ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯৫)

সংখ্যা: ১৪৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

 প্রসঙ্গ: “মুর্শিদ ক্বিবলার সাক্ষাতকালে কদমবুছী করবে। বিদায় নেয়ার সময়ও কদমবুছী করে বিদায় নিবে।” মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ককে গভীর ও শক্তিশালী করা, মুর্শিদ ক্বিবলার ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ ও নেক দৃষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম কদমবুছী। এটা গভীর শ্রদ্ধা, আদব, মুহব্বত এবং আনুগত্যের বহি:প্রকাশও বটে। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কদম মুবারকে সরাসরি চুম্বন দিয়ে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, মুহব্বত, তা’যীম এবং আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করেছেন। মুরীদও তাঁদের অনুসরণে একইভাবে স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, পরম মুহব্বত এবং আনুগত্য প্রকাশের সুযোগ পেয়ে থাকে।  কাজেই কদমবুছীকে মুহব্বত ও আনুগত্যের প্রতীক বলা যেতে পারে। এটা কামিয়াবী এবং বিজয়ের সোপানও বটে। কারণ, কদমবুছী করা সেই ব্যক্তির পক্ষে সহজ ও সম্ভব যে স্বীয় মুরশিদ ক্বিবলাকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে। আর নিজেকে ভাবে সর্বনিকৃষ্ট, হীন ও তুচ্ছ। যা ইল্মে তাছাউফের বুনিয়াদী শিক্ষা। এরূপ মনোভাবই তাকে আল্লাহ পাক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্যভাজনে পরিণত করে। হাদীছ শরীফে আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

من توضع لله رفعه الله.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর জন্য বিনয়ী হয় আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।” (ইহ্য়াউ উলুমিদ্ দ্বীন, কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত) পক্ষান্তরে যারা অহংকারী, যাদের অন্তরে রয়েছে আত্মরম্ভীতা তারা কখনও কদমবুছীর ফযীলত, বরকত লাভ করতে পারে না। অন্তরে লালিত অহংকারই তাকে কদমবুছী থেকে বিরত রাখে। অহংকারী ব্যক্তি কখনও হাক্বীক্বীভাবে কদমবুছী করেনা। যদি লোক লজ্জার ভয়ে কিংবা অবস্থার চাপে করে তা হয় একান্ত অন্তঃসারশূন্য। খুব কমসংখ্যক লোক নিজকে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ মনে করতে পারে। ‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও আগে’- এই নীতি বাক্যের উপর আমল করতে পারে। কদমবুছীকে সুসম্পর্কের সেতুবন্ধনও বলা হয়। মুর্শিদ ক্বিবলা-মুরীদে, উস্তাদ-ছাত্রে, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, বড়-ছোটদের মাঝে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং মুহব্বতের আধিক্যতা পয়দা করতে কদমবুছী বিরাট ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। কদমবুছীর সময় অনিচ্ছা সত্ত্বে যে মাথা ঝুঁকে যায় তা সিজদার অন্তর্ভুক্ত নয় সিজদা নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত। ফুক্বাহায়ে কিরামগণ বলেন, ‘যদি সিজদার নিয়তে মাথা ঝুঁকানো হয় তবে তা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়িয। আর যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে কদমবুছী করার সময় যে মাথা কিছুটা ঝুঁকে যায় তা সিজদার অন্তর্ভুক্ত নয়। সেটা কদমবুছীর মধ্যেই গণ্য। তবে কদমবুছী করার সময় মাথা সোজা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কদমবুছী করার সময় মাথা ঝুকানো সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ করা হয়,

উর্দূ কম্পোজ করতে হবে

অর্থঃ॥ “কদমবুছীর সময় মাথা ঝুঁকানো মূলতঃ উদ্দেশ্য নয়। কারো সম্মানার্থে ইচ্ছাকৃত সিজদার ন্যায় মাথা ঝুঁকানো নাজায়িয। তাই, সিজদার নিয়ত ব্যতীত মাথা ঝুঁকানো নিষেধ নয় এবং স্থান বিশেষে এর থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। যেমন কোন বস্তু উঠাবার সময়, রাখার সময়, দেখার সময় ইত্যাদি কারণে স্থান বিশেষে মাথা নিচু করতে হয়। অথচ উপরোক্ত কারণে মাথা ঝুঁকানোকে কেউ নাজায়িয বলেন না, কারণ সিজদার নিয়ত করে তা করা হয় না।” (রদ্দুল মুহতার, মুহীত, যাহিদী, শেফালিকাজি আয়াজ, মকতুবাতে ইমাম রব্বানী, আহ্সানুল ফতওয়া, জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্) তা’যীমি সিজদা ও কদমবুছী এক নয়ঃ তা’যীমি সিজদা এবং কদমবুছী একতো নয়ই বরং ব্যবধানে আসমান-যমীন সমপার্থক্য। তা’যীমি সিজদা তথা সম্মান প্রদর্শনার্থে কাউকে সিজদা করা প্রকাশ্য হারাম ও র্শিকের অন্তর্ভুক্ত। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

لوكنت امر احدا ان يسجد لاجد لامرت المرأة ان تسجد لزوجها.

অর্থঃ- “আমি যদি মানুষ মানুষকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম তবে স্ত্রীদেরকে আদেশ করতাম তারা যেন তাদের স্বামীকে সিজদা করে।” (আহমদ, মিশকাত শরীফ) এই হাদীছ শরীফ, পূর্বের সমস্ত তা’যীমি সিজদাকে রহিত বা বাাতিল করেছে। একজন মানুষ যত মর্যাদা-মর্তবা সম্পন্ন হোক না কেন তাকে সিজদা করা জায়িয নেই। আল্লাহ পাকই একমাত্র সিজদার উপযুক্ত অন্য কেউ নয়। কাজেই যারা সিজদা করে আর যারা সিজদা নেয় উভয়ই কাট্টা কাফির এবং মুশরিক। আল্লাহ পাক বলেন,

لاتشرك بالله ان الشرك لظلم عظيم.

অর্থঃ- “আল্লাহ পাক-এর সাথে (অংশীদার স্থাপন) শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ্।” (সূরা লুকমান-১৩) আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, নূরে মুজাস্সাম, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ولا تشرك بالله شيا وان قتلت اوحركت.

অর্থঃ- “যদি তোমাকে হত্যা করা হয় কিংবা আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তথাপি আল্লাহ পাক-এর সাথে কোন ব্যাপারে কাউকে শরীক করবে না।” পক্ষান্তরে কদমবুছী সুন্নতে ছাহাবা। সেই সুন্নতের মধ্যে আছে আল্লাহ পাক ও তাঁর প্রিয়তম হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি-এর পরম সন্তুষ্টি, নৈকট্য। কাজেই যারা কদমবুছীকে নাজায়িয ও হারাম বলবে, শিরক বলে ফতওয়া দিবে তারাও শরীয়তের বিধানকে অস্বীকার, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হালালকে হারাম বলার কারণে কাট্টা কাফিরের অন্তর্ভুক্ত। কদমবুছী করার তরীক্বা বা পদ্ধতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সময় কদমবুছী করার নিয়ম ছিল, সরাসরি মুখ দিয়ে পায়ে বুছা (চুম্বন) দেয়া। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এ পদ্ধতিতেই কদমবুছী করতেন। তবে পরবর্তী আলিমগণ ইজতিহাদ করতঃ ফতওয়া দেন যে, সরাসরি পায়ে বুছা না দিয়ে হাত দিয়ে পা স্পর্শ করে উক্ত হাতে বুছা দেবে। তবে কেউ যদি উঁচু জায়গায় থাকে এবং কদমবুছী করার সময় মাথা নিচু না হয়, তবে সরাসরি কদমে বুছা (চুম্বন) দেয়া যাবে। ফক্বীহগণের উক্তরূপে কদমবুছীর ফতওয়া দেয়ার কারণ হলো, তাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বে না এবং মাথা রুকু সিজদার ন্যায় সামনের দিকে ঝুকবে না। তাই কেউ যদি উল্লেখিত ব্যক্তিদের পা নিজের হাতে স্পর্শ করে, উক্ত হাতে বুছা (চুম্বন) দেয়, তবে সে কদমবুছীর পূর্ণ ফযীলত অর্জন করতে পারবে এবং তার কদমবুছীর সুন্নতও আদায় হয়ে যাবে।  যেমন কিতাবে লিখা হয়, কেউ যদি মক্কা শরীফে গিয়ে সরাসরি মুখ দিয়ে হজরে আসওয়াদ বুছা (চুম্বন) দিতে না পারে, তবে যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাতে বুছা (চুম্বন) দেয় অথবা দূর হতে হাতের ইশারায় বুছা দেয় অথবা লাঠি দ্বারা স্পর্শ করে লাঠিতে বুছা দিলেও সে হজরে আসওয়াদ বুছা দেওয়ার পূর্ণ ফযীলত অর্জন করতে পারবে। তিনবার চুমু দেয়া উত্তম কদমবুছী (পদচুম্বন) করার সময় একবার করলেও সুন্নত আদায় হবে। তবে তিনবার দেয়া অতি উত্তম। বেজোড় সংখ্যা সুন্নত। যদিও ‘এক’ সংখ্যাটিও বেজোড় কিন্তু ‘তিন’ সংখ্যাটি অতি উত্তম। কারণ, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছোট বেজোড় থেকে পানাহ চেয়েছেন। সেহেতু তিনবার করা অতি উত্তম এবং অধিক শ্রেষ্ঠতা। তবে সবক্ষেত্রে হক্কুল ইবাদের প্রতি লক্ষা রাখা বাঞ্ছনীয়। কারণ, অন্যকে কষ্ট দিয়ে কিংবা কারো হক্ব নষ্ট করে আমল করাতে অনেক সময় উপকারের চেয়ে অপকারই বেশী হয়ে থাকে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সম্মানিত মহান মুজাদ্দিদ-এর উছীলায় কদমবুছীর পরিপূর্ণ বরকত নছীব করুন। (আমীন)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)