-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
প্রসঙ্গঃ মুরীদ কখনো নিজের কাশ্ফ বা আত্মিক বিকাশের উপর নির্ভর করবে না। অন্যথায় গোমরাহ বা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে (মাকতুবাতে ইমাম রব্বানী)
সালিক বা মুরীদ যখন কামিল মুর্শিদের কাছে বাইয়াত হয়। মুর্শিদের নির্দেশ মত নিয়মিত যিকির-ফিকির এবং ছোহবত ইখতিয়ার করে। আর কম খাওয়া, কম ঘুমানো, কম কথা বলা, কম মেলা-মেশা করার নীতিতে ইস্তিক্বামাত থাকে তখন আত্মার ইছলাহ বা পরিশুদ্ধতা আসে। আত্মা পরিশুদ্ধ হলে দুনিয়ার মুহব্বত দূর হয়। গাইরুল্লাহ-এর আকর্ষণ হতে আত্মা মুক্তি পায়। আল্লাহ পাক এবং নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, নূরে মুজাস্ সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বত দ্বারা অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আর তখন সালিক বা মুরীদের অন্তরে নতুন নতুন ইলমের উদ্ভব হয়। দৃষ্টির সীমা হতে সকল পর্দা উম্মোচিত হয়। তখন কাশ্ফ ও কারামত প্রকাশ পেতে থাকে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তার আক্স বা ছায়া দৃষ্টি গোচর হয় এবং পরে তার হাক্বীক্বী অবস্থায় উপনিত হয়। তবে যেটাই হোক মুরীদ কখনো সেই সকল কাশ্ফ ও কারামতের উপর নির্ভরশীল হতে পারবে না।
কাশ্ফ (আত্মিক দর্শণ) এবং কারামত (অলৌকিক ঘটনাবলী) আল্লাহ পাক এবং নবীদের নবী, রসূলদের রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্ সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত মুহব্বত এবং নৈকট্যকে গভীর ও অর্থবহ করে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা ও হালাকীর (ধ্বংস) কারণ হয়।
কাশ্ফ-এর আহকাম এবং তার বৈপরিত্যের কারণ
আল্লাহ পাক স্বীয় হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত নিয়ামতরাজী দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। মূলতঃ তাঁর খিদমতের জন্যই কায়েনাতের সব সৃষ্টি হয়েছে। আর আওলিয়ায়ে কিরামগণ ওয়ারিসী সূত্রে সে সমস্ত নিয়ামতরাজী লাভ করেন। তবে তাঁরা আল্লাহ পাক এবং আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসারীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ইচ্ছা ও আদেশ বহির্ভূত কিছু করেন না। আসমান-জমিনের সমস্ত রহস্যাদী তাঁদের সামনে প্রকাশিত হলেও ইচ্ছা-ও আদেশ ব্যতীত মুখ খোলেন না। কাশ্ফ এবং কারামতের পূর্ণ দখল থাকা সত্ত্বেও কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও কিয়াসের পূর্ণ অনুসরণ করেন। শরীয়তের উপর ইস্তিকামাত থাকাই হচ্ছে তাঁদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আওলিয়ায়ে কিরামগণ কাশ্ফ এবং কারামতের উপর নির্ভর করেন না। কাজেই কাশ্ফ এবং কারামতের বিষয়টি কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও কিয়াস সম্মত হতে হবে। কারণ কুরআন শরীফ এবং সুন্নাহ শরীফের খিলাফ কাশ্ফ ও কারামত গ্রহণ যোগ্য নয়। কাশ্ফ ইলম হাছিলের এক প্রকার মাধ্যম। জাহিরী আলিমগণ কিতাবাদীতে যা পড়েন সূফীয়ানে কিরামগণ তা কাশ্ফ, মুরাকাবা ইত্যাদি ভাবে তা হাছিল করে থাকেন। কাজেই ব্যক্তি ও ব্যাক্তিত্বের কারণে কাশ্ফের ভিন্নতা আসা স্বাভাবিক। আফজালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- কোন কোন ওলী আল্লাহর কোন কোন ক্ষেত্রে ইলহামের বিপরীত ঘটনা ঘটে থাকে। যথা- কেহ সংবাদ দিল যে, একমাস পর অমুক ব্যক্তি মারা যাবে কিংবা সে বিদেশ হতে ফিরে আসবে। ঘটনাক্রমে একমাস পর তার কোন একটিও হলো না। তার কারণ কি? তদুত্তরে বলবো যে, উক্ত সংবাদ হয়ত কোন শর্তের সাথে যুক্ত ছিল। সংবাদ প্রাপ্ত ওলী কাশ্ফের সময় হয়তো তা বিস্তারিতভাবে অবগত হতে পারেন নি। অতএব তিনি সাধারণ ভাবে এটা হবে বলে সংবাদ দিয়েছেন।
তার উত্তরে এটাও বলা যেতে পারে যে, হয়তো কোন আরিফের প্রতি লওহ মাহ্ফুযের কোন হুকুম প্রকাশ পেয়েছে। যা প্রকৃত পক্ষে পরিবর্তনশীল এবং কাজায়ে মোয়াল্লাক (শর্তযুক্ত হুকুম) ছিল। কিন্তু তা উক্ত আরিফ (দরবেশ) অবগত হতে পারেন নি। এমতাবস্থায় যদি তিনি স্বীয় অবগতি অনুযায়ী সংবাদ দেন তবে অবশ্যই তার বিপরীত ঘটবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম একদিন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সংবাদ দিলেন, “অমুক যুবকের আগামী কাল সকালে ইন্তেকাল হবে”। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবকের প্রতি দয়া পরবশ হলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন “তোমার কি কোন আশা-আকাঙ্খা আছে? উত্তরে তিনি জানালেন, বিয়ে করা এবং আহলিয়ার হাতের তৈরী রুটি ও হালূয়া খাওয়ার আকাঙ্খা রাখি।” সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশক্রমে বিয়ে দেয়া হলো। যুবক রাতে স্বীয় আহলিয়ার তৈরী হালূয়া ও রুটি খেতে বসলেন। একজন ভিক্ষুক এসে নিজের অভূক্ততার কথা জানালো। যুবক সমস্ত হালূয়া ও রুটি তাকে দান করলেন। পরের দিন আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ইন্তেকাল না হওয়ার খবর পেলেন। হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, রুটি ও হালূয়া ছদ্কা করার কারণেই তাঁর বিপদ দূর হয়ে গেছে।” তাঁর বিছানার নীচে বিরাট বিষাক্ত সাপ মৃত অবস্থায় পরে রয়েছে। উক্ত সাপটির পেটে এতো অধিক পরিমাণে হালূয়া ও রুটি প্রবেশ করা হয়েছে, যার জন্য সে মারা গেছে।
উল্লেখ্য যে, কাজা বা অদৃষ্ট লিপি দু প্রকার। একটি কাজায়ে মোয়াল্লাক (শর্তযুক্ত অদৃষ্ট)। অপরটিকে কাজায়ে মোব্রাম্ (অকাট্য অদৃষ্ট) বলা হয়। কাজায়ে মোয়াল্লাক পরির্বতনশীল। আর কাজায়ে মোব্রাম অপরিবর্তনীয়। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- “আমার নিকটে, বাক্যের পরিবর্তন ঘটে না।” ইহা কাজায়ে মোব্রামের বিষয়। আর কাজায়ে মোয়াল্লাকের বিষয় বলেছেন- “আল্লাহ পাক যা ইচ্ছা তাই করেন এবং তাঁরই নিকট মুল পুস্তক (লওহ্ মাহ্ফুজ) বর্তমান আছে।”
আমার মুর্শিদ ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, সাইয়্যিদুল আওলিয়া, গাউসুল আ’যম, মাহবুবে সোবহানী, হযরত সাইয়্যিদ মুহিউদ্দিন বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় কিতাবাদির কোন কিতাবে লিখেছেন, “কাজায়ে মোব্রাম আমি ব্যতীত কেউ পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। আমি ইচ্ছা করলে তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারি” তিনি একথায় বড় বিস্ময়াপন্ন ছিলেন ও ইহা দুরূহ ব্যাপার বলে ভাবতেন। অনেক দিন হতে ইহা আমার মনে গুপ্ত ছিল। অবশেষে আল্লাহ পাক আমাকেও এ উচ্চ দৌলত প্রদান করে ছরফরাজ করলেন। একদিন কোন বিপদ যা আমার কোন বন্ধুর নামে লিখিত ছিল। তা খ-ন করার চেষ্টা করেছিলাম। আল্লাহ পাকের দরবারে পূর্ণ বিনয় ও নম্রতার সাথে কাঁন্নাকাটি করেছিলাম। তখন আমার প্রতি ইলহাম হলো, লওহ মাহফুজের উক্ত বিপদটি কোন শর্তের সাথে যুক্ত নয়। তাতে আমার এক প্রকার নৈরাশ্য দেখা দিল। সাথে সাথে হযরত শায়েখ মুহিউদ্দিন রহমতুল্লাহি আলাইহি এর কথা মনে পড়ল। তখন আবার বিনীত ভাবে কাঁন্নাকাটি শুরু করলাম। অক্ষমতা ও মুখাপেক্ষীতার সাথে আল্লাহ পাক এর দরবার শরীফের প্রতি মনোযোগী হলাম। তখন আল্লাহ পাক আমার প্রতি ইলহাম করলেন যে, কাজায়ে মোয়াল্লাক দুই প্রকার; এক প্রকারের ‘কাজা’ শর্তযুক্ত। তা লওহ্ মাহফুজে উল্লেখ আছে। ফেরেশতাগণ উহা অবগত আছেন। দ্বিতীয় প্রকার ‘কাজা’ শর্তযুক্ত হওয়া আল্লাহ পাকই জানেন মাত্র। লওহ্ মাহ্ফুজে উহা ‘মোব্রাম’ (অকাট্য) হিসাবে লিখিত আছে। এ দ্বিতীয় প্রকারের কাজায়ে মোয়াল্লাক্ বা শর্তযুক্ত কাজাও প্রথম প্রকারের মত পরিবর্তনশীল। ইহা হতে আমি বুঝতে পারলাম যে, সাইয়্যিদ মুহিউদ্দিন রহমতুল্লাহি আলাইহি এর কথা এই দ্বিতীয় প্রকারের ‘কাজা’ এর বিষয় ছিল। যা দৃশ্যত কাজায়ে মোব্রাম। প্রকৃত পক্ষ্যে কাজায়ে মোব্রাম বলতে যা বুঝায় সেটা তা নয়। মোদ্দা কথা, এর প্রকৃত তত্ত্ব অল্প লোকই অবগত আছে। সুতরাং যে বিপদ উক্ত বন্ধুর ছিল তা দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরবর্তীতে জানতে পারলাম যে, উহা অপসারিত হয়েছে। (মাকতুবাত শরীফ)
মুরীদের পক্ষে কাশ্ফের এই সুক্ষ্মতা হাক্বীক্বীভাবে উপলব্ধি করা কঠিন। অতএব ভুলে পতিত হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। যা গোমরাহীর পথকেই প্রসারিত করে। অতীত ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ স্বীয় শায়খ-এর ছোহবত ইখতিয়ার করা ছেড়েই দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দয়া ও ইহ্সানের বদৌলতে হিদায়েতের পথে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল।
আফজালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ তাঁকে জানালেন, হে আমার শায়খ! আমার কাশফের ব্যাপকতা এতো অধিক প্রবল হয়েছে যে, সারাক্ষণ আল্লাহ পাক এর দীদার পাই। আমার আরো ছোহবত ইখতিয়ার করার প্রয়োজন আছে কি? ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তোমার ক্বালব লতিফা এক তৃতীয়াংশ হাছিল হয়েছে মাত্র।” পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কাশফ ও কারামত জাহির হওয়াটা কখনো বা বিপদের কারণ হয়। যার কারণে পূর্ববর্তী অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম কাশফ বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক-এর দরবারে দুয়া করেছিলেন। ইমামে আ’যম, হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাশফের ব্যাপকতা এতো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তিনি মানুষের গুণাহ পর্যন্ত দেখতে পেতেন। একদিন একজন বালককে অযু করতে দেখলেন। তার অযুর পানির সাথে গুণাহ মিশ্রিত ছিল। বালকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে বালক তোমার পিতার অবাধ্যতা ছেড়ে দাও”। পরক্ষণে দুয়ার করলেন, “আল্লাহ পাক! আমার এ অবস্থান পরিবর্তন করে দিন।”
কাজেই মুরীদ নিজের কাশ্ফকে কখনো প্রধান্য দিবে না। আর এটাই তার নিরাপত্তা লাভের উপায়। তবে যদি কেহ হাক্বীক্বতে উপণীত হয এবং তার শায়খ তার কাশ্ফের সঠিকতা সত্যায়ন করেন ও অনুসরন করার অনুমতি দেন তবে তা ভিন্ন কথা والله اعلم بالصواب
(চলবে)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৫)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৭)