ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে-১২০

সংখ্যা: ১৭১তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

৫৫। যে কোন বিষয়ে ইখতিলাফ বা মতভেদ দেখা দিলে ফয়সালার জন্য স্বীয় শায়খ-এর দ্বারস্থ হবে। আর তিনি যে ফয়সালা বা মিমাংসা করবেন তা সর্বান্তকরণে মেনে নিবে। সেক্ষেত্রে কোন প্রকার চু-চেরা কিলকাল করবেনা।

আকাঈদ, ইবাদত, মোয়ামালাত এবং মুয়াশারাত এগুলো ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আক্বীদা বিশুদ্ধ না হলে আল্লাহ পাক-এর দরবারে যেমন কোন ইবাদত মাকবুল হয়না। তেমনি মুয়ামালাত-মুয়াশারাত ঠিক না হলে হাক্বীক্বী মুসলমান হওয়া যায়না। নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফখানা সেদিকেই দালালত করছে।

المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده.

অর্থঃ “আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যার হাত ও যবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলমান।” (বুখারী শরীফ)

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত চারটি বিষয়কেই হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। মুসলমানদের মুয়ামালাত (লেনদেন) মুয়াশারাত (আচার-আচরণ, জীবন যাপন) কিরূপ হবে তাও শিক্ষা দিয়েছেন। অথচ অনেক লোক রয়েছে, যারা মুয়ামালাত-মুয়াশারাতকে তত বেশী গুরুত্ব দেয়না। অনিবার্য কারণে দ্বীনি ও দুনিয়াবী উভয়ক্ষেত্রে ইখতিলাফ বা মতানৈক্যতা দেখা দেয়া স্বাভাবিক। আত্মার পরিশুদ্ধতা অশুদ্ধতার কারনে যেমন ইখতিলাফ দেখা দেয়, তেমনি পরিশুদ্ধতা ও অধিক পরিশুদ্ধতার কারনেও ইখতিলাফ দেখা দিতে পারে। তবে যে বিষয়েই হউক আর যে কোন ভাবেই হউক তা ফায়সালার জন্য স্বীয় শায়খ-এর স্মরণাপন্ন হতে হবে।  আর সেটাই হবে তার নিরাপত্তা লাভের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,

فان تنازعتم فى شىء فردوه الى الله والرسول ان كنتم تؤمنون بالله واليوم الاخر ذلك خيرو احسن تاويلا.

অর্থঃ “যদি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে কোন বিষয়ে ইখতিলাফ দেখা দেয়, তবে ঐ বিষয়কে আল্লাহ পাক এবং রাসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর ফয়সালার ভার ন্যাস্ত করবে। যদি তোমরা আল্লাহ পাক-এর প্রতি এবং কিয়ামত দিনের প্রতি ঈমান রাখ। আর ইহাই উত্তম এবং তার পরিনামও খুব ভাল।” (সুরা নিসা-৫৯)

উল্লেখ্য যে, শায়খ বা মুর্শিদ হচ্ছেন আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কায়িম-মোকাম বা স্থলাভিষিক্ত। তিনি কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যে ফয়সালা সন্নিবেশিত রয়েছে তারই পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন । কাজেই আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অবর্তমানে শায়খ-এর ইতায়াতই তাঁর ইতায়াত বা আনুগত্যের অন্তর্ভূক্ত। আর শায়খ-এর নাফরমানী এবং তাঁর থেকে বিমুখতাই হবে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাফরমানী এবং বিমুখতার সামিল।

নুবুওওয়াত রিসালতের যুগে যারা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফায়সালাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়নি। তাঁর দেয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চু-চেরা কিল ও কাল করেছে তারা ঈমানদার ছিল না। তারা ছিল মুসলমানদের ছদ্মাবরণে কাট্টা কাফির, মুনাফিক। একইভাবে বিলায়েতের যুগে যারা স্বীয় শায়খ বা মুর্শিদ-এর উপর ফায়সালার ভার অর্পন করে না। আর করলেও ফায়সালার উপর চু-চেরা কিল কাল করে তারা মুরীদ নয়। বরং মুরীদের লিবাসে ইবলিসের দোসর এবং মুনাফিক বিশরের উত্তরসূরী।

বিশর নামক এক মুনাফিক ছিল। একবার কোন এক ইহুদীর সাথে তার বিবাদ বেঁধে গেল। ইহুদী লোকটি বলল- চল, আমরা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর  কাছে গিয়ে এর ফায়সালা করিয়ে নেই। কিন্তু মুনাফিক বিশর এ প্রস্তাবে সম্মত হলনা। বরং সে কা’ব ইবনে আশরাফ নামক ইহুদীর কাছে গিয়ে মীমাংসা করার প্রস্তাব করল। কা’ব ইবনে আশরাফ ছিল ইহুদীদের একজন সর্দার এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলমানদের কঠিন শত্রু।

কাজেই  বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিষয়টি ছিল একান্তই বিস্ময়কর যে, ইহুদী নিজেদের সর্দারকে বাদ দিয়ে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মীমাংসাকে পছন্দ করেছিল। অথচ নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয়দানকারী বিশর আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর  স্থলে ইহুদী সর্দারের মীমাংসা গ্রহণ করেছিল। তার পিছনে রহস্য ছিল। তাদের উভয়ের মনে এ বিশ্বাসই বদ্ধমুল ছিল যে, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  যে ফায়সালা করবেন তা একান্তই ন্যায়সঙ্গত। আর তাতে কারোই পক্ষপাতিত্বের কোন সন্দেহ-সংশয় ছিল না। আর মুনাফিক সর্দার কা’ব ইবনে আশরাফ টাকা খেয়ে বিচার হেরফের করত। কিন্তু যেহেতু  বিরোধীয় বিষয়ে ইহুদী লোকটি ছিল ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই সে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লাম-এর উপর আস্থাশীল ছিল। পক্ষান্তরে মুনাফিক বিশর ছিল অন্যায়ের উপর। সে জানত যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর  মীমাংসা তার বিরুদ্ধেই যাবে, যদিও সে মুসলমান বলে পরিচিত।

যাহোক, এতদুভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির পর আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেদের বিষয় তাঁরই মাধ্যমে মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নিল। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোকদ্দমার বিষয় অনুসন্ধান করলেন। তাতে ইহুদীর অধিকার প্রমাণিত হয় এবং তিনি তারই পক্ষে ফয়সালা করে দিলেন। এতে সে এ মীমাংসা মেনে নিতে অসম্মত হল এবং নতুন এক পন্থা উদ্ভাবন করল। কোনমতে ইহুদীকে রাজী করিয়ে হযরত উমর বিন খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট মীমাংসা করাতে নিয়ে গেল। ইহুদীও তাতে সম্মত হয়েছিল। তার পিছনে রহস্য ছিল। বিশর মনে করেছিল, যেহেতু হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কাফিরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠিন। কাজেই তিনি ইহুদীর পক্ষে রায় দেয়ার পরিবর্তে আমারই পক্ষে রায় দিবেন।

ইহুদী লোকটি ফারুকে আ’যম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট সমস্ত ঘটনা জানাল। বললো, এ মোকদ্দমার ফয়সালা স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। কিন্তু তাতে এ লোকটি সম্মত নয়। ফলে আপনার নিকট এসেছি।

ফারুকে আ’যম হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিশরকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘটনা কি সত্য?” সে স্বীকার করল। তখন হযরত ফারুকে আ’যম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “একটু অপেক্ষা কর, আমি এখনই আসছি।” একথা বলে তিনি ঘরের ভেতর থেকে একটি ধারালো তলোয়ার নিয়ে এলেন এবং মুনাফিক লোকটির দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেললেন। তিনি বললেন, “যে লোক আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফায়সালা মানতে রাজী নয়, এই হল তার ফায়সালা।”

অধিকাংশ তাফসীরকারকগণ এতদপ্রসঙ্গে একথাও লিখেছেন যে, এরপর নিহত মুনাফিকের ওয়ারিসরা হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল যে, “তিনি শরীয়তসম্মত কোন দলীল ছাড়াই একজন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন।”

তখন আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র যবান মুবারক থেকে উচ্চারিত হলো যে,

ما كنت اظن ان عمر يجترئ على قتل رجل مؤمن.

অর্থঃ “আমি ধারণাও করতে পারিনা যে, হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কোন মু’মিনকে অন্যায়ভাবে হত্যার করার সাহস পাবে।”

আর সাথে সাথে আল্লাহ পাক আয়াত শরীফ নাযিল করে তার সত্যায়ন করতঃ প্রকৃত ঘটনা এবং নিহত ব্যক্তির মুনাফিক হওয়ার কথা প্রকাশ করলেন। আর হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ন্যায় বিচারের সাক্ষ্য দিলেন।

فلا وربك لا يؤمنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت ويسلموا تسليما.

অর্থঃ “আপনার রবের কসম! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায় বিচারক বলে মেনে না নিবে। এক্ষেত্রে আপনার ফায়সালার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন প্রকার সংকীর্ণতা থাকতে পারবে না। বরং তা একান্ত সন্তুষ্ট চিত্তে সর্বান্তকরণে মেনে নিতে হবে।” (সূরা নিসা-৬৫)

বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, নাসাঈ, এবং সুনানে ইবনে মাযাহ শরীফে বর্ণিত রয়েছে, “হাররার কোনো এক পাহাড়ে নালা থেকে জমিতে পানি দেয়ার ব্যাপারে হজরত যোবায়ের বিন আওয়াম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং জনৈক আনসারীর মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়। বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য উভয়েই আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে বিচার প্রার্থী হলেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যোবায়ের! তুমি তোমার বাগানে পানি দেয়ার পর আনসারীর বাগানের দিকে পানি ছেড়ে দিও।” আনসারী এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে বললো, যোবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপনার ফুফাতো ভাই। সেজন্যেই আপনি এ রকম সিদ্ধান্ত দিলেন (নাউযুবিল্লাহ)। এ কথা শুনে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা মুবারক লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, “যোবায়ের! তুমি নালার পানি দিয়ে বাগানের জমি ভেজাবার পর নালা বন্ধ করে দিও যেনো পানি বাগানের প্রাচীর পযর্ন্ত ওঠে।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রথম সিদ্ধান্তটি এরকম ছিলো, যাতে করে হযরত যোবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর অসুবিধা না হয়। আবার আনসারীও যেনো সুবিধা লাভ করে। আনসারী যখন এই সিদ্ধান্তে অপ্রসন্ন হলো, তখন তিনি দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে হযরত যোবায়ের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর  পূর্ণ অধিকার বলবৎ করে দিলেন। (তাফসীরে মাযহারী)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)

মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)