরায় প্রকাশ করা হলো।

(পূর্ প্রকাশিতের পর)

ইসলাম বা শরীয়তে হালাল ও হারামের বিধান!

নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনিত “দ্বীন ইসলমাই একমাত্র পরিপূর্ণ দ্বীন।” যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

 এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ‘সূরা মায়িদার’ ৩নং আয়াত শরীফে ইরশাদ করেন,

اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا

অর্থঃ- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

          উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, “দ্বীন ইসলাম” পরিপূর্ণ অর্থাৎ দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল বিষয়ের ফায়ছালা বা সব সমস্যার সমাধান দ্বীন ইসলামে রয়েছে। নিম্মোক্ত ঘটনা দ্বারা বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।

          একবার ইহুদী সম্প্রদায়ের কিছু লোক খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর দরবার শরীফে আসলো, এসে বললো- হে আমীরুল মু’মিনীন, আল্লাহ্ পাক আপনাদের দ্বীন-ইসলামে তথা আসমানী কিতাব, পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফে একখানা আয়াত শরীফ নাযিল করেছেন, সে আয়াত শরীফখানা যদি আমাদের ইহুদী ধর্মে বা আমাদের কোন আসমানী কিতাবে নাযিল হতো, তবে আমরা যেদিন এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে, সেদিনকে ঈদের দিন বা খুশির দিন হিসাবে ঘোষণা করতাম।

          তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন- “হে ইহুদী সম্প্রদায়, সেটি কোন আয়াত শরীফ? যে আয়াত শরীফখানা তোমাদের ধর্মে নাযিল হলে তোমরা সেদিনকে ঈদের দিন হিসাবে ঘোষণা করতে? ইহুদী সম্প্রদায় বললো- তা ‘সূরা মায়িদার’ ৩নং আয়াত শরীফ, যেখানে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا

অর্থঃ- “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করলাম, তোমাদের জন্যে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

এ আয়াত শরীফ শুনে আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন- হে ইহুদী সম্প্রদায় তোমাদের কি জানা আছে? এ আয়াত শরীফখানা কোথায়, কবে, কখন নাযিল হয়েছে? তারা বললো- না, আমাদের তা জানা নেই। তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “দেখ এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে বিদায় হজ্বের সময়, আরাফার ময়দানে, শুক্রবার দিন, আছরের ওয়াক্তে। সুতরাং হজ্জের দিন আমাদের জন্যে ঈদ ও খুশির দিন, শুক্রবার দিনও আমাদের জন্যে ঈদ ও খুশির দিন, কাজেই আয়াত শরীফের শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে আমাদের (মুসলমানদেরকে) আলাদাভাবে কোন ঈদ ও খুশির দিনের ব্যবস্থা করতে হবেনা।” (সুবহানাল্লাহ্)

          উপরোক্ত ঘটনা বা ওয়াক্বেয়া হতে আমরা এ কথাই বুঝতে পারলাম যে, মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন উম্মতে মুহম্মদীর জন্যে দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দ্বীন ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন বা ধর্মই পরিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ সবই অপূর্ণ ছিল এবং বর্তমানেও অপূর্ণ রয়েছে। একমাত্র দ্বীন ইসলামই পরিপূর্ণ। অর্থাৎ দ্বীন ইসলামেই রয়েছে সকল বিষয়ের ফায়ছালা বা বর্ণনা। আর তাই আল্লাহ্ পাক বলেন,

كل فى كتاب مبين

অর্থঃ “সুস্পষ্ট কিতাবে (অর্থাৎ কুরআন শরীফে) সব কিছুই রয়েছে।” (সূরা হুদ-৬)     অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

ما فرطنا فى الكتب من شىء

অর্থঃ- “আমি এ কিতাবে কোন কিছুই বর্ণনা করতে ছেড়ে দেইনি।” (সূরা আনয়াম-৩৮)      আল্লাহ্ পাক এ প্রসঙ্গে আরো বলেন,

ولا رطب ولا يابس الا فى كتاب مبين

অর্থঃ “শুকনা এবং ভিজা এমন কিছুই নেই, যা এ স্পষ্ট কিতাবে উল্লেখ করা হয় নাই।” (সূরা আন্য়াম-৫৯)

এ প্রসঙ্গে কিতাবে একটি ওয়াক্বেয়া উল্লেখ আছে- হানাফী মায্হাবের ইমাম, ইমামুল মুহাদ্দিছীন, ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি একবার কিতাব মুতালেয়াহ করার সময় পিপাসিত হয়ে যান। তাঁর হুজরা শরীফের পাশেই এক ব্যক্তি শরবত বিক্রি করতো। তিনি পানি পিপাসা নিবারনের জন্য শরবত ওয়ালাকে গিয়ে বললেন- ভাই শরবত ওয়ালা, তুমি আমাকে এক গ্লাস শরবত পান করাও, এর বিনিময়ে আমি তোমাকে একটি জরুরী মাসয়ালা শিক্ষা দিব। শরবত ওয়ালা বললো- মাসয়ালার বিনিময়ে আমার শরবত বিক্রি হয়না, আমার শরবত পান করতে হলে পয়সা লাগবে। ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট যেহেতু কোন পয়সা ছিলনা, সেহেতু তিনি শরবত পান না করেই চলে গেলেন।

          এদিকে শরবত ওয়ালা তার মেয়েকে বিবাহ দিবে, বিবাহের বিষয়াদি নিয়ে ছেলে পক্ষের অভিবাবকদের সাথে আলোচনা হচ্ছিল। ছেলের পক্ষ শরবত ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলো- আপনি মেয়ের বিয়েতে কি কি দিবেন? শরবত ওয়ালা বললো- যা চান, তাই দিব। ছেলের পক্ষ বললো- তুমি সাধারণ শরবত ওয়ালা, তুমি যা চাব, তা কি করে দিবে? কিছুক্ষণ কথা কাটা কাটির পর শরবত ওয়ালা রাগ হয়ে বলে উঠলো- আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব দিব। যদি না দিতে পারি, তবে আমার স্ত্রী তালাক। ছেলের পক্ষ তায়াজ্জুব হয়ে বললো- প্রথমে নিজ স্ত্রীর ব্যপারে ফায়ছালা করুন, অতঃপর মেয়ের বিয়ের ব্যপারে আলোচনা হবে।

          শরবত ওয়ালা তার স্ত্রীর তালাক সংক্রান্ত বিষয়ের ফায়ছালার জন্য আলিমদের দরবারে ঘুরতে লাগলো, কিন্তু কেউ তার ফায়সালা দিতে পারলোনা। শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে শরবত ওয়ালা হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবারে উপস্থিত হলো এবং উক্ত বিষয়ের ফায়সালা কামনা করলো। ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, সে দিন শরবতের বিনিময়ে এই মাসয়ালাটিই তোমাকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। তুমি সেদিন শরবতের বিনিময়ে পয়সা চেয়েছিলে, আজ আমার কাছ থেকে ফতওয়া নিতে হলে এক হাজার দেরহাম লাগবে। শরবত ওয়ালা এক হাজার দেরহাম নিয়ে আসলো। ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন ফতওয়া দিলেন, “তোমার মেয়ের বিয়েতে এক জিল্দ কুরআন শরীফ দিয়ে দাও, তোমার স্ত্রী তালাক হবেনা। কারণ আল্লাহ্ পাক কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

ولا رطب ولا يابس الا فى كتاب مبين

অর্থঃ “শুকনা এবং ভিজা এমন কিছুই নেই, যা এ স্পষ্ট কিতাবে উল্লেখ করা হয় নাই।” (সূরা আন্য়াম-৫৯)         অর্থাৎ আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, তার চাইতেও বেশী কুরআন শরীফে রয়েছে। (সুবহানাল্লাহ্)

অতএব  প্রমাণিত হলো যে, কুরআন শরীফ তথা দ্বীন ইসলামে সব বিষয়ের ফায়ছালাই রয়েছে। অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আর দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ বলেই মহান আল্লাহ পাক প্রত্যেক ঈমানদারকে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে বলেছেন। আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

يايها الذين امنوا ادخلوا فى السلم كافة ولاتتبعوا خطوت الشيطان انه لكم عدو مبين

অর্থঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ কর, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাক্বারা-২০৮)

          অর্থাৎ জীন ও মানব জাতির জন্যে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুকুম মোতাবেক চলতে হলে যা কিছুর দরকার অর্থাৎ ব্যক্তিগত পর্যায় হতে শুরু করে, সকল পর্যায় পর্যন্ত, তার পায়ের তলা হতে মাথার তালু পর্যন্ত, তার হায়াত হতে মৃত্যু পর্যন্ত, এক কথায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত সমস্যারই উদ্ভব হোক না কেন, সকল বিষয়েরই ফায়ছালা বা সমাধান দ্বীন-ইসলামের মধ্যে রয়েছে।

এখন কেউ যদি ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ করতে চায় বা অনুসরণ করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই যেরূপ কুরআন শরীফকে অনুসরণ করতে হবে তদ্রুপ অনুসরণ করতে হবে হাদীছ শরীফ এবং কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের ভিত্তিতে ইজমা ও ক্বিয়াসকে। কারণ যারা শুধু কুরআন শরীফ মানে কিন্তু হাদীছ শরীফ মানে না তারা যেরূপ কাফির অনুরূপ যারা হাদীছ শরীফ মানে কিন্তু কুরআন শরীফ মানেনা তারাও কাফির। অনুরূপভাবে যারা ইজমা ও ক্বিয়াসকে   অস্বীকার করে তারাও গুমরাহ, পথভ্রষ্ট। কেননা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ ব্যতীত যেরূপ ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ করা সম্ভব নয় তদ্রুপ ইজমা ও ক্বিয়াস ব্যতীতও ইসলামকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ ইসলাম বা শরীয়তে কোনটা হালাল, কোনটা হারাম, কোনটা জায়িয কোনটা নাজায়িয, কোনটা ফরয, কোনটা ওয়াজিব, কোনটা সুন্নত, কোনটা মুস্তাহাব, কোনটা মাকরূহ, কোনটা মুবাহ ইত্যাদি সবকিছুর মানদ- হচ্ছে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস। আর এ চারটিই মূলতঃ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের উছূল বা দলীল।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের

দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়তের উছূল

আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া হলো, শরীয়তের কোন বিষয়ের মীমাংসা বা ফায়ছালা করতে হলে বিশেষ করে হালাল-হারামের ফায়ছালা করতে হলে তা অবশ্যই কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের  দৃষ্টিতেই করতে হবে, এর বাইরে কোন কথা বা কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়তের ভিত্তি বা দলীলই হলো উপরোক্ত চারটি।

          এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে উল্লেখ আছে যে,

اصول الشرع ثلثة القران والحديث والاجماع ورابعها القياس

অর্থঃ “মূলতঃ শরীয়তের ভিত্তি হলো তিনটি। কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা এবং চতুর্থ হলো- ক্বিয়াস।” (নূরুল আনওয়ার)

১. কুরআন শরীফ

মূলতঃ কুরআন শরীফের সম্পূর্ণটাই আল্লাহ্ পাক-এর ওহীয়ে মাত্লূ-এর অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন,

وما ينطق عن الهوى ان هو الا وحى يوحى

অর্থঃ “রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তিনি কোন কথাই ওহী ব্যতীত নিজ থেকে বলেন না।” (সূরা নজম-৩,৪)

          শুধু তাই নয়, উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, হাদীছ শরীফগুলোও কুরআন শরীফের ন্যায় ওহী-এর অন্তর্ভূক্ত। আর তাই ওহীকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১। ওহীয়ে মাতলূ অর্থাৎ কুরআন শরীফ, যা তিলাওয়াত করা হয়।

২। ওহীয়ে গায়রে মাতলূ অর্থাৎ হাদীছ শরীফ যা তিলাওয়াত করা হয় না।

মূলতঃ কুরআন শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য কুরআন শরীফের হুকুম-আহ্কাম, আদেশ-নিষেধ মেনে চলা অপরিহার্য। কারণ বিপথগামী, পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে হিদায়েতের পথে আনার জন্যই মহান আল্লাহ্ রব্বুল ইজ্জত পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফ অবতীর্ণ করেন।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ ফরমান,

كتاب انزلنه اليك لتخرج الناس من الظلمت الى النور

অর্থঃ “আমি এ কিতাবকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, মানুষদেরকে গোম্রাহী হতে হিদায়েতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।” (সূরা ইব্রাহীম-১)

সুতরাং যাঁরা এ কুরআন শরীফের আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ করবে, তাঁরা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে, আর যারা অনুসরণ করবেনা, তারা গোম্রাহীর মধ্যে নিপতিত থাকবে।

আর তাই কুরআন শরীফের অসংখ্য স্থানে কালামুল্লাহ্ শরীফের হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

فاما ياتينكم منى هدى فمن تبع هداى فلا خوف عليهم ولاهم يحزنون.

অর্থঃ “আর যখন আমার পক্ষ হতে তোমাদের জন্য হিদায়েতের বাণী আসবে, আর এ হিদায়েতবাণীকে (কুরআন শরীফকে) যাঁরা অনুসরণ করবে, তাঁদের কোন ভয় নেই এবং চিন্তা নেই।” (সুরা বাক্বারা-৩৮)

          আল্লাহ্ পাক অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন,

اتبعوا ما انزل اليكم من ربكم

অর্থঃ “তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট যা (কুরআন শরীফ) অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর।” (সুরা আ’রাফ-৩)

          কালামুল্লাহ্ শরীফে এ প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ হয়েছে,

واتبعوا النور الذى انزل معه اولئك هم المفلحون

অর্থঃ “সেই নূরের (কুরআন শরীফ-এর) অনুসরণ কর, যা তাঁর (রসূল-এর) উপর অবতীর্ণ হয়েছে, (যারা এরূপ করবে) তারাই সফলকাম।” (সূরা আ’রাফ-১৫৭)

আর তাই আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

خذوا ما اتينكم بقوة

অর্থঃ “তোমাদেরকে যা দিয়েছি, (কুরআন শরীফ) তা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধর।”  (সূরা বাক্বারা-৬৩)

          সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কুরআন শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং কুরআন শরীফকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য।

২. হাদীছ শরীফ

          কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীছ শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল। কারণ হাদীছ শরীফ ব্যতীত উম্মতের জন্য কুরআন শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করা এবং ইসলামকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করা কোন দিনও সম্ভব নয়। আর তাই হাদীছ শরীফকে কুরআন শরীফের তাফসীর বা ব্যাখ্যা বলা হয়ে থাকে। মূলতঃ হাদীছ শরীফও ওহী-এর অন্তর্ভূক্ত।  অর্থাৎ ওহীয়ে গায়রে মাত্লূ।

অতএব, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীছ শরীফ মানা ও তার অনুসরণ-অনুকরণ করাও অবশ্যই কর্তব্য। আর তাই আল্লাহ্ পাক কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ করেন,

وما اتاكم الرسول فخذوه وما نهكم عنه فانتهوا

অর্থঃ “আমার রসূল (ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন, তা আঁকড়িয়ে ধর এবং যার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তার থেকে বিরত থাক।” (সূরা হাশর-৭)

          উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হাদীছ শরীফের অনুসরণ-অনুকরণ করা ফরয প্রমাণিত হয়। সুতরাং যারা হাদীছ শরীফ অস্বীকার করবে এবং তার অনুসরণ-অনুকরণ করবেনা, তারা গোম্রাহ্ ও বাতিল এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

যেমন, আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন বলেন,

فليحذر الذين يخالفون عن امره ان تصيبهم فتنة او يصيبهم عذاب اليم.

অর্থঃ “সুতরাং যারা তাঁর (রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ) আদেশের বিরোধীতা করে, তাদের ভয় করা উচিত যে, তাদের উপর এসে পড়বে কোন ফিতনা বা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”  (সূরা নূর-৬৩)

আর এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن ابى رافع رضى الله تعالى عنه قال قال النبى صلى الله عليه وسلم لا الفئن احدكم متكئا على اريكته ياتيه الامر من امرى مما امرت به ونهيت عنه فيقول لا ادرى ما وجدنا فى كتاب الله اتبعناه

অর্থঃ “হযরত আবু রা’ফে রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- রসূলে মকবূল ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে। আর তার নিকট আমার আদেশাবলীর কোন একটি আদেশ পৌঁছল, যাতে আমি কোন বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করেছি। তখন সে বলবে, আমি এসব কিছু জানিনা, আল্লাহ্র কিতাবে যা পাবো, তাই অনুসরণ করবো।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ্, আহ্মদ, মিশকাত, মায়ারিফুস্ সুনান, বযলুল মাজহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

عن العرباض بن سارية رضى الله تعالى عنه قال قام رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ايحسب احدكم متكئا على اريكته يظن ان الله لم يحرم شيئا الا ما فى هذا القران الا وانى والله قد امرت ووعظت ونهيت عن اشياء انها لمثل القران او اكثر وان الله لم يحل لكم ان تدخلو بيوت اهل الكتاب الا باذن ولا ضرب نسائهم ولا اكل ثمارهم اذا اعطوكم الذى عليهم.

অর্থঃ হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একদিন আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমাদের মধ্যে) দাঁড়ালেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার গদিতে হেলান দিয়ে একথা মনে করে যে, আল্লাহ পাক যা এ কুরআন শরীফে হারাম করেছেন তা ব্যতীত তিনি আর কিছুই হারাম করেননি। তোমরা জেনে রাখ, আমি আল্লাহ পাক-এর কসম করে বলছি! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেক বিষয় আদেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং অনেক বিষয় নিষেধও করেছি, আমার এরূপ বিষয়ও নিশ্চয়ই কুরআন শরীফ-এর বিষয়ের সমান; বরং তা হতেও অধিক হবে। তোমরা মনে রাখবে যে, অনুমতি ব্যতীত আহ্লে কিতাব যিম্মীদের বসতঘরে প্রবেশ করা, তাদের নারীদের প্রহার করা এবং তাদের ফল-শস্য খাওয়াকেও আল্লাহ পাক তোমাদের জন্য হালাল করেননি, যদি তারা তাদের উপর নির্ধারিত কর আদায় করে দেয়। (অথচ এ সকল বিষয় কুরআন শরীফে নেই। আমার মারফতই আল্লাহ পাক হারাম করেছেন) (আবু দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ)

উল্লেখিত হাদীছ শরীফসমূহ দ্বারা বুঝা যায় যে, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীছ শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল। বরং ক্ষেত্র বিশেষে হাদীছ শরীফের গুরুত্ব আরো বেশি।

কাজেই, উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তার অনুসরণ ও অনুকরণ করা অবশ্যই কর্তব্য তথা ফরয। সুতরাং যারা কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফকে অনুসরণ করবে না, দলীল হিসেবে মানবে না, তারা কাট্টা কাফির, গোম্রাহ ও পথভ্রষ্ট হবে।

আর তাই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن مالك بن انس مرسلا قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم  تركت فيكم امرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنة رسوله.

অর্থঃ “হযরত মালিক ইবনে আনাস রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে মুরসালসূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা সে দু’টিকে আঁকড়িয়ে থাকবে, গোমরাহ হবেনা। একটি হলো- আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব ‘কুরআন শরীফ’, আরেকটি হলো- আল্লাহ পাক-এর হাবীবের সুন্নত ‘হাদীছ শরীফ’।” (মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)

          সুতরাং যারা এ দু’টোর অনুসরণ করবে, তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর যারা এর বিপরীত করবে, তারা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে।

          অতএব, প্রমাণিত হলো যে, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীছ শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল।

৩. ইজ্মা

          যে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি, সে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করতঃ হুকুম সাবিত করতে হবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরণের ইজ্তিহাদ করা আল্লাহ্ পাক ও রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই নির্দেশ।  যেমন, কালামে পাকে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

فاعتبروا ياولى الابصار

অর্থঃ- “হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর-২)

          আর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন-

بم تقضى يا معاذ فقال بكتاب الله قال فان لم تجد قال بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فان لم تجد قال اجتهد برائى فقال الحمد لله الذى وفق رسول الله بما يرضى به رسوله.

অর্থঃ    “হে মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু আনহু! তোমার নিকট কোন মুকাদ্দমা আসলে কিভাবে তা ফায়ছালা করবে? হযরত মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাবের দ্বারা। যদি তাতে না পাও তাহলে? আল্লাহ্ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, যদি তাতেও না পাও তাহলে? আমি কিতাব ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে ইজ্তিহাদ করে রায় দিবো। এ উত্তর শুনে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাক-এর, যিনি তাঁর রসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে তাঁর রসূল সন্তুষ্ট হন।” (আহমদ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তালীক্বুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব, আশয়াতুল লুমুয়াত)

          এটা হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুসলমানদের কল্যণার্থে ও কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করা কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফেরই নির্দেশ।

উল্লেখ্য,যে ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালা এককভাবে রয়েছে, সেটাকে বলা হয় ক্বিয়াস। আর ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালার মধ্যে যেগুলোর উপর মুজ্তাহিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন, শরীয়তে তাকেই ইজ্মা বলা হয়।

 ইজমার দলীল সম্পর্কে শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কুরআন শরীফ থেকে ইজমার দলীল বের করার উদ্দেশ্যে আমি তিন দিনে নয় বার কুরআন শরীফ খতম করি। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনশতবার কুরআন শরীফ খতম করি। অতঃপর আমি নিশ্চিত হই যে, নিম্নোক্ত আয়াত শরীফখানাই “ইজমার” দলীল। যেমন, ইরশাদ হয়েছে,

ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ونصله جهنم

অর্থঃ “কারো নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনগণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে সে দিকেই ফিরাবো, যে দিকে সে ফিরেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” (সূরা নিসা-১১৫)

 ক্ষেত্র বিশেষে ইজ্মার অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। যে ব্যক্তি উক্ত ইজ্মাকে (ইজমায়ে আযীমতকে) অস্বীকার করলো, সে কুফরী করলো।

এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,

فيكون الاجماع حجة يكفر جاحده كالكتاب والسنة

অর্থঃ “ইজ্মায়ে আযীমত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের মতই একটি অকাট্য দলীল। যে তা অস্বীকার করলো, সে মূলতঃ কুফরী করলো।” (তাফসীরে আহ্মদী)

          উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ইজ্মা শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তা অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য তথা ফরয।

ইজ্মার বিস্তারিত ব্যাখ্যা,

প্রকারভেদ ও আহকাম

ইজ্মার প্রকারভেদ ও আহকাম সম্পর্কে প্রখ্যাত আলিমেদ্বীন, ইমামুল উছূলিয়্যীন হযরত আবূ সাঈদ মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত কিতাব “নূরুল আনওয়ারে” লিখেন,

الاجماع وهو فى اللغة الاتفاق وفى الشريعة اتفاق مجتهدين صالحين من امة محمد صلى الله عليه وسلم فى عصر واحد على امر قول او فعل ركن الاجماع نوعان عزيمة وهو التكلم منهز بما يوجب الاتفاق اى اتفاق الكل على الحكم بان يقولوا اجمعنا على هذا ان كان ذالك الشىء من باب القول اوشروعهم فى الفعل ان كان من بابه اى كان ذالك الشىء من باب الفعل….. ورخصة وهو ان نتكلم او يفعل القص دون االبعض اى يتقف بعضهم على قول او فعل وسكت الباقون منهم ولا يردون عليهم بعد مضى مدة التامل وهى ثلاثة ايام او مجلس العلم ويسمى هذا اجماعا سكوتيا.

অর্থঃ “ইজ্মা” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঐক্যমত। আর শরীয়তে “ইজ্মা” বলা হয়, এক যামানায় উম্মতে মুহম্মদির সকল নেক্কার মুজতাহিদগণের কোন ক্বওল (কথা) ফে’ল (কাজ)-এর উপর ঐক্যমত পোষণ করাকে। “ইজ্মা” দু’প্রকার-

১. ইজ্মায়ে আযীমত

সকল মুজতাহিদগণ কোন বিষয়ে এমন শব্দ ব্যবহার করা যদ্বারা ঐক্যমত প্রমাণিত হয়। যেমন সকলেই বললো اجمعنا هذا অর্থাৎ আমরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত। এরূপ ইজ্মা ক্বওলী বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।  অথবা উক্ত বিষয়টি যদি ল্পম্ল‘ৈ হয়। আর সকলেই তা আমল করা শুরু করে দেয়, তবে এরূপ ইজ্মাকেই “ইজ্মায়ে আযীমত” বলে।

          ২.  ইজ্মায়ে রোখ্সত

ইজতিহাদকৃত ক্বওল বা ফে’ল এর উপর কেউ কেউ ঐক্যমত পোষণ করা আর কেউ কেউ পোষণ না করা। অর্থাৎ ইজতিহাদকৃত বিষয়ে কেউ কেউ ঐক্যমত পোষণ করেছে আর বাকী সকলে নিশ্চুপ রয়েছে। সংবাদ পৌঁছার তিন দিনের মধ্যে প্রতিবাদ করেনি। এরূপ ইজ্মাকেই “ইজমায়ে রোখসত” বলে। এর অপর নাম হচ্ছে “সূকূতী”। (নূরুল আনওয়ার মাআ আযহুরিল আযহার ৩১৬ পৃষ্ঠা)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মুজ্তাহিদ অর্থাৎ যিনি ইজ্তিহাদ করবেন, তাঁকে অবশ্যই ছালিহীনগণের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, আদিল হতে হবে, সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হতে হবে, ছগীরাহ্ গুণাহ্ও তাকে পরহেয করতে হবে। অতএব, কোন বিদ্য়াতী ও হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ইজ্তিহাদ শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়।

যেমন, বর্তমানে অনেক ওলামায়ে “ছূ” বা দুনিয়াদার, তথাকথিত মাওলানারা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ছবি তোলার কাজে লিপ্ত। অথচ শরীয়তে ছবি তোলা সম্পূর্ণ হারাম।

তারা ইসলামী হুকুমত জারী করার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র ভিত্তিক আন্দোলন, নির্বাচন, ভোট, বে-পর্দা, হরতাল, কুশপুত্তলিকাদাহ্সহ আরো বহু কাজে জড়িত। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সমস্ত কাজগুলো সম্পূর্ণই হারাম ও নাজায়েয।

          সুতরাং এ ধরণের কোন তথাকথিত মাওলানা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই ইল্মের দাবীদার হোক না কেন, হাক্বীক্বতে সে মুজ্তাহিদ হওয়ার বিন্দুমাত্র উপযুক্ত নয়। এরূপ ব্যক্তির দ্বারা ইজ্তিহাদের প্রশ্নই উঠেনা। তা সত্ত্বেও যদি সে মুজ্তাহিদ দাবী করে বা কোন প্রকার ইজ্তিহাদ করে তবে তার মেছাল হবে- ইবলীসের মতই। কারণ ইবলীসই সর্ব প্রথম মনগড়া ও গোমরাহীমূলক ইজ্তিহাদ করেছিল। যার ফলে সে চির লা’নতী ও জাহান্নামী হয়ে যায়।

যেমন, এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে,

واذ قلنا للملئكة اسجدوا لادم فسجدوا الا ابليس

অর্থঃ “আর যখন আপনার রব (ইবলীসসহ) সকল ফেরেশ্তাদের প্রতি হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজ্দা করার নির্দেশ দিলেন; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই তাঁকে সিজ্দা করলো।” (সূরা বাক্বারা-৩৪)

          হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজ্দা না করার কারণে মহান আল্লাহ্ পাক ইবলীসকে জিজ্ঞাসা করলেন,

ما منعك الا تسجد اذ امرتك

অর্থঃ “(হে ইবলীস)! কোন্ জিনিস (আদম আলাইহিস্ সালামকে) সিজ্দা করা থেকে তোকে বিরত রাখলো?” (সূরা আ’রাফ-১২)

ইবলীস তখন (মনগড়া) ইজ্তিহাদ করে বললো,

انا خير منه خلقتنى من نار وخلقته من طين

অর্থঃ “(আয় আল্লাহ্ পাক)! আমি তাঁর থেকে উত্তম। কারণ আপনি আমাকে আগুন থেকে তৈরী করেছেন, আর তাঁকে (আদম আলাইহিস্ সালামকে) মাটি থেকে তৈরী করেছেন।” (সূরা আ’রাফ-১২)

কাজেই আগুনের স্বভাব হলো- উপরে থাকা, আর মাটির স্বভাব হলো- নীচে থাকা, তাই আমি আগুন হয়ে মাটিকে সিজ্দা করতে পারিনা।” (নাউজুবিল্লাহ)

          উল্লেখ্য, ইবলীসের উক্ত ইজ্তিহাদ ছিল মনগড়া ও মহান আল্লাহ্ পাক-এর হুকুমের সম্পূর্ণই খিলাফ। যার ফলে তার সে ইজ্তিহাদই তাকে চির জাহান্নামী, লা’নতী ও চরম গোমরাহীতে নিপতিত করেছে।

যে সম্পর্কে কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে,

ابى واستكبر وكان من الكافرين

অর্থঃ “(ইবলীস) সিজ্দা করতে অস্বীকার করলো এবং অহংকার করে (মনগড়া ইজ্তিহাদ করলো)। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।” (সূরা বাক্বারা-৩৪)

তদ্রুপ বলতে হয়, যারা শরীয়তের খিলাফ প্রকাশ্য হারামগুলোকে মনগড়া ও শরীয়ত বিরোধী ইজ্তিহাদ করতঃ হালাল করতে চায়, তারাও ইবলীসের খাছ অনুসারী এবং গোমরাহ্ রূপেই সাব্যস্ত।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত হারাম বিষয়গুলোকে মা’জুর হিসেবে গণ্য করার কোন অবকাশ নেই। আর মা’জুরের ক্ষেত্রে নতুন করে ইজ্তিহাদ করারও কোন সুযোগ নেই। কারণ এ সম্পর্কিত ইজ্তিহাদ পূর্ব থেকেই হয়ে আছে।

সুতরাং مجتهدين صالحين (মুজতাহিদীনা ছলিহীনা)  “নেককার মুজতাহিদ” বাক্য দ্বারা বিদ্য়াতী ও ফাসিক তথা ওলামায়ে “ছূ”দের মনগড়া ইজ্তিহাদ বাতিল বলে গণ্য হয়েছে।

ইজ্মার শরয়ী আহ্কাম

মূলতঃ ইজমা হচ্ছে শরীয়তের একটি অকাট্য দলীল। ইজ্মাকে অর্থাৎ ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করা, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফকে অস্বীকার করারই নামান্তর। যেটা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই কুফরী।

          এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ونصله جهنم

অর্থঃ “কারো নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনগণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে সে দিকেই ফিরাবো, যে দিকে সে ফিরেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” (সূরা নিসা-১১৫)

বিখ্যাত মুফাস্সির, আলিমে হক্কানী, শায়খে রব্বানী, শায়খ আহ্মদ ইবনে আবূ সাঈদ মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি উপরোক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে বলেন,

فجعلت مخالفة المؤمنين مثل مخالفة الرسول فيكون اجماعهم كخير الرسول حجة قطعية.

অর্থঃ “উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হলো যে, মু’মিনগণের বিরোধীতা করা মূলতঃ রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরোধীতা করারই নামান্তর। তাই রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস শরীফের ন্যায় মু’মিনগণের ইজ্মাও অকাট্য ও প্রামান্য দলীল বলে পরিগণিত।” (নূরুল আনওয়ার)

আর সে কারণেই মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে আহ্মদী”তে ইজ্মার আহ্কাম সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় পেশ করে বলেন,

فيكون الاجماع حجة يكفر جاحده كالكتاب وسنة.

অর্থঃ- “ইজ্মায়ে আযীমত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের মতই একটি অকাট্য দলীল। যে ব্যক্তি এ ইজ্মাকে অস্বীকার করলো, সে মূলতঃ কুফরী করলো।”

উল্লেখ্য, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে ইজ্মার প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। ইজ্মার প্রচলন ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যুগে। উক্ত আয়াত শরীফ যেহেতু তাঁদের সময়কালে নাযিল হয়েছে, তাই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই এটার খাছ লক্ষ্যস্থল।

আহ্কামে শরীয়তের দিক নির্দেশনা ও তার ফায়ছালার ক্ষেত্রে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইজ্মা বা ঐক্যমত সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে ইরশাদ করেন,

كنتم خير امة اخرجت للناس

অর্থঃঞ্জ“তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে বা মনোনিত করা হয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান-১১০)

ইমাম ইবনে ছালাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি এ আয়াত শরীফের তাফ্সীরে উল্লেখ করেন,

وقيل اتفاق المفسرين على انه وارد فى اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থঃ “মুফাস্সিরীনগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এ আয়াত শরীফ রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।”

অতএব, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইজ্মা, তা কুরআন শরীফের দ্বারাই প্রমাণিত। কাজেই “ইজ্মায়ে ছাহাবা” বা ইজ্মায়ে আযীমকে অস্বীকার করা কুরআন শরীফের আয়াত শরীফকে অস্বীকার করার অনুরূপ, যা সকলের মতেই কুফরী

৪. ক্বিয়াস

          যে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি, সে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করতঃ হুকুম সাবিত করতে হবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরণের ইজ্তিহাদ করা আল্লাহ্ পাক ও রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই নির্দেশ।  যেমন, কালামে পাকে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,

فاعتبروا ياولى الابصار

অর্থঃ- “হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর-২)

আর নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন-

بم تقضى يا معاذ فقال بكتاب الله قال فان لم تجد قال بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فان لم تجد قال اجتهد برائى فقال الحمد لله الذى وفق رسول الله بما يرضى به رسوله.

অর্থঃ-   “হে মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! তোমার নিকট কোন মুকাদ্দমা আসলে কিভাবে তা ফায়সালা করবে? হযরত মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাবের দ্বারা। যদি তাতে না পাও তাহলে? আল্লাহ্ পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, যদি তাতেও না পাও তাহলে? আমি কিতাব ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে ইজ্তিহাদ করে রায় দিবো। এ উত্তর শুনে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাক-এর, যিনি তাঁর রসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে তাঁর রসূল সন্তুষ্ট হন।” (আহমদ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তালীক্বুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব, আশয়াতুল লুমুয়াত)

          ক্বিয়াস মূলতঃ নতুন কোন বিষয় নয়, বরং স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামও ক্বিয়াস করেছেন। তার প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ-

عن ابن عباس رضى الله تعالى قال اتى رجل الى النبى صلى الله عليه وسلم فقال ان اختى نذرت ان تحج وانها ماتت فقال النبى صلى الله عليه وسلم لو كان عليها دين اكنت فاقضيه قال نعم قال فاقض دين الله فهو احق بالقضاء

অর্থঃ “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক ব্যক্তি  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন- ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার ভগ্নি হজ্ব করার মানত করেছিলেন কিন্তু আদায় করার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার ভগ্নির উপর কারো ঋণ থাকলে তুমি তা আদায় করতে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে আল্লাহ্ পাক-এর হক্ব আদায় কর। কেননা এটা আদায় করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)

তবে নবী ও রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের ক্বিয়াস ও ওহীর অন্তর্ভূক্ত। এই ওয়াক্বেয়ার দ্বারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতদেরকে ক্বিয়াস করা ও ক্বিয়াস এর মাসয়ালা শিক্ষা দিলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও ক্বিয়াস করে সমস্যার সমাধান করতেন।

যেমন, হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়,

عن محمد ابن سيرين رحمة الله عليه قال ان ابا بكر رضى الله تعالى عنه نزلت به قضية لم نجد فى كتاب الله اصلا ولا فى السنة اثرا فقال اجتهد رايى.

অর্থঃ- “তাবিয়ী হযরত মুহম্মদ ইবনে সীরীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট যখন কোন মুকাদ্দমা আসতো, প্রথমে কুরআন-সুন্নাহ্র প্রতি নজর দিতেন, সেখানে যদি কোন নির্দেশনা না পেতেন, তাহলে নিজের রায় অনুযায়ী ইজতিহাদ বা ক্বিয়াস করে নিতেন।” (আত্ তবাকাতুল কুবরা লি ইবনে সা’দ)

অনুরূপ হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নীতি ছিল যে, তিনি ফায়ছালা করার ক্ষেত্রে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্র পর হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর রায়ের প্রতি নজর দিতেন, সেখানেও না পাওয়া গেলে বলতেন, فيه برايى  (অর্থাৎ নিজের রায় মোতাবেক ফায়ছালা করতেন)। (মুসনাদু দারিমী, মুসতাদরিকে হাকিম)

          উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, ক্বিয়াছ শুধু শরীয়তের অকাট্য দলীলই নয় বরং ক্বিয়াসের মাধ্যমে মাসয়ালা ছাবিত করা নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের খাছ সুন্নতেরও অন্তর্ভূক্ত।

          সুতরাং ক্বিয়াসের অনুসরণ করাও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়, ক্বিয়াসের প্রতি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতগণকে উৎসাহিতও করেছেন। নিম্নের হাদীছ শরীফ থেকে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا حكم الحاكم فاجتهد واصاب فله اجران واذا حكم فاجتهد فاخطا فله اجره واحد.

অর্থঃ “হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে- রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কোন মুজতাহিদ ইজতিহাদ করবে, সে যদি কামিয়াব হয়, দ্বিগুণ ছাওয়াব পাবে। আর যদি সে ভুলও করে, তাহলেও সে একগুণ ছাওয়াব পাবে।” (বুখারী শরীফ)

মনে রাখতে হবে যে, এ হাদীছ শরীফখানা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পরবর্তি মুজতাহিদগণের জন্য প্রযোজ্য।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়াস কুরআন-সুন্নাহ্ সমর্থিত ও ফযীলতের কারণ এবং তা শরীয়তের অকাট্য দলীলরূপে পরিগণিত।

          সুতরাং ক্বিয়াস অনুসরণ করার অর্থই হলো- কুরআন-সুন্নাহ্কে অনুসরণ করা। আর ক্বিয়াসের বিরোধিতা করা, কুরআন-সুন্নাহ্ অস্বীকার করারই নামান্তর।

ক্বিয়াসের প্রকারভেদ

ক্বিয়াস দু’প্রকার- (১) হক্ব ক্বিয়াস, (২) বাতিল ক্বিয়াস।

হক্ব ক্বিয়াসের সংজ্ঞা:-         মুজ্তাহিদ ক্বিয়াস করার সময় যদি কুরআন ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী ক্বিয়াস করেন, তাহলে তাকে হক্ব ক্বিয়াস বলে।

হক্ব ক্বিয়াসের উদাহরণ

(১) আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন,

حرمت عليكم امهتكم وبنتكم

অর্থঃ- “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মাতা ও কন্যাদেরকে।” (সূরা নিসা-২৩)

          এখানে امهات শব্দের দ্বারা মাতাকে বিবাহ করা হারাম বুঝায়। শরীয়তে নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম, কিন্তু কুরআন শরীফ বা হাদীস শরীফের কোথাও নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম তার প্রকাশ্য কোন ইবারত নেই।

          সুতরাং যারা ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে বা কুরআন-হাদীস ব্যতীত অন্য কোন ইজ্তিহাদী কওল গ্রহণ করতে নারাজ, তারা এ ব্যাপারে কি মত গ্রহণ করবে? ক্বিয়াস অস্বীকার করে নানী, দাদী ও নাতনীকে বিবাহ করবে? নাকি ক্বিয়াস স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবে?

          স্মর্তব্য যে, উক্ত আয়াত শরীফ-এ امهات- শব্দটি  ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত, তাই মুজ্তাহিদ তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ মাতার সাথে ক্বিয়াস করে উর্ধ্বতন যত নারী রয়েছে, যেমন- নানী, দাদী, তার মা, তার মা প্রমূখ এবং بناتكم দিয়ে নিম্ন সারীর যত নারী রয়েছে, যেমন- মেয়ে, তার মেয়ে (নাতনী) তার মেয়ে (প্রো নাতনী) প্রমূখ সকলকেই বিবাহ করা হারাম সাব্যস্ত করেছেন।

          এখানে উল্লেখ্য যে, যারা মায্হাব মানে না, তারা নিশ্চয়ই এই রায় মেনে নিয়ে মায্হাবী হয়ে আছে, কেননা এটা হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবেরই রায়। তাই এখন যদি কেউ ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে ও মায্হাবের বিরুদ্ধে মত পোষণ করে, তা হঠকারিতা বৈ আর কিছুই নয়।

বাতিল ক্বিয়াসের সংজ্ঞা- বাতিল ক্বিয়াস হলো-ক্বিয়াসকারী যদি মনগড়াভাবে কুরআন শরীফ-হাদীছ শরীফ-এর খিলাফ কোন ক্বিয়াস করে, তা বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত হবে।

          সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من قال فى القران برايه فليتبوأ مقعده من النار

অর্থঃ “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের (তাফসীর) স্বীয় রায় বা মত অনুযায়ী করে বা বলে, সে তার অবস্থানকে যেন দোযখে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী শরীফ)

বাতিল ক্বিয়াসের উদাহরণ

কিছু সংখ্যক লোক বলে থাকে যে, মুস্তাহাব আমলের ভিতর বিদয়াত প্রবেশ করলে মুস্তাহাব আমলকে ছেড়ে দিতে হবে, এটাও বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত। এর “দলীল হলো- আশুরার রোযা।”

           প্রথমতঃ আশুরার রোযা ১০ই মুহ্ররম একটি রাখার নিয়ম ছিল, কিন্তু যখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ বললেন যে, ইহুদীরাও ১০ই মুহ্ররম একটি রোযা রেখে থাকে, তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

صومو يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود وصوموا قبله يوما وبعده يوما

অর্থঃ “তোমরা আশুরার দিন রোযা রাখ এবং ইহুদীদের খিলাফ কর। অতএব তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন রোযা রেখে ইহুদীদের খেলাফ কর।”

          এখানে বিদয়াত তো দূরের কথা, তাশাব্বুহ বা হারাম হওয়া সত্বেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোযাকে বাদ দিলেন না, বরং মূল আমলকে ঠিক রেখে তার তাশাব্বুহ দূর করে দিলেন আরেকটি রোযা রাখার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং উক্ত মত পোষণকারীদের ক্বিয়াস দলীল বহির্ভূত এবং বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত।

          আর এ ধরণের কোন ক্বিয়াসের উপর যদি কখনো ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সে ইজমাও বাতিল ইজমা হিসেবে পরিগণিত।

কাজেই, কোন বিষয়ের শরয়ী ফায়ছালা পেতে হলে বা করতে হলে, অর্থাৎ শরীয়তে কোনটা হারাম, কোনটা হালাল, কোনটা জায়িয, কোনটা নাজায়িয, কোনটা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরূহ ইত্যাদি ফায়ছালা করতে হলে প্রথমে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফের দ্বারাই তা করতে হবে। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে যদি তার সুস্পষ্ট বিধান না পাওয়া যায়, তবে ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দ্বারা তার ফায়ছালা করতে হবে। অর্থাৎ উল্লিখিত চারটি দলীলের কোন একটির দ্বারা যদি কোন বিষয় হালাল প্রমাণিত হয় তবে তা হালাল। আর যদি হারাম প্রমাণিত হয় তবে তা হারাম। কেননা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের দলীলের ভিত্তিই হলো উক্ত চারটি, এর বাইরে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।

অতএব, কেউ যদি প্রাণীর ছবি তোলাকে জায়িয করতে বা বলতে চায় তবে তাকে উল্লিখিত চারটির যে কোন একটি দলীল পেশ করতে হবে। মূলতঃ তারা উল্লিখিত চারটির কোন একটি দ্বারাও প্রমাণ করতে পারবে না যে, প্রাণীর ছবি তোলা জায়িয। কারণ হাদীছ শরীফ-এর অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, ছবি তোলা হারাম। কাজেই ছবি তোলাকে জায়িয বলার অর্থ হলো শরীয়তের একটি অন্যতম দলীল যা কুরআন শরীফ-এর অনুরূপ বরং ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকার করা, যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।

(অসমাপ্ত)

পরবর্ী সংখ্যার অপেকষায় থাকুন

ফতওয়া বিভাগ- গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ হানাফী মাযহাব মতে পুরুষের জন্য লাল রংয়ের পোশাক তথা রুমাল, পাগড়ী, কোর্তা লুঙ্গি চাদর ইত্যাদি পরিধান বা ব্যবহার করা হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-৭

ফতওয়া বিভাগ- গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ হানাফী মাযহাব মতে পুরুষের জন্য লাল রংয়ের পোশাক তথা রুমাল, পাগড়ী, কোর্তা, লুঙ্গি, চাদর ইত্যাদি পরিধান বা ব্যবহার করা হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-৮

ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া— (১)

ফতওয়া বিভাগ-গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া- (২)

ফতওয়া বিভাগ- গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ ইসলামের নামে গণতন্ত্র ও নির্বাচন করা, পদপ্রার্থী হওয়া, ভোট চাওয়া ও দেয়া হারাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-(৩)