ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৭)

সংখ্যা: ১৬৮তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

          প্রসঙ্গঃ “নিজের শায়খ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা বলবে না। কারণ, সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট, যে নিজের শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলে।”

          ‘আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “শায়খ তাঁর মুরীদের নিকট সেরূপ নবী তাঁর উম্মতের নিকট যেরূপ।” মুরীদ যদি এই হাদীছ শরীফকে সামনে রেখে জীবন-যাপন করে তাহলে প্রতিটি বিষয়ই তার জন্য সহজ হবে। শায়খ-এর কওল শরীফ উদ্ধৃত করার বিষয়টিও বুঝে আসবে। এ বিষয়ে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ-এর জীবনী মুবারকে ইবরত-নসীহত রয়েছে। কারণ তাঁরা হচ্ছেন নবী-রসূল আলাইহিমুস্্ সালামগণের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কাজেই তাঁরা আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে  যেরূপ সাবধানতা সর্তকতা অবলম্বন করেছেন সমস্ত উম্মতকে সেরূপ সাবধানতা ও সর্তকতা অবলম্বন করা আবশ্যক। আর মুরীদকে স্বীয় শায়খ-এর কওল শরীফ বা বাণী মুবারক উল্লেখ করার ক্ষেত্রে অনুরূপ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

          ফকীহুল উম্মত, মুফতিয়ুল আ’যম, মুফতী, মাওলানা, সাইয়্যিদ মুহম্মদ আমীমুল ইহ্্সান মুজাদ্দেদী, বারাকাতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “তারীখে ইলমে হাদীছ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন- হাদীছ শরীফ বর্ণনার ব্যাপারে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন কথা উদ্ধৃত করতে তাঁরা শিউরে উঠতেন।”

          হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আদত ছিল, কোন হাদীছ  শরীফের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে তিনি তা কখনো বর্ণনা করতেন না। সাথে সাথে একথাও বলে দিতেন, “যদি মিথ্যা হওয়ার সন্দেহ না হত, তবে বলতাম।” (দারেমী শরীফ)

          হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর কাছে কেউ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ শুনতে চাইলে তিনি বলতেন,

الحدیث عن رسول الله صلی الله عفیه وسلم شدید.

অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণনা করা খুবই কঠিন বিষয়।” (ইবনে মাযাহ শরীফ)

          একদিন ফকীহুল উম্মত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি-এর হাদীছ শীফ বর্ণনা করতে শুরو করলেন। সে সময় তিনি মাথা মুবারক নীচু করে দাঁড়িয়ে গেলেন। জামা মুবারকের গুটলী মুবারক খুলে ফেললেন। চোখ মুবারক থেকে অশ্রু মুবারক প্রবাহিত হলো। শিরা মুবারকগুলো ফুলে উঠল। তিনি বললেন, “হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতটুকু বলেছেন। অথবা এর চেয়ে কম কিংবা বেশি। অথবা এধরনেরই বলেছিলেন।” (ইবনে মাজাহ শরীফ, তারীখে ইল্মে হাদীছ-২৪)

          আফদ্বালুন নাস, বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মত ব্যক্তিত্ব মাত্র ১৪২ খানা হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন।

          অনেক ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম বাসধানতার জন্য কোন হাদীছ শরীফই বর্ণনা করেননি। (তারীখে ইলমে হাদীছ-২৫)

          প্রায় সোয়া লক্ষ ছাহাবা আজমাঈন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে মাত্র সাত জন ‘মুকাছ্ছিরীন’ রাবী। অর্থাৎ সর্বাধিক হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী সাতজন। যাঁদের বিশেষ খুছুছিয়ত বা বৈশিষ্ট্য ছিল।

          হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে যা বলি, ভয় করে বলি। বেশি কথা বলতে সাহস করি না। আর হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাহস করে অনেক কথাই বলেন। (ইছাবা-৪/২০৬, হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস-২৪)

          একইভাবে আল্লাহ পাক এবং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা‘রিফাত-মুহব্বত হাছিলকারীগণ হাক্বীক্বীভাবে অবহিত যে, শায়খের নামে সত্য-মিথ্যা মিশ্রন করে কথা বলার শেষ পরিণতি কিরূপ।

          তার বাস্তব মিসাল হচ্ছে, যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, হাবীবে আ’যম, হাকীমুল হাদীছ, সুলতানুল আওলিয়া, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা, ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী। তিনি তাঁর শায়খ-এর কোন কওল শরীফ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে যেরূপ আদব এবং সর্তকতা অবলম্বন করেন তা আগত ও অনাগত সকল উম্মাহর জন্য নসীহত। তাঁর সামনে যদি কেহ যথাযথ তাজিম-তাকরীম না করে কিংবা আদব বহির্ভূত অথবা অসর্তকতার সাথে তাঁর শায়খ-এর উদ্ধৃত দিতেন সাথে সাথে তিনি তাকে বলতেন “সাবধান! যখন তখন যেন তেনভাবে এসব বলতে হয় না।”  অপছন্দীয় কিছু বললে হাত মুবারকের ইশারা দিয়ে চুপ থাকতে বলতেন। শরীয়তের কিংবা সিলসিলার খিলাফ কোন বিষয় যদি কেহ তাঁর শায়খ কিংবা সিলসিলার ঊর্ধতন কোন ওলী আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করতো তখন তিনি বলতেন এটা আমাদের ব্যাপার নয়।

          অনেক লোককে দেখা যায়, যারা নিজের দোষ-ত্রুটিকে ঢাকতে গিয়ে কিংবা নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য স্বীয় শায়খ এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দলীল পেশ করতে চায় যা গোমরাহী ও হালাকীর কারণ।

          এরূপ মুরীদ হাজার বছর রিয়াজত-মুশাক্কাত, রাত-দিন যিকির-ফিকির করলেও আল্লাহ পাক-এর মা’রিফাত-মুহব্বতের ঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। উপরোন্ত ঈমান হারা অবস্থায় মারা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরূপ মানসিকতার লোক মুরীদ নয় বরং নামের কলংক।

          মূলতঃ মুরীদ তার জান-মাল, সম্মান-ইজ্জত প্রভাব-প্রতিপত্তি সবদিয়ে স্বীয় শায়ক-এর খিদমত করবে। তাঁর দ্বারা শায়খ-এর কোন প্রকার ক্ষতি হবে না। এটাই হবে হাক্বীক্বী মুরীদের পরিচয়। যারা হাক্বীক্বী মুরীদ তারা যে কোন কাজ করার পূর্বে স্বীয় শায়খ-এর কথা স্মরণ করে। মনে করে আমার দ্বারা কোন গুনাহ্্র কাজ সংঘঠিত হলে আমার শায়খ-এর বদনাম হবে। যদিও বা ব্যাপারটা তা নয়। মুরীদের শরীয়তের খিলাফ আমল করলে শায়খকে দোষারোপ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। যা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে যুদ্ধে অবর্তীণ হওয়ার সামিল। অর্থাঃ তার ধ্বংস অনিবার্য। যে মুরীদ কারো কাছে হাত পাতে না। তাঁর অভাব-অনটন থাকলে কারো কাছে প্রকাশ করে না। শত বিপদক-আপদের সম্মুখীন হলেও কারো নিকট সাহায্য-সহযোগীতা কামনা করেনা। অন্যের নিকট দোয়া প্রার্থনা করাকে স্বীয় শায়খ-এর মর্যাদা হানীকর মনে করে। দুনিয়া-আখিরাতে উভয় ক্ষেত্রে তার শায়খকেই একমাত্র উছিলা মনে করে।

          একইভাবে আরো কিছু লোক রয়েছে যারা নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আওলিয়ায়ে রহমতুল্লাহি আলাইহিগণকে দোষারোপ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তারা এরূপ কথাও বলে যে, ‘তারা নবী-রসূল হওয়া সত্ত্বেও অমুক অমুক গোনাহ করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ) আর আমরাতো সাধারণ মানুষ! উল্লেখ্য যে, এরূপ আক্বীদা-বিশ্বাসের লোকেরা মুসলমানগণের ঈমান-আক্বীদা ধ্বংসকারী মুসলমানগণের শুত্রু। তাদের সাথে কোন দিকে থেকে সম্পর্ক রাখা জায়িয নেই। আল্লাহ পা-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “এরূপ ব্যক্তিকে সালাম দিবেনা তার সালামের জাওয়াব দিবেনা। তার নিকট মেয়ে বিয়ে দিবেনা। তার মেয়ে বিয়ে করবেনা। তাকে খাবার খাওয়াবেনা। তার খাবার খাবেনা।তারা ঈমান থেকে ইসলাম থেকে অনেক দূরে। তারা কাট্টা কাফির চির জাহান্নামী। অনুরূপভাবে যে মুরীদ স্বীয় শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলে, তার শান-মানের খিলাফ কথা-বার্তা বলে আচার-আচরণ করে তাকেও সর্বোতভাবে বর্জন করা আবশ্যক। কারণ এরূপ ব্যক্তি কাফির-মুশরিকের চেয়েও খারাপ। তার সংসর্গ কাফির-মুশরিকের সংসর্গ হতেও বেশী ক্ষতিকর। আল্লাহ পাক আমাদেরকে জামানার মহান মুজাদ্দিদ ও ইমাম সাইয়্যিদুনা হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর উছিলায় সর্বপ্রকার বদ আক্বীদা ও আমল থেকে হিফাজত করুন। (আমিন)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭১)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭২) 

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৯) বিশুদ্ধ নিয়ত এবং তার ফযীলত ও গুরুত্ব (৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)