ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৭)

সংখ্যা: ১৫৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গ: “নিজের শায়খ বা মুর্শিদের কোন দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কোন বিষয়ে তাঁর সমালোচনা করবে না। কারণ, যারা আউলিয়ায়ে কিরামগণের চরিত্র মুবারকে ছিদ্রান্বেষণ করে তাদের মত হতভাগ্য আর কেউ নেই।” (মাকতুবাত শরীফ)

যে সমস্ত মুরীদ নিজের শায়খ-এর শানের খিলাফ চিন্তা করে। শায়খ-এর সমালোচনা করে, কিংবা তাঁর দোষত্রুটি তালাশ করে তারাও কখনো হিদায়েত পাবে না। ধ্বংস তাদের অবশ্যাম্ভবী। নিম্নের আয়াত শরীফখানা তাদের জন্যও প্রযোজ্য।

كيف يهدى الله قوما كفر وا بعد ايما نهم وشهد وا ان الرسول حق وجاءهم البينا ت والله لا يهدى القوم الظلمين اولئك جزاؤهم ان عليهم لعنة الله والملا ئكة والنا س اجمعين. خلجين فيها لا يخفف عنهم  العذاب ولا هم ينظرون.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক এমন জাতিকে কী করে হিদায়েত দিতে পারেন, যারা ঈমান এনে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (এবং নায়েবে রসূলকে) সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ার পর এবং তাদের কাছে আল বাইয়্যিনাত তথা সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও কুফরী করে। মূলত: এরূপ জালিম সম্প্রদায়কে আল্লাহ পাক হিদায়েত দান করেন না। আর এমন লোকের শাস্তি হলো, তাদের উপর আল্লাহ পাক-এর, ফেরেশ্তাগণের এবং সকল মানুষের লা’নত বা অভিসম্পাত। আবাদুল আবাদ (অনন্তকাল) তারা সেই লা’নতের মধ্যে থাকবে। তাদের আযাব হালকা করা হবে না এবং কোন অবকাশও দেয়া হবে না।” (সূরা আলে ইমরান/ ৮৬-৮৮)

সালিক বা মুরীদকে তার শায়খ সম্পর্কে সেরূপ আক্বীদা পোষণ করা, হুসনে যন (সুধারণা) রাখা এবং আচার-আচরণ করা যেরূপ নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণ মহান আল্লাহ পাক-এর সাথে করতেন। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম আল্লাহ পাক সম্পর্কে বলেন,

الذى خلقنى فهو يهد ين والضى هو يطعمنى ويسقين واذا مر ضت فهو يشفين.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক তিনি ঐ সত্ত্বা, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনিই আমাকে হিদায়েত দান করেন। তিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন। আর যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আমাকে শিফা (আরোগ্য) দান করেন।” (সূরা শুয়ারা/ ৭৮-৮০)

কিন্তু হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম এ কথা বলেননি যে,

واذا أمر ضنى.

অর্থাৎ- “যখন তিনি আমাকে রোগাক্রান্ত করেন। অত:পর শিফা (আরোগ্য) দান করেন।”

কারণ এভাবে বলা আল্লাহ পাককে দোষারোপ করার নামান্তর। আল্লাহ পাক-এর প্রতি খারাপ ও কষ্টদায়ক বিষয়ের নিছবত করা আদবের খিলাফ। আর সেটা মুহব্বতেরও আলামত নয়।

এমনিভাবে হযরত খিযির আলাইহিস্ সালাম হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম-এর সাথে নদী পার হলেন। অত:পর নৌকাটি ভেঙ্গে দিলেন। হযরত খিযির আলাইহিস্ সালাম নৌকাটি ভেঙ্গে দেয়ার কারণ স্বরূপ বললেন,

فاردت ان اعيبها.

অর্থঃ- “আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে (নৌকা) ত্রুটিযুক্ত করে দেই।” (সূরা কাহাফ-৭৯)

মূলত:  তিনি নিজের থেকে তা করেননি। বরং তিনি আল্লাহ পাক-এর নির্দেশে করেছেন। কিন্তু সেটা তিনি উল্লেখ করেননি যে,

فاراد ربك ان اعيبها.

অর্থাৎ- “আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করেছেন যে, আমি যেন এটাকে ত্রুটিযুক্ত করে  দেই।” অথচ বালক দু’জনের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

فاراد ربك ان يبلغا اشدهها.

অর্থঃ- “আপনার পালনকর্তা দয়াবশত: ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পন করুক।” (সূরা কাহাফ-৮২)

কারণ  তাতে আল্লাহ পাক-এর মহত্ত্ব ও বড়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। কাজেই সেখানে আল্লাহ পাক-এর সাথে নিছবত করেছেন।

হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম দোয়া করেছেন,

ربنا ظلمنا انفسنا وان لم تغفر لنا و تر حمنا لنكو نن من الخسرين.

অর্থঃ- “আয় আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। আর আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং রহম (অনুগ্রহ) না করেন তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।” (সূরা আরাফ-২৩)

কিন্তু তিনি এটা বলেননি যে,

رب قدرت على وقضيت.

অর্থঃ- “আয় আমার রব! আপনি আমার জন্য এটা নির্ধারণ করেছেন হেতু আমি তা পূর্ণ করেছি।”

হযরত আইয়ুব আলাইহিস্ সালাম দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত ছিলেন। এমনকি তাঁর পরিবার-পরিজন সবাই তাঁকে বাড়ির অদূরে লোকালয়ের বাইরে রেখেছিলো। কিন্তু তিনি কোন হা-হুতাশ কিংবা অভিযোগ করেননি। তিনি ছবর বা ধৈর্যের এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ পাকই করেছেন,

وايوب اذنادى ربه انى مسنى الضر وانت ارحم الر حمين.

অর্থঃ- “(নছীহত গ্রহণের জন্য) হযরত আইয়ুব আলাইহিস্ সালাম-এর প্রতি লক্ষ্য করুন! তিনি তাঁর রবকে এই বলে আহ্বান করলেন, “আয় আমার রব! আমি দুঃখ কষ্টে পতিত হয়েছি। আর আপনি দয়াবানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান।” (সূরা আম্বিয়া-৮৩)

কিন্তু তিনি বলেননি যে, فعا فنى واشفنى.

অর্থঃ- “আমাকে ক্ষমা করুন এবং আরোগ্য দান করুন।”

অর্থাৎ নবী-রসূল আলাইহিস্ সালামগণ আল্লাহ পাককে কখনও দোষী সাব্যস্ত করেননি বা দোষারোপ করেননি। বরং প্রতিক্ষেত্রে নিজেদের ওজুদ মুবারক ফানা করে নিজেদেরকে  জাহির করতেন। আর  আল্লাহ পাক-এর পবিত্রতা, মহত্ব-বড়ত্ব বর্ণনা করতেন।

অনুরূপভাবে ফেরেশ্তাগণ আল্লাহ পাক-এর মহত্ব-বড়ত্ব, শান-মানকে অক্ষুণœ রাখতেন। তাঁর মহান শানের খিলাফ কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি। আল্লাহ পাক হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টির প্রাক্কালে ফেরেশ্তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

انى جاعل فى الا رض خليفة.

অর্থাৎ- “আমি যমিনে খলীফা বা প্রতিনিধি পাঠাতে চাই?” (সূরা বাক্বারা-৩০)

ফেরেশ্তাগণ তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছিলেন, “আল্লাহ পাক! তারা তো সেখানে গিয়ে মারামারি-কাটাকাটি করবে। রক্ত প্রবাহিত করবে। আর তাসবীহ-তাহলীলের জন্য আমরাই তো যথেষ্ট।”

আল্লাহ পাক বললেন, “আমি যা জানি তোমরা তা জান না।”

তখন ফেরেশ্তারা বললেন,

سبحنك لا علم لنا الا ما علمتنا

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক! আমরা আপনার মহান পবিত্রতা বর্ণনা করছি। মূলত: আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের কোন ইল্ম নেই।” (সূরা বাক্বারা-৩৩)

পক্ষান্তরে ইবলিসকে যখন প্রশ্ন করা হলো, “হে ইবলিস! তোমাকে আমার আদেশ পালন করা থেকে কিসে বিরত রাখলো?”

সে বললো,

انا خير منه خلقتنى من نار وخلقته من طين.

অর্থঃ- আমি (ইবলিস) হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শ্রেষ্ঠ কারণ “আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাঁকে (হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আরাফ-১৩)

আগুন তো মাটি থেকে শ্রেষ্ঠ। কাজেই মাটির তৈরী আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজদা করা কিভাবে সমীচীন হতে পারে?

ইবলিস প্রমাণ করলো যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজদা করার আদেশ দেয়া শুদ্ধ হয়নি। (নাঊযুবিল্লাহ)

যারা নিজের শায়খ-এর ছিদ্রান্বেষণ করে, তাঁর কাজের সমালোচনা করে তারা মূলত: ইবলিসের উত্তরসূরী। তাদের কাঁধে ইবলিস সাওয়ার হয়েছে এবং তাদের ক্বলবে বাসা বেঁধেছে। তারাও ইবলিসের মত নিজেদেরকে নির্দোষ ও শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে চায় আর মুর্শিদের কাজ সঠিক নয় বলে সাবিত (প্রমাণ) করতে চায়। (নাঊযুবিল্লাহ) কাজেই তারাও ইবলিসের মত লা’নতগ্রস্ত, মালউন।

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বাদশাহ্ সুলতান মাহমুদ। তাঁর একজন খাদিম ছিলেন। যিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহিযগার, আল্লাহওয়ালা। জ্ঞানে-গুণে ও বুদ্ধিমত্তায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। সুলূকের পথের পথিকদের জন্য তাঁর জীবন মুবারকে অনেক ইবরত-নছীহত রয়েছে।

একদিন সুলতান মাহমুদ তাঁর খাদিম হযরত আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি অতি মূল্যবান জিনিস দিয়ে বললেন, “এটা ভেঙ্গে কোথাও ফেলে দাও।” খাদিম যথাযথভাবে সে হুকুম তামিল করলেন।

পরেরদিন সুলতান মাহমুদ সেই মূল্যবান জিনিসের খোঁজ করলেন। খাদিম হযরত আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি সবিনয়ে জানালেন, “গোস্তাখী মাফ চাই জাহাঁপনা। গতকাল আমি সেটা ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছি।” এটা শুনে সুলতান মাহমুদ বললেন, “তুমি সেটা কিভাবে ভাঙ্গতে পারলে। এমন মূল্যবান জিনিস ফেলে দিতে একটুকুও কুক্তিত হলে না।”

খাদিম হযরত আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি আযীযী, ইনকেসারী (কাকুতি-মিনতি) করে বললেন, “গোস্তাখী মাফ চাই জাহাঁপনা। আমার ভুল হয়েছে।”

ফিকিরের বিষয়, তিনি কিন্তু বলতে পারতেন, জাহাঁপনা! আপনার হুকুমই তো আমি তা ভেঙ্গে ফেলেছি। কিন্তু তা বললেন না।

কারণ, সুলতানকে সে জাোয়াব দিলে সুলতানই দোষী সাব্যস্ত হন। আর খাদিম হন নির্দোষ। যা আদবের খিলাফ। নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করাই হচ্ছে হাক্বীক্বী খাদিমের পরিচয়।

কাজেই প্রত্যেক সালিক বা মুরীদেরই এরূপ অবস্থা হোয়া আবশ্যক। আয় আল্লাহ পাক! যামানার মহান মুজাদ্দিদ, মুজাদ্দিদে আ’যম মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর উছীলায় সবাইকে নিজ নিজ শায়খ-এর সাথে সেরূপই আচরণ করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)