——— হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম ————–
৫৬। “মাল-জান, সময়-শ্রম সব দিয়ে যথাসম্ভব স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদের খিদমত করবে।”
মুর্শিদ ক্বিবলা এবং মুরীদের মাঝে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ত্যাগ যত বেশী হবে প্রাপ্তি তত বেশী। ত্যাগ ছাড়া প্রাপ্তি মিলে না। মুরীদের প্রথম এবং প্রধান আমল হচ্ছে মুর্শিদের খিদমত। খিদমতে খোদা মিলে ইবাদতে জান্নাত। ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা জান্নাত লাভ হয়। আর খিদমতের দ্বারা স্বয়ং আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাছিল করা যায়।
من له المولى فله الكل.
“আল্লাহ পাক যার হয়ে যান সব কিছুই তার হয়ে যায়।” সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সুলতান মাহ্মুদের একজন গোলাম ছিল। তাঁর নাম ছিল আয়ায। তিনি আকল-সমঝের কারণে সুলতানের অন্তরের অন্তস্থলে স্থান দখল করে নিয়েছিল। সুলতান মাহমুদ তাকে অত্যন্ত মুহব্বত করতেন। সব সময় তাঁকে কাছে রাখতেন। রাজ দরবারের অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট যেটা হিংসা ও সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়েছিল। তাদের হিংসা ও সমালোচনার সীমা এতদুর ছড়িয়েছিল যে, তা স্বয়ং সুলতান মাহমুদের কানে পৌঁছেছিল।
সুলতান মাহমুদ চিন্তা করলেন যে, তাদের সমালোচনার বিষয়টি নিস্পত্তি করা দরকার। সে লক্ষ্যে একদিন রাজ দরবারের সকলকে বললেন, আজকে তোমাদের সামনে অনেক সোনা-চান্দি, মনি-মুক্তা, হিরা-জহরত ছিটিয়ে দেয়া হবে। আমার আদেশ পাওয়া মাত্রই তোমরা যে যেটার মধ্যে হাত রাখবে সে তার মালিক হয়ে যাবে।
সুলতানের আদেশ মত রাজ দরবারে অনেক সোনা-চান্দি, মনি-মুক্ত, হিরা-জহরত ছিটিয়ে দেয়া হলো। অনতিকাল পরে সুলতান মাহমুদ সভাসদগণের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা যে যেটার মধ্যে হাত রাখবে সে তার মালিক হবে।
সুলতানের কথা শেষ হতে না হতেই সভাসদগণের সবাই নিজ নিজ পছন্দনীয় জিনিসে হাত রাখলেন। আর গোলাম আয়ায স্বয়ং সুলতানের মাথার উপর হাত রেখে তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। আয়াযের নিরব-দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সভাসদগণের সবাই মনে মনে হাসতে লাগলো। ভাবলো আয়ায এতো বড় সুযোগ হাত ছাড়া করে একান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিল। সুলতান মাহমুদ আয়াযের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয়ায! সবাই মনি-মুক্তা, সোনা-চান্দি, হিরা-জহরতে হাত রেখে তার মালিক হলো। আর তুমি নিরবে দাঁড়িয়ে রইলে? তোমার কি এসবের কোন প্রয়োজন নেই?
আয়ায জাওয়াবে বললেন, বাদশাহ জাহাপনা! এসবের মালিক তো আমি। সুলতান বললেন, তা কিভাবে? আয়ায বললেন, বাদশাহ নামদার! আপনি বলেছিলেন যে, আপনার আদেশের সাথে সাথে যে যেটার মধ্যে হাত রাখবে সে তার মালিক হবে।
সুলতান বললেন, হ্যাঁ! আমি তো সেটাই বলেছি। আয়ায বললেন, আমি আপনার আদেশ শুনার সাথে সাথে আপনার মাথা মুবারকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। কাজেই আমি তো আপনাকে হাছিল করেছি। আর যেহেতু এসব কিছুই আপনার। কাজেই আপনার কথা মত এখন আমি এসব কিছুরই মালিক।
মুরীদ যদি জান-মাল, সময়-শ্রম সব কিছু দিয়ে স্বীয় শায়খ-এর যথাযথ খিদমত করে তাহলে আশা করা যায় সে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হাছিল করতে পারবে। তখন আসমান-যমীনে যা কিছু আছে সব কিছুই তার আয়ত্বাধীন থাকবে।
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র হাত মুবারকে বাইয়াত হওয়ার পর তাঁর খিদমতকে জীবনের সর্বপ্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। মাল-জান, সময়-শ্রম সব কিছু দিয়ে যথাসাধ্য তার খিদমত করতেন। মাল এবং জানের মুহব্বত তাদেরকে মোহগ্রস্ত করতে পারেনি। বরং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুহব্বতের সামনে এগুলো অত্যন্ত তুচ্ছ মনে হতো। অর্থ-সম্পদের অধিকারী ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ তাঁদের সমস্ত সম্পদ তাঁর খিদমতে পেশ করেছিলেন। আরব দেশে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি ছিলেন হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ এমনকি ঘরের ঘটি-বাটি, বাসন-কোসন এমনকি ঝাড়ু পর্যন্ত আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে পেশ করে তাঁর সন্তুষ্টি তালাশ করেছিলেন। যারা সম্পদশালী ছিলেন না তাঁরা খেজুরের বীচি এবং ছাগলের লাদী কুড়িয়ে জমা করে, তা বিক্রি করে বিক্রয় লব্ধ অর্থ আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে পেশ করতেন। আর আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলো দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে তথা যুদ্ধ-জিহাদ ইত্যাদিতে খরচ করতেন।
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য যুদ্ধের রসদপত্র, ঘোড়া ইত্যাদি সব সময় প্রস্তুত রাখতেন। একদল ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমত করার জন্য সব সময় তাঁর দরবার শরীফে অবস্থান করতেন। যাঁরা আহলে সুফফা নামে পরিচিত ছিলেন।
একবার একজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা দু’ভাই। আমাদের উভয়ে উপার্জনে সক্ষম। আমাদের পরিবারের অনেক সদস্য আছে। যারা উপার্জন করতে পারে না। আমার সেই ভাই আপনার খিদমতের জন্য আপনার দরবার শরীফে সব সময় অবস্থান করে। যার জন্য আমাকেই উপার্জন করতে হয়। তবে আমরা পূর্ণ সচ্ছল। আমাদের কোন অভাব-অনটন নেই। সুখে স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করি। কিন্তু আমার সেই ভাই যদি কিছু উপার্জন করতো তাহলে আমাদের সংসার আরো ভাল চলতো।
আল্লাহ পাক এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমার ভাই দরবার শরীফে অবস্থান করার কারণে তুমি উপার্জনে বরকত পাচ্ছ। তাঁর কারণেই তুমি ইতমিনানের সাথে জীবন যাপন করতে পারছ। যদি সে এখানে অবস্থান না করতো তাহলে তুমি সেই বরকত পেতে না। একইভাবে মুরীদও দ্বীনের প্রচার-প্রসার তথা তাজদীদের জন্য-স্বীয় শায়খ-এর খিদমতে জান-মাল, সময়-শ্রম উৎসর্গ করবে। সেক্ষেত্রে যিনি যেরূপ ফানা (বিলীন) হবেন তার বাক্বা (স্থায়িত্ব) ঠিক সেরূপই অর্জিত হবে। মাখলুকাতের উপকার করা একটি বিশেষ আমল। হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
الخلق عيال الله فاحب الخلق الى الله من احسن الى عياله.
অর্থঃ আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সমস্ত মাখলুক আল্লাহ পাক-এর পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। মাখলুকের মধ্যে আল্লাহ পাক-এর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক প্রিয় যে তাঁর পরিবারের প্রতি সদাচারণ করে। (বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ)
স্বীয় শায়খ-এর খিদমতের দ্বারা সেই আমলের মধ্যে পূর্ণতা আসে। মুরীদ অতিসহসাই আল্লাহ পাক-এর প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়। কারণ কোন মানুষকে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুখী করা সবচেয়ে বড় উপকার। আর মুর্শিদ ক্বিবলা সেই কাজটিই করেন হেতু মাল-জান দিয়ে শায়খ-এর খিদমত করলে সে প্রতিদানের অধিকারী হয় মুরীদ। তখন সেই মুরীদ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্যশীল ও মাহবুবে পরিণত হয়। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর শানে সে কথাটিই বলেছেন।
তিনি বলেন, “তোমরা মনে করবেনা যে, আফদ্বালুন নাছ বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শুধু ইবাদত বন্দেগী, যিকির-ফিকিরের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন বরং আল্লাহ পাক-এর প্রতি মুহব্বত ও মাখলুকাতের প্রতি দয়া, এ দুটাই ছিল তাঁর মর্যাদা লাভের অন্যতম কারণ ।
আর এর অন্তর্নিহীত তাৎপর্যের ব্যাখ্যা করেছেন ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীকত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন, আওলাদে রসূল, হযরত গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেছেন, স্বীয় শায়খের কিছু সময়ের খিদমত হাজার বছর ইবাদত-বন্দেগী, যিকির, ফিকির হতে উত্তম।”
তবে সেই খিদমত হতে হবে ইখলাছ সহকারে। কারণ ইখলাছ ব্যতীত কোন আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। ইখলাছ বিহীন আমলের দ্বারা আখিরাতে কোন ফায়দা পাওয়া যাবে না। আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত-মুহব্বত পাওয়ার আশা হবে সুদূর পরাহত।
কাজেই, অন্তরের বদ খাছলত দূর করে নেক খাছলত পয়দা করতঃ অন্তরে ইখলাছ হাছিল করতে হবে। অন্তর পরিশুদ্ধ করতে হবে। গইরুল্লাহ’র মুহব্বত, দুনিয়ার মোহ থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখতে হবে। যার জন্য আবশ্যক যিকির ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাত। কারণ- যিকির-ফিকির ছাড়া, রিয়াজত-মুশাক্কাত ছাড়া অন্তর পরিশুদ্ধ হয় না। সেটাই হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
لكل شىء صقالة و صقالة القلوب ذكر الله
অর্থ: আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। প্রত্যেক জিনিস পরিষ্কার কারার যন্ত্র রয়েছে। আর অন্তর পরিস্কার করার যন্ত্র হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর যিকির। (মিশকাত শরীফ)
কাজেই যিকির-ফিকির এবং শায়খ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করতঃ: ইখলাছ সহকারে স্বীয় শায়েখ-এর খিদমতে আঞ্জাম দেয়া আবশ্যক। তবেই মুরীদ কামিয়াবীর শীর্ষ চূড়ায় উপনিত হতে পারবে। আল্লাহ পাক মুজাদ্দিদে আ’যম মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওসীলায় সবাইকে সেই তাওফীক দান করুন। (আমীন)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)