ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯৭)

সংখ্যা: ১৪৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

প্রসঙ্গঃ মুর্শিদ ক্বিবলা’র আওলাদ, ফরজন্দকে তাঁরই জাত হিসেবে তাঁর তুল্য সম্মান করবে। তাঁর আত্মীয়দেরকেও পরম ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মধ্যে আহলে বাইতগণের সম্মান মর্যাদা যেরুপ মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ-ফরজন্দের সম্মান-মর্যাদা সকল মুরীদের মধ্যে তেমনি জানতে হবে। কাজেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আহলে বাইতগণের যেরূপ সম্মান-ইজ্জত, তা’যীম-তাকরীম করেছেন মুরীদগণ স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ ফরজন্দদেরকে তদ্রুপ সম্মান-ইজ্জত, তা’যীম-তাকরীম করবে। খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফতকালে একবার তাঁর দরবার শরীফে একটা নালিশ আসলো। বাদী তাঁর আরজীতে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যিনি আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, তিনি তাকে “গোলামের ছেলে গোলাম” বলে সম্বোধন করেছেন। তাহলে সত্যি কি তিনি “গোলামের ছেলে গোলাম?” খলীফার দরবার শরীফে সুবিচার কামনা করছি। আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দেখলেন, বাদী অন্য কেউ নন বরং স্বীয় আদরের শাহজাদা হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি একটু চিন্তা করে বললেন, আপনার আরজী মুতাবিক বিচার করা হবে। কিন্তু তা হতে হবে লিখিত। মৌখিক কোন কথা গ্রহণযোগ্য হবেনা। আপনি যদি সেটা লিখিত দেখাতে পারেন তবে বিচার করা হবে। আর তা হবে যথাযথ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু লিখিত আনার জন্য হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট গেলেন এবং বললেন, আপনি যে  আমাকে “গোলামের ছেলে গোলাম” বলেছেন তা লিখে দিতে হবে। হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নির্ভিক চিত্তে তা লিখে দিলেন। লিখিত সেই কপি আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট সমর্পণ করা হলো। আমীরুল মু’মিনীন লিখিত কপিখানা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। আর বিচারের জন্য দিন-তারিখ ও সময় ধার্য্য করে বললেন, নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে বিচার হবে। বিষয়টি নিয়ে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মাঝে গভীর উদ্বেগ ভাব বিরাজ করছিলো। সবাই আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীনের বিচারের বিষয়টি চিন্তা করতে লাগলেন। তাঁর জ্বালালী স্বভাব সম্পর্কে কেউ বেখবর ছিলেন না। যার সম্পর্কে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لوكان بعدى نبى لكان عمر بن الخطاب رضى الله تعالى عنه.

অর্থাৎ- আমার পরে যদি কেউ নবী হতেন তবে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুই হতেন সেই ব্যক্তিত্ব।” এই হাদীছ শরীফও সবাই অবগত ছিলেন।

অপর দিকে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অন্য কেউ নন। তিনি আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একান্ত আদরের, স্নেহধন্য ব্যক্তিত্ব, জান্নাতের যুবকদের সাইয়্যিদ বা সর্দার। তাঁরই বিচার!

সেই বিচারের রায় কি হয় তা দেখার জন্য নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ খলীফার দরবার শরীফে উপস্থিত হলেন। সবাই উৎকক্তিত। নিথর, নিশ্চুপ খলীফার দরবার শরীফ। সুঁচ পরার শব্দও শুনা যাচ্ছে।

এমন সময় আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একটা পান্ডুলিপি বের করলেন। তাতে লিখা আছে, “সত্যি আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ‘গোলামের ছেলে গোলাম’ বলে সম্বোধন করেছি।” আমীরুল মু’মিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একান্ত আদব, তাযীম-তাকরীমের সাথে সবিনয়ে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি এটা লিখে দিয়েছেন? আর সত্যিই কি আপনি বলেছেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আপনাদের গোলামের ছেলে গোলাম। অর্থাৎ আমি আপনাদের গোলাম?

আর আমার শাহজাদা হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও আপনাদের গোলাম?” হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইতিবাচক জাওয়াব দিলেন। আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবীগণ! আল্লাহ পাক আমাকে অশেষ রহমত করেছেন, আমি সারাজীবন আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আহলে বাইতগণের খিদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমি ছিলাম তাঁদের একান্ত নিবেদিত খাদিম, গোলাম। কিন্তু তার এরূপ লিখিত কোন দলীল ছিলো না। আজ আমার সেই লিখিত দলীল সংগৃহিত হলো। আর যিনি লিখে দিয়েছেন এবং সে বিষয়টি সত্যায়িত করেছেন তিনি সাধারণ কোন লোক নন। তিনি হচ্ছেন আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, জান্নাতের যুবকদের সাইয়্যিদ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একান্ত আদরের, স্নেহধন্য হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ ওসীয়ত। আমি দুনিয়া হতে বিদায়ের পর আমাকে কাফন পড়াবেন। আর সেই কাফনের কাপড়ের নীচে, সিনা মুবারকের উপর এই কপিটি রেখে দাফন করবেন। আমি আল্লাহ পাককে দেখাবো, “আল্লাহ পাক! আমি আপনার হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আহলে বাইতগণের খাদিম ছিলাম। এটা আমার বিশেষ দলীল।” (সুবহানাল্লাহ)

আমীরুল মু’মিনীন, ফারুকে আ’যম উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বাইতগণের প্রতি যেরূপ সম্মান ইজ্জত দেখিয়েছিলেন। তাঁদের খিদমত করা, খাদিম হওয়াকে যেমন শ্রেষ্ঠ নিয়ামত মনে করেছিলেন তা সর্বকালে সর্বযুগে সকল উম্মত তথা মুরীদের জন্য অনুসরনীয়। ইবরত ও নছীহতের কারণ। আফজালুন্ নাস বা’দাল আম্বিয়া, খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আত্মীয় স্বজনদেরকে সম্মান ও ইজ্জত দেয়ার বিশেষ নজীর স্থাপন করেছিলেন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,

لان اصل قرابة النبى صلى الله عليه وسلم اولى من ان اصل قرابتى.

অর্থঃ “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা তাদের সাথে সদাচরণ করা আমার কাছে, আমার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সদাচরণ করা অপেক্ষা উত্তম।” (তারীখে ইসলাম আল্লামা সাইয়্যিদ আমীমুল ইহ্সান প্রণীত) মুর্শিদ ক্বিবলা তদ্বীয় আওলাদ ফরজন্দদেরকে কিরূপ মুহব্বত করেন, তাঁদের সাথে তাঁর নিসবত (সম্পর্ক) কিরূপ? তাঁর আওলাদ ফরজন্দদেরকে মুহব্বত করলে মুর্শিদ ক্বিবলার কি পরিমাণ সন্তুষ্টি ও নৈকট্য পাওয়া যেতে পারে তা জানতে হলে সর্ব প্রথম আহলে বাইত এবং আওলাদে রসূলগণ সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁদের মর্যাদা মরতবা সম্পর্কে জ্ঞান হাছিল করা আবশ্যক। তাহলে মুর্শিদ ক্বিবলার আওলাদ-ফরজন্দদের হক্ব আদায় করা তাদের যথাযথ তাযীম-তাকরীম করা সহজ ও সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।

আহলে বাইতগণের ফযীলতঃ

আহলে বাইতগণের ফাযায়িল-ফযীলত, বুযুর্গী-সম্মান কত তার সঠিক হিসেব নির্ণয় করা দুরূহ। কারণ কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت ويطهركم تطهيرا.

অর্থঃ- নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক আহলে বাইতকে সর্বপ্রকার অপবিত্রতা এবং অপছন্দনীয় কাজ হতে সম্পূর্ণরূপে পুত:পবিত্র রাখতে চান।” (সূরা আহযাব-৩৩)

আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফে ইরশাদ করেন,

ان تارك فيكم الثقلين اولهما كتب الله فيه الهدى والنور فخذوا بكتب الله واستمسكوابه فحث على كتب الله ورغب فيه ثم قال واهل بيتى اذكركم الله فى اهل بيتى اذكركم الله فى اهل بيتى.

অর্থঃ- “আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি হলো, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব। যার মধ্যে রয়েছে হিদায়েত ও নূর। তোমরা কিতাবুল্লাহ্কে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরো। তিনি কিতাবুল্লাহ্র প্রতি উৎসাহ  প্রদান করলেন। অতঃপর বললেন, দ্বিতীয়টি হলো, আমার আহলে বাইত বা (আওলাদগণ) বংশধর। তাঁদের ব্যাপারে তোমাদেরকে আমি সতর্ক করছি, তাঁদের ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করছি।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ/৫৬৮) যে আহলে বাইতকে স্বয়ং আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ পাকই সর্বপ্রকার অকল্যাণ, অপছন্দনীয় কার্যকলাপ হতে পুত:পবিত্র রাখতে চান। আল্লাহ পাকই যাদের তরবিয়ত দাতা তাঁদের ছানা-সীফত মানুষ কি করবে? আহলে বাইত এবং আওলাদে রসূলগণের প্রতি মুহব্বত রাখা জুয্-ই-ঈমান বা ঈমানের অঙ্গ।  তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া, তাঁদের সম্মান-মর্যাদার খিলাফ কাজ করা, কথা বলা সবটাই কুফরী। (চলবে)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)