প্রসঙ্গ: নিজের শায়খ সম্পকেৃ কখনো মিথ্যা বলবে না। কারণ, সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট, যে নিজের শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলে।
মিথ্যা বলা কবীরা গুণাহ। কবীরা গুণাহ থেকে বেঁচে থাকা ফরয। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা (বিশ্বাস) হচ্ছে, “কবীরা গুণাহ তওবা ব্যতীত ক্ষমা হয় না।” মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ পাক-এর লা’নত। আল্লাহ পাক এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন , হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর লা’নত। আসমানবাসী, যমিনবাসী সকলেরই লা’নত। আল্লাহ পাক বলেন,
لعنت الله علی الکذبین
অর্থ: “মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ পাক-এর লা’নত।” (সূরা আলে ইমরান-৬১)
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লাম ইরশাদ করেন,
انما الکذب لکل الذنوب ام
অর্থ: “মিথ্যা সমস্ত পাপের মূল।”
একদা এক ব্যক্তি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হলেন। বললেন, “ইয়া রসূলাল্লা, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনার নিকট বাইয়াত হতে চাই। কিন্তু আপনি শরাব পান করতে ব্যভিচারী হতে, মিথ্যা বলতে এবং চুরি করতে নিষেধ করেন। অথচ এগুলো একসাথে পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এগুলো থেকে যদি যে ে কান একটি পরিত্যাগ করতে বলেন, তবে তা পারবো।”
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তুমি মিথ্যা বলবে না।” তিনি তাতে রাজী হলেন। সেই কথার উপর বাইয়াত গ্রহণ করলেন। অতঃপর বাড়ীতে গিয়ে খাবারের পর চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী শরাব পান করতে বসলেন। পরক্ষণে চিন্তা করলেন শরাব পান করলে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করবেন। যদি মিথ্যা বলি তাহলে বাইয়াত ভঙ্গ হবে। আর যদি সত্য বলি তাহলে আমার উপর হদ (শাস্তি) জারী হবে। কাজেই শরাব পান করা যাবে না। ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে একই কথা চিন্তা করে তা থেকে বিরত রইলেন। চুরি করতে বের হয়ে সেই বাইয়াতের কথা স্মরণ হলো। ফলে চুরি করাও সম্ভব হলোনা। পরের দিন প্রত্যুষে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে বললেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি এমন সুন্দর ব্যবস্থা দিয়েছেন যার ফলে সমস্ত অশ্লীল-অশালীন, নাজায়িয কাজ পরিত্যাগ করা সহজ হয়েছে। আমি উক্ত কাজগুলো পরিত্যাগ করেছি। (সুবহানাল্লাহ)
মিথ্যা বলার প্রবণতা অত্যন্ত গর্হিত স্বভাব। এরূপ ব্যক্তি কখনো আল্লাহ পাক-এর মা’রিফাত ও মুহব্বত পায় না।
সুলতানুল আরিফীন, ইমামুছ ছিদ্দীক্বীন, হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘কিমিয়ায়ে সায়া’দাত’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন-মিথ্যা বললে অন্তর অমসৃন আয়নার ন্যায় বন্ধুর এবং অসমতল হয়ে যায়। ফলে বস্তুসমূহের প্রতিচ্ছবি ঠিকভাবে অন্তর দর্পণে দেখা যায় না। কাজেই মিথ্যাবাদীর স্বপ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য হয় না।
কেননা মিথ্যা বলার কারণে তাদের অন্তকরণ বাঁকা ও টেড়া হয়ে যায়। একইভাবে মিথ্যাবাদী পরকালে আল্লাহ পাক-এর দিদারও সঠিকভাবে পাবেনা। তা অন্তসার শূন্য ও স্বাদহীন বলে মনে হবে। শুধু তাই নয়, বরং বিকৃত ও অমসৃন আয়নার মধ্যে যেমন সুন্দর আকৃতি কুৎসিত ও বিকটাকার দেখায়। ঝকঝকে পরিস্কার তরবারীর দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্তের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মুখের সুন্দর আকৃতি ও গঠন যেরূপ বীভৎস এবং ভয়ঙ্কর দেখায় তদ্রুপ মিথ্যাবাদীর হৃদয় ফলকে ও পরকালে আল্লাহ পাক-এর দর্শণ এবং পরলৌকিক যাবতীয় বিষয় বিকট ও ভয়ঙ্কররূপে প্রতিফলিত হবে।
আর বিশেষত নিজের শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলার অর্থ হচ্ছে-আল্লাহ পাক-এর নামে মিথ্যা বলা, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা বলা। কাজেই তা কত জঘন্য ও নিকৃষ্টতর কাজ তা সহজেই অনুমেয়।
আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারকে মিথ্যা রচনাকারীর যেরূপ কঠিন শাস্তি নির্ধারণ রয়েছে মুর্শিদের নামে মিথ্যা রচনাকারীও তেমন শাস্তির উপযুক্ত।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
ان رجلا لبس حلة مثل حلة النبی صلی الله علیه وسلم اهل بیت من المدینة فقال ان النبی صلی الله علیه وسلم قال لی ای بیت شئت استطلعت فقالوا عهد نا برسول الله صلی الله علیه وسلم لایأمر بالفواحش فاعدوا له بیتا وار سلوا الی رسول الله صلی الله علیه وسلم فاخبروه فقال لا بی بکر وعمر رضی الله تعالی عنهما انطاقا الیه فان وجدتما حیا فاقتلاه ثم حرفاه بالنار.
অর্থ: এক ব্যক্তি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লেবাসের ন্যায় লেবাস পরলো। অতঃপর মদীনা শরীফের একটি বাড়িতে উপস্থিত হলে বললো আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ্ ুআলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, “তুমি যে বাড়ীতে ইচ্ছা প্রবেশ করে দেখতে পার।” ইহা শুনে তাঁরা বললেন আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। তিনি কখনো এরূপ অনাচারের হুকুম দিতে পারে না।
অতঃপর তাঁরা তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করলো। তারপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট সংবাদ দিলেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া হয়রত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং ফারূকে আ’যম হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বললেন, “তোমরা সেখানে যাও। তাকে জীবিত পেলে হত্যা করে তার লাশ আগুনে পোড়াবে।”
অপর বর্ণনায় রয়েছে, আখিরী, রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের ইহাও বলেছেন যে, “ তোমরা গিয়ে সম্ভবতঃ তাকে জীবিত পাবে না।” বস্তুতঃ তাই হয়েছিল। তাঁরা সেখানে পৌঁছার পূর্বেই সাপের কামড়ে সে নরাধম জাহান্নামে চলে গিয়েছিল। (জামউল ফাওয়ায়িদ-২৭, হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস-১১০)
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা বলা তথা জাল হাদীছের অপচেষ্টা প্রথমত শুরু হয় হযরত উসমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফতকালে। ইসলামের পরম শত্রু ইহুদীরা এই ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু করে।
ইয়ামানবাসী আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক এক ইহুদী হযরত উসমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট এসে বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে। আর গোপনে ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে বিরাট ষড়যন্ত্র শুরু করে। সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনটি পন্থা অবলম্বন করে।
১.আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করে ইসলামের পবিত্রতা নষ্ট করে।
২.মুসলামানদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করে তাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করা।
৩.হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণের নামে দুর্নাম রটনা করে ইসলঅমের প্রতি মানুষের আকর্ষণকে বিনষ্ট করা। কেননা পরবর্তী লোদের ক্ষেত্রে ইসলাম লাভের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছেন তাঁরা। কাজেই তাঁদের প্রতি আস্থাহীন করতে পারণে ইসলামের প্রতি আকর্ষণের কোন সূত্রই বাকী থাকবে না।
অবশেষে বাবুল ইলমে ওয়াল হিকাম, আসাদুল্লাহিল গালিব হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর খিলাফতকালে আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হন। তখন তার অনুচরসহ তাকে আগুণে পুড়িয়ে মারেন।
(তাদবীন-৪৪৯, হাদীছের তত্ত্বও ইতিহাস-১১২, লিসুনুল মিযান, তারিখে ইলমে হাদীছ-১২৪, বুখারী শরীফ, মিযানুল ই’তিদাল)
উল্লেখ্য, যে বাতিনী নিয়ামত লাভের মাধ্যম হচ্ছেন, শায়খ বা মুর্শিদ। মুর্শিদের আদর্শে আদর্শবান হওয়া মুরীদের কর্তব্য। তাঁর সিলসিলার নিসবতকে অক্ষুন্ন রাখা আবশ্যক। যতদিন তাঁর নিসবত অক্ষুন্ন থাকবে মুরীদ ততদিন হক্বের উপর ইস্তিক্বামাত থাকতে পারবে। যখন তাঁর আদর্শ থেকে সরে যাবে তখন গোমরাহী দেখা দিবে। এজন্য পূর্ববর্তী সকল আওলিয়ায়ে কিরাম তাঁর সিলসিলার নিসবতকে অক্ষুন্ন রাখার তাকিদ দিয়েছেন। “অছীয়তনামা” দিয়ে গেছেন। সেই অছীয়তনামা অনুযায়ী চলতে বলেছেন।
তাছাউফ বিরোধী, ওলীআল্লাহগণের মুখালিফ, ইহুদী-নাছাড়া সবাই সেই আদর্শ হতে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। এমনকি শায়খ বা মুর্শিদের নামে মিথ্যা রচনা করতেও উদ্বদ্ধ করে। কাজেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ বর্ণনার ক্ষেত্রে যেরূপ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন স্বীয় শায়খের পবিত্র ক্বওল শরীফ উদ্ধৃত বা উল্লেখ করার ক্ষেত্রে সেরূপ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। (অসমাপ্ত)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)
মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)