ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (১০০)

সংখ্যা: ১৫১তম সংখ্যা | বিভাগ:

হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

 প্রসঙ্গ-মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ ফরজন্দকে তাঁরই জাত হিসেবে তাঁর তুল্য সম্মান করবে। তাঁর আত্মীয়দেরকেও পরম ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। আহলে বাইত ও আওলাদে রসূলগণ যেমন উম্মতের জন্য রহমত-বরকত, ছাকীনা লাভের উছিলা মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ-ফরজন্দগণও তেমনি মুরীদের জন্য রহমত-বরকত ও ছাকীনা লাভের উছীলা।  ইমামে আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ ছিল আওলাদে রসূলদের সম্মান-ইজ্জত প্রদান। তিনি একবার একজন অল্প বয়স্ক শিশু আওলাদে রসূলের সম্মানার্থে একাধিকবার দাঁড়িয়ে ছিলেন। হযরত বিশর হাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাঁর যামানার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাঁর এরূপ শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রাপ্তির অন্যতম উছীলাও ছিল আওলাদে রসূলগণের প্রতি তাযীম-তাকরীম এবং মুহব্বত। আল্লাহ পাক খুশি হয়ে ইলহামের মাধ্যমে তা তাঁকে জানিয়ে ছিলেন। সাইয়্যিদুত ত্বয়িফা হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর শ্রেষ্ঠত্ব এবং মারিফাত-মুহব্বত প্রাপ্তির পথে আসার পিছনে একই কারণ ছিল।  হযরত রবি বিন সুলাইমান রহমতুল্লাহি আলাইহি আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এতো নৈকট্য প্রাপ্তির একমাত্র কারণই ছিল আওলাদে রসূলগণের সম্মান ইজ্জত করা। তাঁদের খিদমত করার বদৌলতে আল্লাহ পাক তাঁর আকৃতির একজন ফেরেশ্তা তৈরি করেছেন যিনি কিয়ামত পর্যন্ত হজ্জ করতে থাকবেন। তার সমস্ত ছাওয়াব হযরত রবি বিন সুলাইমান রহমতুল্লাহি আলাইহি এর আমলনামায় জমা হবে। (সুবহানাল্লাহ) উল্লেখ্য যে, হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বংশধরগণকে বলা হয় সাইয়্যিদ তথা আওলাদে রসূল। অর্থাৎ রাসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বংশধর।  মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ-ফরজন্দকে অনুসরণ-অনুকরণ করার বিষয়টি আওলাদে রসূলগণের অনুকরণ করার মতই। কারণ আওলাদে রসূলগণের আগমণ যেরূপ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে তদ্রুপ আউলিয়ায়ে কিরামগণের আগমণের ধারাবাহিকতাও কিযামত অবধি অব্যাহত থাকবে। আউলিয়ায়ে কিরামের আওলাদ-ফরজন্দগণ হচ্ছেন দ্বীনের ধারক-বাহক। তবে সকল যুগে সকল সময় আওলাদে রসূলগণের সবার আমল আখলাক সীরত-সুরত একই রকম নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ সবাই পরহেযগার মুত্তাক্বী হবেন এমনটা নাও হতে পারে। এ দৃষ্টিকোন থেকে ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি ফতওয়া দিয়েছেন যে, আওলাদে রসূলগণ হচ্ছেন কুরআন শরীফের আয়াত শরীফের মত। কুরআন শরীফের এক প্রকার আয়াত শরীফ রয়েছে যা পাঠ করতে হয় এবং তার উপর আমলও করতে হয়। অপর এক প্রকার আয়াত শরীফ রয়েছে যেটা পাঠ করতে হয় কিন্তু আমল করতে হয় না। আওলাদে রসূলগণের হুকুমও অনুরূপ। তাঁদের মধ্যে যারা পরহেযগার মুত্তাক্বী তাঁদেরকে মুহব্বত করতে হবে,

তাযীম-তাকরীম করতে হবে এবং সাথে সাথে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ পাক না করুন যারা পরহিযগার মুত্তাক্বী নন তাদেরকে মুহব্বত করতে হবে। যথাযথভাবে সম্মান ইজ্জত করতে হবে কিন্তু অনুসরন অনুকরন করা যাবে না। যেমন ‘মানসুখ’ আয়াত শরীফ যার হুকুম বা আমল মানসূখ হয়ে গেছে। কিন্তু তিলাওয়াত, তাযীম-তাকরীম, ফযীলত ঠিকই বহাল রয়েছে। অর্থাৎ ‘মানসুখ’ আয়াত শরীফের হুকুম অনুসরণ করা যাবে না তবে অবশ্যই সেটাকে আয়াত শরীফ হিসেবে সম্মান করতে হবে। অনুরূপভাবে মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ ফরজন্দগণ। তাঁদের মধ্যে যাঁরা পরহিযগার হবেন, মুত্তাক্বী হবেন, তাদেরকে যথাযথ মুহব্বত করতে হবে। তাযীম-তাকরীম করতে হবে।  সাথে সাথে অনুসরন অনুকরণও করতে হবে। তবে তা স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার অবর্তমানে। কারণ মুর্শিদ ক্বিবলার বর্তমানে তিনিই একমাত্র অনুসরনীয় অনুকরনীয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ পাক না করুন যাদের আমল আখলাক শরীয়তের খিলাফ, অনুকুলে নয় সিলসিলার খিলাফ যাদের আমল আখলাক- তাদেরকে মুহব্বত করতে হবে, যথাযথ তা’যীম-তাকরীম করতে হবে। কিন্তু অনুসরণ অনুকরণ করা যাবে না।  তবে কখনও কোন সময় তাঁদের সম্মান-ইজ্জতের খিলাফ কোন কাজ অথবা আচার-আচরণ করা যাবে না। নিচের ওয়াকেয়াটির দ্বারা বিষয়টি পরিস্কার হবে।  হারামাইন শরীফের কাজী হযরত আবু হাসান বর্ণনা করেন যে, আমি উজীর আলী ইবনে ঈসা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মুখে শুনেছি, তিনি বলেন, বাগদাদ শরীফে থাকাকালীন আমি সাইয়্যিদজাদাগণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতাম। পরিচিত সবাইকে বার্ষিক ভাতা দিতাম এবং প্রতি রমাদ্বান শরীফে এক সাথে তা তাঁদের নিকট পৌঁছে দিতাম। সে সূত্রে ইমামুর রাসিখীন, সুলতানুল মুহাক্কিকীন, হযরত ইমাম মূসা কাজিম ইবনে জাফর রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আওলাদগণের মধ্যে একজন বৃদ্ধকেও আমি বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম দিতাম। একবার এক শীতের সকালে সেই সাইয়্যিদজাদাকে দেখলাম একটি রাস্তার পাশে মাতাল অবস্থায় পড়ে আছেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল কাদাযুক্ত। তিনি বার বার বমি করছিলেন। তাঁকে এমতাবস্থায় দেখতে পেয়ে মনে মনে ভাবলাম, এমন একটা ফাসিক শরাবীকে বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম দেয়া অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই আগামী রমাদ্বান শরীফ থেকে আর তাঁকে ভাতা দিব না। পরবর্তী রমাদ্বান শরীফে ভাতার অর্থ না পেয়ে তিনি আমাদের বাড়িতে হাজির হলেন। আমি তাঁকে বললাম, “আপনার শরাবের পয়সা জোগান দিতে পারবো না। গত শীতকালে একদিন আপনাকে আমি মাতাল অবস্থায় রাস্তার ধারে মাতলামী করতে দেখেছি।” এভাবে নানা কথা বলে লজ্জা দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিলাম। আরো বললাম, পরবর্তীতে আর কোন দিন আমার বাড়িতে আপনাকে যেন না দেখি। সে রাতেই আমি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখে সালাম আরজ করলাম কিন্তু তিনি সালামের কোন জাওয়াব দিলেন না। উপরন্ত স্বীয় মুখ মুবারক ফিরিয়ে নিলেন। আমি সবিনয়ে আরজ করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনার সম্মানিত আওলাদগণের খাদিম। আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি আমার আওলাদকে তোমার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। এটাই কি তোমার খিদমত। এতো তোমার স্পর্ধা যে, আমার আওলাদকে তাড়িয়ে দাও।” আমি সবিনয়ে নিবেদন করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সে তো আপনার শরীয়তের খিলাফ কাজ করে। আমি নিজ চোখে তাঁকে রাস্তায় মাতলামী করতে দেখেছি। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি তাকে যা দাও সেটা কি তার কাজের বিনিময়ে না আমার মুহব্বতে?” আমি সবিনয়ে বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! একমাত্র আপনার মুহব্বতেই দিতাম। তিনি বললেন, “তাহলে আমি তো শরাব পান করিনি। কতই না উত্তম হতো যদি তুমি আমার খাতিরে তাঁর সম্মান-ইজ্জত রক্ষা করতে।” আমি আরজ করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই সাইয়্যিদজাদাকে ডেকে আনলাম। সেদিন দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে তাঁর হাতে দশ হাজার দেরহামের একটি থলে তুলে দিলাম। পরিশেষে বিস্তারিত ঘটনা জানালাম। তা শুনে তিনি অনুশোচনা করলেন এবং বললেন, আমি তওবা করছি, কোনদিন আর নাফরমানী কাজ করবো না। মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ-ফরজন্দগণের ক্ষেত্রে সে আদেশই প্রযোজ্য। কারণ তাঁদের মুহব্বত-সম্মানের বিষয়টিও স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার সাথেই সংশ্লিষ্ট। উল্লেখ্য যে, দ্বীন ইসলামের প্রতিটি হুকুম আহকাম, বিধি- বিধান যেমন সুশৃঙ্খল ও সুস্পষ্ট তেমনি সীমারেখা পরিবেষ্টিত। তাতে ইফরাদ-তাফরীদ তথা সীমাহীনতার কোন স্থান নেই। সবাইকে সেই সীমা রেখার মধ্যে থাকতে হবে। আল্লাহ পাক বার বার সেকথাই বলেছেন। কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে এবং কঠোরভাবে তার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন,

ولا تعتدوا ان الله لا يحب المعتدين.

অর্থঃ “তোমরা সীমা অতিক্রম করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা মায়িদা-৮৭) আরো ইরশাদ হয়েছে,

تنك حدود الله فلاتعتدوها ومن يتعد حدود الله فاولئك هم الظلمون.

অর্থঃ “তা আল্লাহ পাক-এর দেয়া সীমারেখা। তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যারা আল্লাহ পাক-এর বেঁধে দেয়া সীমাকে লঙ্ঘন করবে তারা জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হবে।” (সূরা বাক্বারা-২২৯) তিনি আরো ইরশাদ করেন,

وتلك حدود الله ومن يتعد حدودالله فقد ظلم نفسه.

অর্থঃ “আর তা হচ্ছে আল্লাহ পাক-এর হদ বা সীমারেখা। কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর হদকে অতিক্রম করবে মূলতঃ সে নিজের প্রতি জুলুম করলো।” (সূরা ত্বলাক-১) আহলে বাইত এবং আওলাদে রসূলগণকে মুহব্বত করা, তাঁদেরকে যথাযথ তা’যীম তাকরীম করা ইসলামের মৌলিক বিধানাবলীর অন্তর্ভূক্ত। তা জুযই ঈমান তথা ঈমানের অঙ্গ বটে। তবে তারও যেমন একটা সুনির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। যা অতিক্রম করা জায়িয নেই। তেমনি নিজের মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ ফরজন্দদেরকে মুহব্বত করা, তা’যীম-তাকরীম করার হদ বা সীমা রেখা রয়েছে যা অতিক্রম করা জায়িয হবে না। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)