-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
৫১। “নিজের শায়খ বা মুর্শিদের কোন দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কোন বিষয়ে তাঁর সমালোচনা করবে না। কারণ, যারা আওলিয়ায়ে কিরামগণের চরিত্র মুবারকে ছিদ্রান্নেষণ করে তাদের মত হতভাগ্য আর কেউ নেই।” (মাকতুবাত শরীফ)
শায়খ বা মুর্শিদকে ওলীআল্লাহ বলে স্বীকৃতি দেয়া, তাঁর ছোহবতের ফায়দা হাছিল করা আবার তাঁর দোষ-ত্রুটি তালাশ করা কিংবা ছিদ্রান্নেষণে লিপ্ত হওয়া প্রকাশ্য মুনাফিকী ছাড়া কিছুই নয়। ওলীআল্লাহ অর্থ আল্লাহ পাক-এর বন্ধু। যারা আল্লাহ পাক-এর বন্ধু, যাদের প্রতি আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তুষ্ট তাঁদের সমালোচনা করা, তাঁদের চরিত্র মুবারক সম্পর্কে বিরূপ চিন্তা করা কত জঘন্যতম গুনাহ্র কারণ তা বলাইবাহুল্য।
উল্লেখ্য, কোন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমই আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মুবারকে ছিদ্রান্নেষণ করেননি। যারা করেছে তারা ছাহাবী নয়। তারা মুনাফিক। তারা কাফির-মুশরিকের চেয়েও নিকৃষ্ট।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
ان المنفقين فى الدرك الا سفل من النار ولن تجد لهم نصيرا.
অর্থঃ “নিশ্চয়ই মুনাফিকদের অবস্থান স্থল জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তারা কখনই কোন সাহায্যকারী পাবে না।” (সূরা নিসা-১৪৫)
মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সুলূল। সে কাফির সরদার আবু জাহিল, আবু লাহাব প্রমূখ থেকে বেশি খারাপ। তার শাস্তিও অধিক। কারণ আবূ জাহিল, আবু লাহাব প্রমুখ কাফিররা প্রকাশ্য বিরোধিতা করতো। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দানের বিষয়টিও ছিল সকলের বোধগম্য।
আর মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সূলূল। সে সব সময় আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছোহবত ইখতিয়ার করতো। যাহিরী (বাহ্যিক) ভাবে রসূল হিসেবে স্বীকার করতো।
কিন্তু অন্তর ছিল বিরোধিতায় ভরা, কুফরীতে পূর্ণ। কখন, কিভাবে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্ষতি সাধন করা যায় তারই ফিকিরে সবসময় লিপ্ত থাকতো, মিথ্যা তোহমতের ইলজামকে অন্তরে লালন করতো। তাঁর পুত-পবিত্র চরিত্র মুবারকে দোষ-ত্রুটি তালাশ করতো। (নাঊযুবিল্লাহ)
তৃতীয় হিজরীতে ওহুদ জিহাদ সংঘটিত হয়। ওহুদ জিহাদে গমনের প্রাক্কালে আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামূল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র শানে জঘন্যতম মিথ্যা তোহমত লেপন করে বললো, তিনি জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞ-বয়স্ক ছাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মাশওয়ারা (পরামর্শ) কে উপেক্ষা করলেন। আর যুদ্ধে অনভিজ্ঞ, অল্প বয়স্ক-যুবকগণের মাশওয়ারাকে প্রাধান্য দিলেন। যা মেনে নেয়া যায় না। (নাঊযুবিল্লাহ)
কাজেই ওহুদ জিহাদে অংশ গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত নয় বলে তিনশতেরও অধিক মুজাহিদ নিয়ে অর্ধ রাস্তা থেকে ফিরে আসলো। তার ধারণা (গালিব) প্রবল ছিল যে, এভাবে চলে গেলে মুসলমানগণের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকী সাতশত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে নিয়েই জিহাদে অবতীর্ণ হলেন এবং পূর্ণরূপে বিজয় লাভ করলেন।
একইভাবে নবম হিজরী রজব মাসে তাবুক জিহাদের প্রাক্কালে সেই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটালো। তবে তা ছিল আরো অভিনব কায়দায়। পঞ্চম হিজরীতে বনি মুস্তালিকের জিহাদ সংঘটিত হয়। সেই জিহাদ শেষে বিজয় বেশে প্রত্যাবর্তন কালে খাইরু নিসায়িল আলামীন, আলামুন নাস, আফছাহুল লিসান ওয়াল বয়ান, সাইয়্যিদাতুত্ ত্বাহিরাত, উম্মাহাতুল মু’মিনীন, আম্মাজান, হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার গলা মুবারকের হার মুবারক হারিয়ে যায়। মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সুলূলের সুযোগ সন্ধানী মন আনন্দ ভরে উঠেছিল। তাঁর প্রতি তোহমত বা অপবাদ দেয়া তথা ইফ্কের ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
যার পুত-পবিত্র চরিত্র মুবারকের সত্যায়ন করেন স্বয়ং আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ পাক। এ ব্যাপারে সূরা নূরে দশখানা আয়াত শরীফ পর্যন্ত নাযিল করলেন।
যার পবিত্রতার বিপরীত চিন্তা উদয় হওয়াটাও কাট্টা কুফরী বলে গন্য হয়। তাঁরই পুত-পবিত্রতম শানে মিথ্যা তোহমতের ইলজাম লাগায় জাহান্নামের কীট মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সুলূল।
পরবর্তীকালে এ ধরনের মুনাফিক থেকে দুনিয়া মুক্ত থাকবে তা কল্পনা করা যায়না। মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সুলুলের বংশাবদরাও আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ ও মূল নায়িব বা প্রতিনিধি হযরত আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবতে থেকে তাদের পূর্বপূরুষ উবাই ইবনে সুলূলের অনুসৃত পথে মুনাফিকী করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে ছূফী-দরবেশ, মুরীদ-মু’তাক্বিদগণকে এ ধরনের মুনাফিকদের সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, যারা আওলিয়ায়ে কিরামগণের ছোহবত ইখতিয়ার করে তাঁদেরকে ওলীআল্লাহ বলে স্বীকার করে অথচ সেই আওলিয়ায়ে কিরাম তথা শায়খ বা মুর্শিদের পুত-পবিত্র চরিত্র মুবাকের ছিদ্রান্নেষণ করে, তাঁর দোষ-ত্রুটি তালাশ করে কিংবা সমালোচনা করে তারা মুনাফিক সরদার উবাই ইবনে সুলূলের মত নিকৃষ্ট, লা’নতপ্রাপ্ত এবং জাহান্নামের সর্বনিম্নে অবস্থানকারী ব্যক্তি।
মূলতঃ কাফির এবং মুনাফিকরাই আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুতঃপবিত্রতম চরিত্র মুবারকে দোষ-ত্রুটি তালাশ করতো। আল্লাহ পাক তার জাওয়াব দিতেন। এ প্রসঙ্গে কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
ومنهم الذين يؤذون النبى ويقو لون هو اذن قل اذن خير لكم يؤمن بالله ويؤ من للمؤمنين ورحمة للذ ين امنوا منكم والذين يؤذون رسول الله لهم عذاب اليم.
অর্থঃ- “আর তাদের (কাফির-মুনাফিক) মধ্যে এমনও কিছু লোক আছে যারা রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয় এবং বলে, তিনি তো কান পাতলা লোক। তিনি প্রত্যেকের কথাই শুনে থাকেন। (হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলুন, তিনি তোমাদের কল্যাণার্থে তোমাদের কথা শুনে থাকেন। তিনি আল্লাহ পাক-এর প্রতি বিশ্বাস রাখেন এবং মু’মিনগণের কথা বিশ্বাস করেন। মুলতঃ তিনি মু’মিনগণের জন্য রহমতস্বরূপ। কাজেই যারা (এরূপ কথা বলে) রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিবে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (সূরা তওবা- ৬১)
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন,
ان الذين يؤذون الله ورسو له لعنهم الله فى الدنيا والاخرة واعدلهم عذابا مهينا.
অর্থঃ- “যারা আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জাহানে রয়েছে লা’নত (অভিসম্পাত)। আর আমি তাদের জন্য বিশেষভাবে লাঞ্ছনাদায়ক আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছি।” (সূরা আহযাব-৫৭)
কাজেই, বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যারা নিজের শায়খ বা মুর্শিদকে কষ্ট দেয়ার ফিকির করে এবং তাঁর চরিত্র মুবারকে দোষ-ত্রুটি তালাশ করে তারাও একইভাবে লা’নতগ্রস্থ তথা নিকৃষ্ট জীবের অন্তর্ভুক্ত।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
والذين يؤذ ون المؤ منين والمؤمنت بغير ما اكتسبوا فقد احتملوا بهتا نا واثما مبينا.
অর্থঃ- “আর যারা মু’মিন এবং মু’মিনাদেরকে কষ্ট দেয় এমন কোন কাজের দোষারোপ দ্বারা যার সাথে তাঁরা সংশ্লিষ্ট নন, তারা প্রকৃত পক্ষে মিথ্যাপবাদ এবং স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।” (সূরা আহযাব-৫৮)
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন,
ان الذين فتنوا المؤ منين والمؤمنت ثم لم يتويوا فلهم عذاب جهنم ولهم عذاب الحريق.
অর্থঃ- “যারা মু’মিন মু’মিনাদেরকে কষ্ট দেয় অতঃপর তওবাও করে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং বিশেষ করে রয়েছে দহন যন্ত্রণা।” (সূরা বুরূজ-১০)
লা’নত আর আযাব-গযব ব্যতীত তাদের জন্য কি থাকতে পারে? কারণ রহমত পাওয়া, নাজাত লাভ করার মূল আমল হচ্ছে আওলিয়ায়ে কিরাম তথা স্বীয় শায়খ-এর মুহব্বতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
المرء مع من احب
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি যাকে মুহব্বত করে সে তার সাথেই অবস্থান করবে।” (বুখারী, মুসলিম)
সেক্ষেত্রে যারা সেই মুহব্বতটুকু অন্তরে ধারণ করতে পারে না। উপরন্ত বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়, খুঁত তালাশ করে তারা লা’নতেরই উপযুক্ত বৈকি।
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)