-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
৫৭। স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মুহব্বত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিম্নলিখিত মাকাম দশটি হাছিলের কোশেশ করবে।
ত্বরীকতের ইমামগণ বলেছেন যে, প্রত্যেক মানুষের শরীরে দশটি লতীফা রয়েছে। লতীফাগুলো হচ্ছে, ক্বলব, রুহ, সির, খফী, আখফা, নফ্স, আব, আতেশ, খাক, বাদ। উক্ত লতীফাগুলো এক একটি নেক খাছলতের মাক্বাম বা স্থান। এগুলো হচ্ছে মৌলিক মাক্বাম। এগুলো হাছিল করতে পারলে বাকী মাক্বামগুলো অতি সহজেই হাছিল করা যায়।
উল্লেখ্য যে, অনুসরনীয় ইমাম-মুজতাহিদ এবং আওলিয়ায়ে কিরামগণ বলেছেন-
وعلم الطريقة وهى مباحث المهلكات والمنجيات.
অর্থঃ “মুহলিকাত” অর্থাৎ ক্বলব বা অন্তরের ধ্বংস সাধনকারী বদ খাছলত এবং “মুনজিয়াত” অন্তরকে মুক্তিদানকারী নেক খাছলত সম্পর্কিত ইলমকেই ইলমে ত্বরীকত বা ইলমে তাসাউফ বলে।
মূলতঃ অন্তর থেকে বদ্ খাছলতসমূহ দূর করে দিয়ে নেক খাছলতসমূহ পয়দা করার মাধ্যমেই হাক্বীক্বী ইছলাহ বা পরিশুদ্ধতা লাভ সম্ভব।
হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عن عامر رضى الله تعالى عنه قال سممعت النعمان بن بشير رضى الله تعالى عنه يقول سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ان فى الجسد مضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب.
অর্থঃ “হযরত আমির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি হযরত নু’মান বিন বশীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমি শুনেছি যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “মানব শরীরে এক টুকরা গোশ্ত রয়েছে, তা পরিশুদ্ধ হলে গোটা শরীর পরিশুদ্ধ হবে এবং তা বিনষ্ট বা ধ্বংস হলে গোটা শরীর ধ্বংস হবে। সাবধান! উক্ত গোশ্তের টুকরাটি হলো ক্বল্ব্ বা অন্তর।” (বুখারী, মুসলিম, দারিমী, মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ)
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মুহ্লিকাতের (বদ্ খাছলত) কারণে ক্বল্ব্ বিনষ্ট হয়। আর মুন্জিয়াতের (নেক খাছলত) কারণে ক্বল্ব পরিশুদ্ধ হয়। অতএব, মুহ্লিকাত ও মুন্জিয়াত সম্পর্কিত ফরয পরিমাণ ইল্ম্ অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।
কোন কোন আওলিয়ায়ে কিরাম উক্ত বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, স্বভাব বা খাছলত কখনো পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি পাহাড় স্থানান্তরিত হতে শুন তাহলে বিশ্বাস করিও কিন্তু মানুষের খাছলত বা স্বভাব স্থানান্তরিত বা পরিবর্তন হতে শুনলে বিশ্বাস করিও না।” অর্থাৎ স্বভাব বা খাছলত পরিবর্তন হয় না। যেমন স্বভাব তেমনি থাকে। তবে যখন আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ হয় তখন তা নেক খাছলত বা উত্তম স্বভাবে পরিণত হয়। আর যখন গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে হয় তখন তা বদ খাছলতে পরিণত হয়।
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الناس معادن كمعادن الذهب والفضة خيارهم فى الجاهلية خيارهم فى الاسلام اذا فقهوا.
অর্থঃ “সোনা-রুপার খনির ন্যায় মানব জাতিও খনি তুল্য। যারা জাহিলিয়াত যুগে উত্তম ছিল তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যখন দ্বীনের জ্ঞান লাভ করেন। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
জাহিলিয়াতের যুগে যারা ইসলাম ও মুসলমানগণের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলো ইসলাম গ্রহণের পর তারা কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
যখন দ্বীনী ইলম শিক্ষা করে তখন সে আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মত ও পথে চলে। আর তখন তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত, সন্তুষ্টি হাছিল। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুহব্বত সন্তুষ্টি হাছিল। তখন তার স্বভাব বা খাছলত হয় নেক স্বভাব বা নেক খাছলত।
উল্লেখ্য যে, যাঁরা কামিল পীর ছাহেব বা হাক্বীক্বী মুর্শিদ তাঁরা আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নায়িব বা স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি।
আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আমলে বা যার উপর সন্তুষ্টি হন হাক্বীক্বী শায়খ বা মুর্শিদও সে আমলে বা তার উপর সন্তুষ্টি হন। কিন্তু নামধারী পীর ছাহেব সেরূপ নয়। সে নিজেই শরীয়তের খিলাফ আমল করে নফসের অনুসরণ করে। কাজেই আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছেন কামিল পীর ছাহেব বা মুর্শিদ। কোন মুরীদের উপর আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি আছে কিনা তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছেন স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলা। মুর্শিদ ক্বিবলার সন্তুষ্টি পেলে আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে। আর তার বিপরীত তথা অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসন্তুষ্টি নিহীত।
আফযালু আওলিয়া, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন, সুলতানুল আরিফীন, ইমামুল মুত্তাক্বীন, মুহ্ইস সুন্নাহ, ইমামে রব্বানী, গাউছে সামদানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন- “আল্লাহ পাক যেহেতু আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আল্লাহ পাক তাই আমি তাঁর ইবাদত করি।”
আর মুরীদ স্বীয় শায়খ-এর দিকে নিছবত রাখবে। অর্থাৎ মুরীদের আক্বীদা বিশ্বাস এরূপ হওয়া উচিত যে আল্লাহ পাক যেহেতু আমার শায়খ-এর আল্লাহ পাক এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু আমার শায়খ-এর রসূল সেহেতু আমি আল্লাহ পাক-এর ইবাদত করি এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করি। আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করলে আমার শায়খ খুশী হন হেতু আমি আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করি।”
যারা এরূপ আক্বীদা বিশ্বাস রেখে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মাশাক্কাত করেন ইবলিস তাদেরকে ধোকা দিয়ে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তাদের পক্ষে স্বীয় শায়খকে জাতিগত বা সত্ত্বাগত মুহব্বত করা সহজ ও সম্ভব হয়। শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলাকে জাতিগত বা সত্ত্বাগত মুহব্বত করতে না পারলে পরিপূর্ণ ফায়দা লাভ করা এবং মা’রিফাত ওমুহব্বত হাছিলের পথে ইস্তিক্বামাত থাকা সম্ভব নয়। কাজেই যারা এরূপ আক্বীদা-বিশ্বাস রেখে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মাশাক্কাত করেন তাদের সাথে স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার কিরূপ গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
তবে এ নেক খাছলত বা স্বভাব অর্জনের কোশেশ স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ ক্বিবলার সন্তুষ্টি মুয়াফিক হওয়া আবশ্যক। কারণ এ পথে শয়তান নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রাখে। শায়খ-এর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখলে সে জালে পা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। আর একটা কথা সবসময় মনে রাখতে হবে। এ উপদেশ শুধুমাত্র হক্কানী-রব্বানী আলিম তথা ওলীআল্লাহগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কাজেই যারা ওলীআল্লাহ নয় তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ তারা মুর্শিদ বা শায়খ হতে পারে না। তারা ধোকাবাজ। ধোকাবাজ পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়াই জায়িয নেই। কাজেই তারা সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমল করার প্রশ্নই আসেনা। বরং তার হাতে বাইয়াত হয়ে থাকলে বাইয়াত ভঙ্গ করা ফরয-ওয়াজিব।
দশটি মাক্বামের প্রথম মাক্বাম হচ্ছে তাওবা।
التوبة(তওবা) শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা করা। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়ার নামই তওবা।” তিনি আরো বলেন, “পাপ কার্য হতে তওবা করে পূনরায় কখনো সেই পাপের নিকটবর্তী না হওয়াকেই প্রকৃত তওবা বলে।
জেনে রাখ, পাপ কাজ হতে অনুতাপের সাথে তওবা করে আল্লাহ পাক-এর নির্ধারিত সৎপথের দিকে ফিরে আসা, এ পথের পথিকদের প্রথম পদক্ষেপ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিকামী পথিকবৃন্দের প্রাথমিক পথ। তওবা ভিন্ন কোন মানুষেরই গত্যন্তর নেই। কেননা, জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘকাল নিষ্পাপ ও ত্রুটিশূন্য জীবন যাপন করা কেবল নবী-রসূল আলাইহিস্ সালামগণের পক্ষেই সম্ভব। পক্ষান্তরে সারা জীবন পাপ-পঙ্কিলে নিমগ্ন থাকা এবং আল্লাহ পাক-এর বিরোধিতায় নিমজ্জিত থাকা শয়তানের কাজ। এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা মানুষের সাধ্যায়ত্ত।
প্রবৃত্তির প্রারোচনায় মানুষের পদস্খলন হয় এবং পাপে লিপ্ত হয়। তখন নিজের ভুল বুঝামাত্র অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তওবা করে পাপ পথ পরিত্যাগপূর্বক আল্লাহ পাক-এর আনুগত্য ও দাসত্বের পথে ফিরে আসা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর বংশধর, মানব জাতির কর্তব্য কাজ। যে মানুষ স্বীয় পাপ কার্যের জন্য লজ্জিত হয়ে অনুতপ্ত হৃদয়ের সাথে তওবা দ্বারা অতীত পাপের ক্ষতিপূরণ করতে সক্ষম হয়েছে, সে ব্যক্তি হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম-এর সাথে নিজের সম্পর্ক মজবুত করে নিতে পেরেছে। কিন্তু যে ব্যক্তি হঠকারিতা করে আমরণ পাপ কাজে লিপ্ত রয়েছে, স্বীয় পাপ কাজের জন্য একটুও লজ্জিত বা অনুতপ্ত হয়নি, সে ব্যক্তি শয়তানের সাথে নিজের সম্বন্ধ দৃঢ় করে নিয়েছে। বস্তুতঃ জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইবাদতে লিপ্ত থাকা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এর কারণ এই যে, আদি সৃষ্টিকালে মানুষকে অপুর্ণ, দুর্বল ও বুদ্ধিহীন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং মানুষ প্রথমতঃ অসহায় ও বুদ্ধিহীন অবস্থায় ভুমিষ্ঠ হয়ে থাকে। ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর মানুষের মধ্যে পরস্পর বিরোধী দু’টি বস্তু সংযোগ করা হয়। একটি প্রবৃত্তির কামনা বা অভিলাষ, অপরটি বুদ্ধি। (অসমাপ্ত)