ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৫)

সংখ্যা: ১৬৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

৫৪। “নিজের শায়খ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা বলবে না। কারণ, সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট, যে নিজের শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলে।”

মুর্শিদ ক্বিবলার সাথে মুরীদের যেরূপ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে, আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ঠিক সেরূপই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে নিজের শায়খ হচ্ছেন দর্পণ তুল্য।

শায়খ-এর নামে মিথ্যা বললে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। উপরন্ত মুরীদের উপর পড়ে শায়খ-এর অসন্তুিষ্টর দৃষ্টি। লা’নতগ্রস্ত হয় মুরীদ। ফলে তার দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই বরবাদ হয়ে যায়।

ইমামে রব্বানী, আফযালুল আওলিয়া, কাইয়্যুমে আউয়াল, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে একদিন হাজী মুহম্মদ নামীয় একজন মুরীদ জানালেন “প্রায় দু’মাস যাবত আত্মিক মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। পূর্বে যেমন জজ্বা ও হাল ছিল ইদানিং তা নেই।”

তাঁর জাওয়াবে তিনি লিখেন, “হে স্নেহাস্পদ! যদি দু বিষয়ে ত্রুটি না হয় তাহলে চিন্তার কোনই কারণ নেই।

প্রথমতঃ ছাহেবে শরীয়ত তথা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত, অনুসরণ। দ্বিতীয়ত: নিজের শায়খ -এর সাথে গভীর মুহব্বত স্থাপন। যদি এ দু’টি যথাযথ থাকে আর অন্তকরণে শত-সহস্র তমসা নিক্ষিপ্ত হয় তাহলেও কোন ভয় নেই। কারণ উক্ত সালিককে কখনো ধ্বংস করা হবে না।

পক্ষান্তরে আল্লাহ পাক না করুন, যদি উক্ত দ’ুবিষয়ের কোন একটির মধ্যে ত্রুটি ও ব্যাঘাত জন্মে, তাহলে তার হালাকী (ধ্বংস) অনিবার্য। যদিও সে আত্মীক দর্শন ও এতমিনানের সাথে অবস্থান করে। কারণ ইহা ছলনামূলক উন্নতি। ইহার পরিণাম মন্দ। আল্লাহ পাক -এর নিকট আজিজী-ইনকেছারী তথা অনুনয়-বিনয় সহকারে উল্লেখিত বিষয় দু’টির অবস্থান এবং তার প্রতি ইস্তিক্বামত থাকার কামনা করা আবশ্যক। যেহেতু ঐ বিষয় দু’টিই মূল। তার উপরই কামিয়াবী নির্ভরশীল। (মাকতুবাত শরীফ)

যে মুরীদের মধ্যে নিজের শায়খ-এর নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা বলার প্রবণতা থাকবে সে মুরীদ কখনোই উক্ত বিষয় দু’টির উপর ইস্তিক্বামত থাকতে পারবে না। তার হালাকী অবসম্ভাবী। কাজেই, সব সময় সেই বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা কর্তব্য।

অনেকে নিজের শায়খ বা মুর্শিদের উদ্ধৃতি দিয়ে সব সময় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তার উপস্থাপিত বিষয়কে অর্থবহ করার জন্য শায়খ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। তাতে কোন কোন সময় হিতে বিপরীত হয়। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “যারা কসম দিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত তাদের কথা বিশ্বাস করিওনা।” এরূপ ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতারণা করে থাকে। তাছাড়া যখন তখন আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলা শুদ্ধ নয়। একইভাবে যেখানে সেখানে নিজের শায়খ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলাও উচিত নয়। আল্লাহ পাক বলেন,-

ادع الى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة.

অর্থঃ “তুমি হিকমতের সাথে উত্তম নছীহতের মাধ্যমে মানুষকে তোমার রবের পথে ডাক। (সূরা নহল-১২৫)

আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

كلموا الناس على قدر عقولهم.

অর্থঃ “তোমরা মানুষের সাথে তার আক্বল অনুযায়ী কথা বল।”

এই হাদীছ শরীফের শেষাংশে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাও বলেছেন যে, “তোমরা কি চাও, মানুষ তার রবকে অস্বীকার করুক?”

অর্থাৎ সব সময় সব ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে বক্তা নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি সম্বোধিত ব্যক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হচ্ছে ‘‘দ্বীনের হুকুম-আহকাম পালনের প্রতি তারগীব (উৎসাহ) দেয়ার জন্য ইফরাত-তাফরীত (কমানো-বাড়ানো) করা জায়িয নেই। সেক্ষেত্রে শায়খ-এর নামে মিথ্যা উদ্ধৃতি দেয়া কিভাবে জায়িয হতে পারে?

সত্য কথায় যে বরকত রয়েছে মিথ্যার মধ্যে  তা নেই। বরং তাতে রয়েছে লা’নত ও হালাকী। যদিও তা খুবই চাকচিক্য পূর্ণ মনে হয়।

উল্লেখ্য যে, “বাদশাহর কথা, কথার বাদশাহ”।

শায়খ বা মুর্শিদ যেমন সম্মানিত, শ্রদ্ধাশীল। তাঁর মুবারক বাণীও তেমনি সম্মানিত, শ্রদ্ধাশীল। তাঁর মুবারক বানী যিনি সংরক্ষণ করেন, প্রচার করেন একইভাবে তিনিও সম্মানিত ও শ্রদ্ধার পাত্র তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মূলতঃ মুরীদের নিকট শায়খ-এর মুবারক বাণী, কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফের মত গুরুত্বপূর্ণ ও আমলযোগ্য।

আয়াত শরীফের তাফসীর এবং হাদীছ শরীফের তাশরীহ জানা না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে তার উপর আমল করা জায়িয হয় না। কিন্তু শায়খ- এর মুবারক বাণী নির্বিঘেœ আমলযোগ্য। কারণ কামিল মুর্শিদের মুবারক বাণী, কুরআন শরীফের তাফসীর এবং হাদীছ শরীফেরই তাশরীহ। কাজেই, কেহ তাঁর শায়খ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বললে মুরীদের জন্য তার উপর বিশ্বাস  রাখা এবং আমল করা আবশ্যক।

তবে তাহক্বীক্ব তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাচাই করা দোষণীয় নয়।” বরং ক্ষেত্র বিশেষে জরুরী। শায়খ বর্তমান থাকলে সরাসরি শায়খ-এর খিদমতে নিবেদন করে জানবে। আর শায়খ-এর অবর্তমানে শায়খ-এর নৈকট্যশীল এবং বিশ্বস্ত কারো নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারে।

আমীরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অনেক ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের নিকট সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হাদীছ শরীফ শুনে স্বাক্ষ্য তলব করতেন। আর হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শপথ করাতেন। তবে তাতে বর্ণনাকারী ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি সন্দেহ পোষণ ছিলনা। বরং পরবর্তী লোকেরা যাতে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করতে সুযোগ না পায় সে কারণেই তাঁরা এরূপ করেছেন। মূলতঃ সমস্ত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগণই ছিলেন আদীল। তাঁদের প্রতি সামান্যতম সন্দেহ পোষণকারী কাট্টা কাফির, চির জাহান্নামী। এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু একবার খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর বাড়ীতে গেলেন। বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে তিনবার সালাম দিলেন। কিন্তু উত্তর আসলো না। তখন তিনি ফিরে আসলেন। অতঃপর আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে ডেকে পাঠালেন এবং ফিরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।

ছাহিবে রসূলিল্লাহ হযরত আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন “তোমাদের কেহ তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরও যদি অনুমতি না পায়, তাহলে সে যেন ফিরে যায়।”

আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আপনার এই কথার উপর দলীল পেশ করুন।” ছাহিবে রসূলিল্লাহ হযরত আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সাক্ষী স্বরূপ উপস্থিত করলেন।

আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ফারূক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

اما انى لم اتهمك ولكن خشيت ان يتقول الناس على النبى صلى الله عليه وسلم.

অর্থঃ হে আবু মূসা আশয়ারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু! আমি আপনার প্রতি মিথ্যার সন্দেহ করিনি। আমি এজন্য দলীল তলব করেছি, যাতে লোকেরা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নামে মিথ্যা হাদীছ প্রচার করতে সাহস না করে। (মিশকাত শরীফ, জামউল ফাওয়ায়িদ /১৪৪, হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস /১০৯)

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা বলা যেরূপ নিকৃষ্টতম কাজ তদ্রুপ শায়খ-এর নামে মিথ্যা বলাও নিকৃষ্টতম কাজ, লা’নতগ্রস্ত হওয়ার কারণ। জাল হাদীছ রচনাকারী যেমন কাট্টা কাফির। শায়খ বা মুর্শিদের নামে মিথ্যা রচনাকারীর হুকুমও তেমনই।

اهانة العلماء كفر

অর্থাৎ, হক্বানী-রব্বানী আলিমগণকে ইহানত করা কুফরী।” এই হুকুম তাদের জন্য প্রযোজ্য।  আখিরী রসূল, নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

من كذب على متعمذا فليتبوأ مقعده من النار.

অর্থঃ “যে আমার নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা বলবে সে যেন দুনিয়াতে থেকেই তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করলো।”  (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ) অর্থাৎ সে নিকৃষ্ট, জাহান্নামী।

কাজেই, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারকে মিথ্যা রচনাকারীর যেরূপ কঠিন শাস্তি নির্ধারিত, শায়খ বা মুর্শিদের নামে মিথ্যা রচনাকারীও অনুরূপ কঠিন শাস্তির উপযুক্ত। তবে জাল হাদীছ রচনাকারী যেমন ঈমান থেকে বঞ্চিত ছিল, শায়খ-এর নামে মিথ্যা প্রচারকারী তদ্রুপ ইলমে তাছাউফ থেকে বঞ্চিত এবং সেও হাক্বীক্বী ঈমান থেকেও বঞ্চিত হবে।

উল্লেখ্য যে, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় তাঁর মুবারক নামে এক ব্যক্তি একটি মিথ্যা কথা বলেছিল। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হত্যা করে আগুনে পোড়াতে আদেশ দিয়েছিলেন। (জামউল ফাওয়ায়িদ/২৭) (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)

মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)