ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১০)

সংখ্যা: ১৬১তম সংখ্যা | বিভাগ:

———-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম————–

প্রসঙ্গঃ নিয়মিত শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত ইখতিয়ার করবে। আহলে যিকির তথা আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করা ফরয।

শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত শ্রেষ্ঠ আমল। শ্রেষ্ঠ আমলে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হাছিল হয়। দ্বীনি-দুনিয়াবী সব কাজে সফলতা লাভের ক্ষেত্রে ছোহবতের বিকল্প নেই। ডাক্তার হতে হলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের ছোহবতে থাকতে হয়।ঞ্জইঞ্জিনিয়ার হতে হলে অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের। আলিম হতে হলে হক্কানী আলিমের ছোহবত প্রয়োজন। একইভাবে আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত, মুহব্বত হাছিলের জন্য, ওলীআল্লাহ হওয়ার জন্য এ পথের অভিজ্ঞ ব্যক্তি তথা আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত প্রয়োজন।

ছোহবত ব্যতীত আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন,  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত, মুহব্বত লাভ করা সম্ভব নয়। তাঁদের ছোহবত ব্যতীত গোমরাহ এবং শয়তানের খেলনার পাত্র হওয়া ছাড়া গন্ত্যান্তরই নেই। স্বয়ং ইমামে আ’যম, হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, যার মেছাল। তিনি বলেছেন,

لولا سنتان لهلك ابو نعمان

অর্থাৎ আবূ নু’মান (আবূ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি) যদি দু’টি বছর না পেত তাহলে ধ্বংশ হত।”

উল্লেখ্য যে, ইমামে আ’যম, আবূ হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমামুল মুত্তাকীন, সুলতানুল আওলিয়া, আওলাদে রসূল, হযরত ইমাম জাফর সাদীক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দু’বছর ছোহবত ইখতিয়ার করেছিলেন। মূলতঃ সব ইমাম, মুজতাহিদ, আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণই নিজ নিজ শায়খের ছোহবত ইখতিয়ার করেছেন।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছেন, বিশিষ্ট ছাহাবী, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যিনি কমপক্ষে ২৫০ বছর হায়াত মুবারকে ছিলেন। তিনি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেসাল শরীফের পর আফযালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ছিদ্দীকে আকবর, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট বাইয়াত হন এবং তাঁর ছোহবত ইখতিয়ার করেন।

খাইরুত তাবেয়ীন, হযরত ওয়ায়িস আল করনী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সমসাময়িক। কিন্তু ছোহবতের অভাবে সাহাবীর মর্যাদা লাভ করতে পারেননি।

খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মা, মুহইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, আশরাফুল আওলিয়া, হাকিমুল ইসলাম, মুজাদ্দিদে আ’যম, সুলতানুল আরেফীন, গাউছুল আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফের মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, “খাইরুত তাবেয়ীন হযরত ওয়ায়িস আল করনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যদি একটা মূহূর্তের জন্য আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত পেতেন তাহলে ছাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন।”

তিনি আরো বলেন, “আছহাবে কাহাফের ছোহবতে থাকার কারণে একটা কুকুর যদি জান্নাতী হয়ে যায় তাহলে আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির শ্র্রেষ্ঠ জীব) মানুষ। সেই মানুষ যদি আওলিয়ায়ে কিরামের ছোহবত ইখতিয়ার করে তাহলে তার ফায়সালা কি হতে পারে? সে কতটুকু মর্যাাদা লাভ করতে পারে? অর্থাৎ সে কতটুকু মুহব্বত-মা’রিফত হাছিল করতে পারে তা ফিকিরের বিষয়।

পক্ষান্তরে জলীলুর কদর রসূল হযরত নূহ আলাইহিস সালাম-এর ছেলে কেনান। সে কাফিরদের ছোহবতের কারণে নবুওয়াতী খান্দান হারিয়েছে এবং তাকে কাফিরদের দলে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে।

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

كل مولود يولد على الفطرة

অর্থঃ- “সব সন্তানই ফিতরাত তথা ঈমানদারের গুনাবলী নিয়েই জন্মগ্রহণ করে।” কিন্তু তাদের পিতা-মাতার ছোহবতের কারণে সে ইহুদী ও নাছারা হয়। অর্থাৎ যে যেরূপ লোকের ছোহবতে প্রতিপালিত হয় সে সেরূপ গুণাবলীর অধিকারী হয়।

আওলিয়ায়ে কিরামগণ শয়তানের আতঙ্ক। তাদেরকে সে খুবই ভয় পায়। যারা আউলিয়ায়ে কিরামের ছোহবত ইখতিয়ার করে, তাদের ব্যাপারে শয়তান নিরাশ। তাদেরকে গোমরাহিতে নিমগ্ন করা সম্ভব নয় হেতু তাদের নিকট গমন করতে চায় না।

আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাকছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ শরীফ

فقيه واحد اشد على الشيطان من الف عا بد.

অর্থঃ- শয়তানের নিকট এক হাজার আবিদ (ইবাদতকারী) অপেক্ষা একজন ফক্বীহ (সমঝদার) ব্যক্তি অধিক আতঙ্ক। আর প্রকৃত ফক্বীহ হচ্ছেন আওলিয়ায়ে কিরাম।

ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ইন্তিকালের সময় শয়তানের মুকাবিলা করার জন্য ১০০ হতে ১০০০ দলীল প্রস্তুত করেছিলেন। সব দলীলই শয়তান খণ্ডন করলো। এখন শুধু ঈমান হারাবার পালা। এমন সময় তার শায়খ দুর থেকে অজুর পানি নিক্ষেপ করে বললেন “হে ফখরুদ্দীন! তুমি বল, বিনা দলীলে আল্লাহ পাক এক।” এ কথা বলার সাথে সাথে শয়তান পালিয়ে গেল। ফিকিরের বিষয় ওলীআল্লাহগণের জবানের তাছির কত বেশি।

কাজেই আওলিয়ায়ে কিরাম এবং তাঁদের ছোহবত ইখতিয়ার কারীগণ শয়তানের সবচেয়ে বড় শত্রু। শয়তান তাঁদের সাথে প্রত্যক্ষ মুকাবিলা করতে না পেরে পরোক্ষভাবে তাঁদের ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়।

উলামায়ে “ছূ” দুনিয়াদার মাওলানা। যারা নাজায়িয, হারাম কাজে লিপ্ত। যারা হালালকে হারাম হারামকে হালাল ফতওয়া দিতে দ্বিধা করে না। আর যারা ফাসিক-ফুজ্জার, শয়তান তাদের কাঁধে ভর করে তাদেরকে আওলিয়ায়ে কিরামগণের প্রতি লেলিয়ে দেয়। মানুষ যেন কোনক্রমে আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করতে না পারে, তার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে।

পাশাপাশি যারা আওলিয়ায়ে কিরামগণের নিকট বাইয়াত হয়, যারা সালিক বা মুরীদ। আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফাত-মুহব্বতের অভিলাসী তাদেরকে ছোহবত থেকে জুদা করার  নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে।

যত নেক আমল আছে শয়তানের তাতে কোন বাঁধা নেই। বাধা শুধু আওলিয়ায়ে কিরামের ছোহবত এবং যিকির-ফিকির। পারিপার্শিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে সেটাই পরিস্ফুটিত হয়। অনেক লোক অনেক নেক আমল করে। তাহাজ্জুদ গোজার। চেহারায় নামাযের আলামত। রাত্রি জাগরণের চিহ্ন। কিন্তু আওলিয়ায়ে কিরামের ছোহবত ইখতিয়ার করতে নারাজ। তখন কোন সময় হয়না। যিকির করার সময় পায় না তারা। যিকির করতে মন চায় না। হঠাৎ দু’ একদিন করলেও ইস্তিকামত থাকতে পারে না। কারণ একটাই। শয়তানের ধোকা, প্রতারণা। তাছাড়া শয়তান শত কোশেশ করেও যদি কাউকে কোনভাবে আমল থেকে বিরত রাখতে না পারে তাহলে  তখন  তাকে অতিরিক্ত নফল ইবাদতের প্রতি রজু করে দেয়। তাতে আগ্রহ পয়দা করে কিন্তু আওলিয়ায়ে কিরাম-এর ছোহবত থেকে বিমুখ রাখে। কারণ ছোহবত থেকে বিরত থাকলে আমল হয় ইখলাছ মুক্ত। অন্তঃসার শূন্য। আর অন্তঃসার শূন্য আমলে কোন কামিয়াবী নেই।

শয়তান অনেক সালিককে নানা স্বপ্ন, লোভনীয় দৃশ্য দেখায়। এক  পর্যায়ে সে তা নিয়ে আত্ম তৃপ্তি অনুভব করে। তার উদ্দেশ্য সাধন হয়েছে বলে ছোহবত ইখতিয়ার করা ছেড়ে দেয়। ফলে আস্তে আস্তে শয়তানের ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে যায়।

মুদ্দা কথা শয়তান যদি কোন সালিক বা মুরীদকে তার শায়খ বা মুর্শিদের ছোহবত থেকে বিরত বা সরিয়ে রাখতে পারে তাহলে তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কাজে লাগাতে পারে। সেদিকেই লক্ষ্য করে আওলিয়ায়ে কিরামগণ বলেন,

من ليس له شيخ فشيخه شيطان.

অর্থৎ ‘যার শায়খ নেই তার শায়খ হচ্ছে শয়তান।”

নিচের ওয়াকেয়া দু’টির মধ্যে সালিক বা মুরীদের অনেক ইবরত-নছীহত রয়েছে।

সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা, কুতুবুল মাশায়িখ, সুলতানুল আরিফীন, হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদ শরীফে কাঁচের ব্যবসা শুরু করলেন। তিনি প্রতিদিন দোকানে গিয়ে সামনে পর্দা ফেলে দিতেন এবং উহার অন্তরালে চার শ’ রাকায়াত নামায পড়তেন। এরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হলো। অবশেষে তিনি দোকান ছেড়ে দিলেন এবং সাইয়্যিদুল আওলিয়া, মাহবুবে সোবহানী, ইমামুর রাসিখীন, হযরত র্সারী সাক্বতী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফে গেলেন। দরবার শরীফের একটি প্রকোষ্ঠে নির্জনে যিকির-ফিকির ও ইবাদতে মশ্গুল হলেন। নিজের আত্মার হিসাব-নিকাশ আরম্ভ করলেন। ক্রমে ক্রমে যিকির-ফিকির ও রিয়াজত-মুশাক্কাতে এতই মগ্ন হয়ে পড়লেন যে, মুরাকাবা অবস্থায় অনেক সময় আসনের নীচ হতে জায়নামায সরে ফেলতেন, যেন আল্লাহ্ পাকের যিকির ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে আসতে না পারে। এরূপে তিনি চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত ইশার নামাযের পর হতে ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে “আল্লাহ আল্লাহ” যিকির করতেন। আর ইশার ওযূ দ্বারাই ফজরের নামায আদায় করতেন।

তিনি বলেন, এক পর্যায়ে আমার মনে ধারণা জন্মিল যে, “আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।” এমন সময় গায়েবী আওয়াজ আসল, হে জুনাইদ! এখন কি তোমাকে তোমার পৈতার কোণ দেখাব? আরজ করলাম, আয় আল্লাহ পাক! জুনাইদের কি গুনাহ্ হলো? তখনই আবার গায়েবী আওয়ায আসল, “তুমি এখনও আছ, এখনও তুমি তোমার অস্তিত্বকে ভুলে যাওনি, নিজকে বিলীন করে দিতে পারনি। এর চেয়ে বড় গুনাহ্ তুমি আর কি দেখতে চাও? সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ মাথা নত করে রইলেন। অতঃপর বললেন,

من لم يكن للو صال اهلا فكل حسناته ذ نوب

অর্থঃ ‘যে এখনও মা’শুকের সাথে মিলিত হওয়ার উপযুক্ত হয়নি বস্তুতঃ তার প্রত্যেকটি নেক কাজই গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।’

অতঃপর পুনরায় তিনি সেই প্রকোষ্ঠে গিয়ে নির্জনতা অবলম্বন করলেন। সারা রাত তিনি সেখানে “আল্লাহ আল্লাহ্” যিকির করতে লাগলেন।  (তাযকিরাতুল আওলিয়া) য (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৯)

মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১২)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১১৪)