ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০৫)

সংখ্যা: ১৫৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ শায়খ বা মুর্শিদ হচ্ছেন ক্বিবলায়ে কুলূব তথা অন্তরের ক্বিবলা। কাজেই নামাযের ক্বিবলার ন্যায় তাঁর তা’যীম-তাকরীম করবে।

পূর্ববর্তী ইমাম-মুজতাহিদ এবং আওলিয়ায়ে কিরামগণ নিজ নিজ শায়খ বা মুর্শিদকে ‘ক্বিবলা’ বানিয়ে নিয়েছিলেন। নামাযের ক্বিবলার ন্যায় ক্বিবলায়ে কুলূবকে তা’যীম-তাকরীম করতেন।

এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একদা কোন অপরাধে শায়খ আযল তিব্রিজী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে শহীদ করার জন্য জল্লাদের হাতে অর্পণ করা হয়। জল্লাদ তাঁকে শহীদের স্থানে নিয়ে যায় এবং ক্বিবলামূখী করে দাঁড় করে। শায়খ আযল রহমতুল্লাহি আলাইহি দেখলেন যে, তাঁর মুর্শিদ ক্বিবলার মাযার শরীফ তাঁর পিছনে পরে। তখন তিনি ক্বিবলার দিক হতে ফিরে নিজ মুর্শিদ ক্বিবলার মাযার শরীফের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। জল্লাদ তাঁকে বললো যে, আপনি এখন যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন তাতে আপনাকে ক্বিবলার দিকেই মুখ করা কর্তব্য। হযরত শায়খ আযল রহমতুল্লাহি আলাইহি দীপ্তকণ্ঠে উত্তর দিলেন, “তোমার তা দিয়ে কি কাজ। তুমি তরবারী উঠাও এবং আমার ঘাড়ের উপর মার। আমি আমার মুখ নিজ ক্বিবলার দিকেই করে আছি। তুমি বুঝবে না।” এতে জল্লাদের সাথে তর্ক বেঁধে যায়। এই তর্ক বাকি থাকতেই শাহী ফরমান (আদেশ) এসে উপস্থিত হলো যে, “দরবেশকে ক্ষমা করা হলো। তাঁেক মুক্ত করে দাও।”  (তাযকিরাতুল আওলিয়া)

“ফাওয়ায়িদুস্ সালিকীন” কিতাবে লিখিত আছে যে, “কুতুবুল আকতাব, সুলতানুল আওলিয়া, শাইখুল মাশায়িখ হযরত বখতিয়ার কাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন এই ঘটনা বয়ান করছিলেন, তখন তিনি অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বললেন, ‘সেই ফকীরের বিশুদ্ধ আক্বীদাই তাঁকে শহীদ হওয়া থেকে মুক্ত করেছিলো।” (সুবহানাল্লাহ)

এ প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত আছে যে, শাহ্ কুতুবুদ্দীন হায়দার রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ ছিলেন। তিনি একদিন অতি ক্ষুধার্ত অবস্থায় ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন সোহারওয়ার্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর খানকা শরীফে উপস্থিত হলেন। নিজ মুর্শিদ ক্বিবলার আবাসস্থলের দিকে মুখ ফিরিয়ে এই বলে প্রার্থনা করতে লাগলেন,

يا قطب الد ين حيدار شيأ لله.

“হে আমার শায়খ কুতুবুদ্দীন হায়দার রহমতুল্লাহি আলাইহি!

আল্লাহ পাক-এর ওয়াস্তে আমাকে সাহায্য করুন।” ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি পর্যন্ত এই ডাক পৌঁছলো। তিনি নিজ খাদিমকে নির্দেশ দিলেন, এই দরবেশকে শীঘ্রই খাবার দাও। খাওয়া শেষ হলে আমাকে খবর দিও। খাদিম তাকে খাবার দিলো। দরবেশ খাওয়া শেষ করে পূনরায় নিজ মুর্শিদ ক্বিবলার আবাস স্থলের দিকে ফিরে তাঁর শোকর আদায় করতঃ বলতে লাগলেন, “হে আমার শায়খ কুতুবুদ্দীন হায়দার রহমতুল্লাহি আলাইহি! আমার খুবই উপকার করলেন। এমনভাবে আহার করালেন যে, আমি পরিতৃপ্ত।”

খাদিম শায়খকে এ খবর দিলো, এমন অকৃতজ্ঞ দরবেশ কখনো দেখিনি। সে হুযূরের খাবার খেয়ে নিজ মুর্শিদের কৃতজ্ঞতা জানালো।” ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ তরীক্বত হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “ঐ ব্যক্তি ছিলেন ফেরেশ্তা। তোমাদেরকে আদব ও তরতীব শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।” অর্থাৎ যা কিছু প্রার্থনা করবে স্বীয় শায়খের দিকে ফিরে শায়খের কাছেই প্রার্থনা করবে। আর সমস্ত প্রশংসার তিনিই হক্বদার। মুরীদের চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্যস্থল হচ্ছে তার শায়খ বা মুর্শিদ।

কিতাবে আরো উল্লেখ রয়েছে, “কোন এক মুরীদ একবার নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখতে পেল, পানির উপর একখানা হাত বের হলো। আওয়াজ আসলো, “এ হাত ধরো, তুমি নিমজ্জিত হওয়া থেকে উদ্ধার পাবে।” মুরীদ  জিজ্ঞাসা করলো, ‘এই হাত কার?’ উত্তর আসলো, “তোমার শায়খের শায়খগণের মধ্যে অমুক শায়খের।” সে ব্যক্তি ঐ হাত ধরতে অস্বীকৃতি জানালো। অতঃপর অপর এক হাত পানির উপর দৃষ্টিগোচর  হলো এবং বললো, ‘এই হাত ধরো।’ মুরীদ প্রশ্ন করলো, ‘এ হাত কার?’ উত্তর আসলো, “এ হাত সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর।’ মুরীদ সে হাত মুবারকও ধরতে রাজী হলো না। বললো, “আমি এ হাতে নিজ হাত দেইনি।”  অর্থাৎ  আমি এ হাত মুবারকের উপর বাইয়াত গ্রহণ করিনি। তখন আবার অপর এক হাত পানির উপর প্রকাশ হলো এবং বললো, ‘এ হাত ধরো।’ মুরীদ পুনঃরায় প্রশ্ন করলো, ‘এ হাত কার?’ উত্তর আসলো, ‘এ হাত তোমার মুর্শিদ ক্বিবলার।’ তখন মুরীদ সেই হাত ধরলো এবং নিমজ্জিত হওয়া  থেকে রক্ষা পেলো।”

উল্লিখিত অবস্থাগুলো ফানা ফিশ্ শায়খের হাল। যারা ফানা ফিশ্ শায়খের মাক্বামে অবস্থান করেন তার দৃষ্টিপথে স্বীয় শায়খ ছাড়া অন্য কেউ আসেনা। গাউছুল আযম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একজন মুরীদ ছিলেন। যিনি এই মাক্বামে অধিষ্ঠিত থাকাবস্থায় ইন্তিকাল করেছিলেন। তাঁকে সুওয়াল-জাওয়াব করার জন্য কবরে মুনকার-নকীর ফেরেশ্তাদ্বয় প্রবেশ করলেন। সুওয়াল করলেন, ‘আপনার রব কে? আপনার দ্বীন কি?’  ‘আপনার নবীর নাম কি?’ সব প্রশ্নের জাওয়াবে তিনি বলেছিলেন, “গাউছুল আযম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি।”

ফেরেশ্তাদ্বয় আল্লাহ পাক-এর নিকটে আরজ করলেন, ‘আল্লাহ পাক! ইনি কেমন লোক? যিনি সব সুওয়ালের জাওয়াবে একই রকম উত্তর দিচ্ছেন যে, ‘গাউসুল আ’যম হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি।’

আল্লাহ পাক ফেরেশ্তাদ্বয়কে বললেন, ‘তোমরা চলে আস। সে আমার বন্ধুর লোক। তাঁকে সুওয়াল-জাওয়াব করতে হবেনা।’ (সুবহানাল্লাহ)

মূলত: মুরীদের সেরূপ হালই হওয়া উচিত। কারণ, সেরূপ হাল ব্যতীত আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত, মুহব্বত, নৈকট্য ও রেজামন্দি হাছিল করা কঠিন।

একবার সাইয়্যিদুত্ ত্বায়িফা, কুতুবুল আওলিয়া, ইমামুল মুহাক্কিক্বীন হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি একজন মুরীদসহ ছফরে বের হলেন। পথিমধ্যে একটা নদী পড়লো। নদী পাড় হওয়ার মত কোন নৌযান পেলেন না। তিনি ফিকির করলেন, কিভাবে নদী পাড় হবেন। নিজের জন্য সে ফিকির নয়। তিনি হেঁটেই নদী পাড় হতে পারবেন। কিন্তু তার ছফর সঙ্গী মুরীদ সে তো নবাগত। সে কিভাবে নদী পাড় হবে। পরিশেষে তিনি উক্ত মুরীদকে বললেন, আমি যখন নদীর উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করবো তখন তুমি আমাকে ডাকতে ডাকতে পিছনে পিছনে চলতে থাকবে।

শায়খের আদেশ মত উক্ত মুরীদ তাঁর সাথে সাথে নদী পাড় হচ্ছিলো। মধ্য নদীতে পৌঁছে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘আমি তো আল্লাহ পাককে ডাকতে পারি। তাঁর কাছে গায়িবী মদদ তলব করতে পারি।’

একথা ভেবে সে আল্লাহ পাককে ডাকতে শুরু করলো। আল্লাহ পাক-এর মদদ তলব করলো। আল্লাহ পাক-এর কুদরত সাধারণ ব্যক্তিরা কি বুঝবে? তখন সে মুরীদ নদীতে ডুবে যাচ্ছিলো। এদিকে সাইয়্যিদুত্ ত্বয়িফা, সুলতানুল আওলিয়া, ইমামুল মুহাক্কিক্বীন রহমতুল্লাহি আলাইহি মুরীদের ডাক শুনতে না পেয়ে পিছনে তাকালেন। দেখলেন, সে মুরীদ নদীতে নিমজ্জিত হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘তোমাকে না বলেছিলাম, আমাকে স্মরণ করতে? তুমি আমাকে ডাকতে থাকো।’ তখন সে মুরীদ আবারো ‘হে আমার শায়খ, হে আমার শায়খ বলে ডাকতে শুরু করলো এবং নদী পাড় হয়ে গেলো।’ (সুবহানাল্লাহ) (তাযকিরাতুল আওলিয়া)

শাইখুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, সুলত্বানুল আরিফীন হযরত আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এরূপ ওয়াকেয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন।

একবার দু’জন লোক আসলেন। তাঁর নিকট বাইয়াত হলেন। তিনি তাদেরকে সবক দিলেন আর বললেন, ‘তোমরা যদি কোন সময় বিপদ-আপদের সম্মুখীন হও; তখন আমাকে স্মরণ করিও।’

তারা শায়খের অনুমতিক্রমে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়লো। ডাকাতরা তাদের কাফেলার উপর আক্রমন করলো তখন ‘একজন মুরীদ তাঁর শায়খের কথা স্মরণ করলো।’ অপর মুরীদ ‘আল্লাহ পাককে স্মরণ করলো।’ ডাকাতরা কাফেলার সবাইকে মারধর করলো। মাল-সম্পদ যা ছিলো সব লুটপাট করলো। তারা চলে যাওয়ার পর কাফেলার লোকজনসহ অপর মুরীদকে দেখতে পেল যে, অক্ষত অবস্থায় বহাল তবিয়তে সেখানে সে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এরূপ সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে সবাই আশ্চার্যান্বিত হলো। জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি এরূপ সুস্থ্য থাকলে কিভাবে?’ সে জানালো, ‘কেন? তুমি কি তোমার শায়খের আদেশ ভুলে গিয়েছিলে? আমি মনে মনে আমার শায়খের কথা স্মরণ করছিলাম। ডাকাতরা আমাকে কোন জিজ্ঞাসাই করলোনা।

পরবর্তীতে তারা উভয়ে তাদের শায়খের কাছে ফিরে গেলো। জানতে চাইলো তার হিকমত। সুলতানুল আরিফীন হযরত আবুল হাসান খানকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “আমি তোমাদের হিফাযতের জন্যেই আল্লাহ পাককে ডাকি। আমার ডাক আল্লাহ পাক-এর নিকট কুবল হয়। ফলে, যে আমাকে ডাকে আল্লাহ পাক তাকে হিফাযত করেন। আর তোমার ডাক কবুলযোগ্য নয় হেতু তুমি আল্লাহ পাককে যতই ডাক না কেন তোমাকে হিফাযত করেননি।” (তাযকিরাতুল আওলিয়া)

মুরীদের সব আমল তথা ইবাদত-বন্দিগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মাশাক্কাত হবে ক্বিবলায়ে কুলূবকে কেন্দ্র করে। ইমামে রব্বানী, গাউছে ছামদানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন, “আমি আল্লাহ পাক-এর ইবাদত করি যেহেতু তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আল্লাহ পাক।” এ বক্তব্যকে ফানা র্ফি রসূল-এর মাক্বামে অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ মনে করা হয়।

আর যারা ফানা ফিশ্ শায়খের মাক্বামে অধিষ্ঠিত থাকে তাদের বক্তব্য হয় যে, “আমি আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব নূরে মুজাস্সাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইবাদত-বন্দিগী এবং ইতায়াত এজন্য করি যেহেতু তিনি আমার শায়খের আল্লাহ পাক এবং তিনি আমার শায়খের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তাঁর ইবাদত-বন্দিগী করতে বলেন। যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মাশাক্কাত করলে আমার শায়খ খুশী হন।”

যারা ফানা ফিশ্ শায়খের মাক্বামে অধিষ্ঠিত হন তাঁরা ক্বিবলায়ে কুলূবকে এমনভাবে প্রাধান্য দেন যে, যদি পূর্ববর্তী কোন মাশহুর আওলিয়ায়ে কিরামের সাথে সাক্ষাত হয় কিংবা তারা যদি তাকে কোন নিয়ামত দিতে চান তাহলে তারা সে নিয়ামত শুধু প্রত্যাখানই করেন না বরং শায়খের অনুমতি ব্যতীত তার সাথে কোন কথাই বলেন না। (সুবহানাল্লাহ)

অর্থাৎ যদি কোন নিয়ামত পেতে হয় তাহলে নিজের শায়খ থেকেই পাবে বলে বিশ্বাস করে। আর অন্য কোন মাধ্যমে আসাকে শয়তানের ধোকা বলে প্রত্যাখান করে।   (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)