৪৬। পীর ছাহেবের দোষত্রুটি কখনও অনুসন্ধান করবে না। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বদবখ্ত ও নিকৃষ্ট ঐ ব্যক্তি যে ওলী আল্লাহগণের ছিদ্রান্বেষণ করে। (মাকতুবাত শরীফ) আল্লাহ পাক বলেছেন, ولا تجسسوا
অর্থঃ- “তোমরা দোষত্রুটি অনুসন্ধান করোনা।” (সূরা হুজুরাত-১২) আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ولا تحسسوا ولاتجسسوا.
অর্থঃ- “তোমরা দোষত্রুটির কথা জানার চেষ্টা করোনা, পরছিদ্রান্বেষী হয়োনা।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ) তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি অন্যের দোষের প্রতি লক্ষ্য না রেখে নিজের দোষ সংশোধনে রত থাকে সেই বুদ্ধিমান।” কাজেই সাধারণভাবে অন্যের দোষত্রুটি, তালাশ করা জায়িয নেই, হারাম। সেক্ষেত্রে স্বীয় পীর ছাহেবের দোষত্রুটি অন্বেষণ করা কিরূপ কাট্টা নাজায়িয তা ফিকিরযোগ্য। মূলত: যে ব্যক্তি স্বীয় পীর ছাহেবের দোষত্রুটি অনুসন্ধান করে কিংবা প্রকাশ করে সে ব্যক্তি লা’নত প্রাপ্ত, সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব এবং সবচেয়ে বড় জালিম। যেরূপভাবে যারা আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যারোপ করে তারা সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে অধিক জালিম। আল্লাহ পাক বলেন,
ومن اظلم ممن افترى على الله الكذب وهو يدعى الى الاسلام والله لايهدى القوم الظلمين.
অর্থঃ- “ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক জালিম কে হতে পারে, যে আল্লাহ পাক সম্পর্কে মিথ্যারোপ করে? অথচ তিনি ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। আল্লাহ পাক এরূপ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়েত দান করেন না।” (সূরা ছফ-৭) পীর ছাহেব আল্লাহ পাক-এর ও তাঁর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুণে গুণান্বিত। তিনিও সব সময় মুসলিম (জাতি) উম্মাহ্র হিদায়েতের পথে আহ্বান কারী। স্বীয় মুরীদকে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্যভাজন ও প্রিয়প্রাত্র করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রমকারী। কৃষক যেমন শক্ত কঠিন যমীনকে ফসল উৎপন্নের উপযোগী করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করেন পীর ছাহেবও তাঁর চেয়ে শত সহস্রগণ বেশী পরিশ্রম করে একজন মুরীদকে তার মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে যারা পীর ছাহেবের ছিদ্রান্বেষণ করে তারা লা’নতের উপযুক্ত ছাড়া কি হতে পারে? কাজেই এরূপ মুরীদের সাথে কোনরূপ সম্পর্ক রাখা কোন মুরীদেরই উচিত নয়। অন্যথায় সে মুরীদও সে লা’নতের অন্তর্ভূক্ত হবে। এরূপ লা’নতগ্রস্ত ব্যক্তিকে শয়তানও ভয় পায়। উল্লেখ্য যে, বাইয়াত হওয়ার পূর্বে পীর ছাহেব হক্ব কি-না তা যাচাই বাছাই করতে হবে। এরূপ যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দোষ নয়। কারণ বাইয়াত হওয়ার পূর্বে পীর ছাহেবের কামালিয়ত বা হক্ব নাহক্বের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ফরজ। কিন্তু বাইয়াত হওয়ার পর কোনরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জায়িয নেই। নিজের জান-মাল, ইল্ম-আমল, ব্যক্তিত্ব-অস্তিত্ব সবই তাঁর হাতে অর্পণ করতে হবে। মুরীদ হবে রিক্ত হস্ত মুর্দার মতো। আর পীর ছাহেবকে মনে করতে হবে, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরেই তাঁর স্থান। তাঁর মাঝে দ্বিতীয় কেউ নেই। সুলতানুল আউলিয়া, মাহবুবে ইলাহী হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পীর ছাহেব শাইখুল আলম, সুলতানুল মুহাক্কিকীন, মাখদুমে আলম হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট “আওয়ারেফুল মায়ারিফ” কিতাব পড়তে ছিলেন। হযরত বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বয়স মুবারক বৃদ্ধি এবং কিতাবের নুছখাটি পুরনো হওয়ার কারণে একদিন একটু থেমে থেমে পড়তে ছিলেন। তা দেখে সুলতানুল আউলিয়া, মাহবুবে এলাহী হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পীর ছাহেবের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন কল্পে বললেন, “আমি মুনতাজাবুদ্দীন মুতাওয়াক্কিল-এর নিকট একটি ভাল নুসখার কিতাব দেখেছি।” তাতে শাইখুল আলম হযরত বাবা ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর খিদমত থেকে মাহবুবে এলাহী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বের করে দিলেন। হযরত মাহবুবে এলাহী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি মনে মনে চিন্তা করলাম যে, শাইখুল আলম বাবা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বলি, আমি কি বেয়াদবী করলাম? আমিতো আপনার সুবিধার কথাই বললাম। পরক্ষণে চিন্তা করলাম, আমিতো পীর ছাহেবের রোগ সারাতে আসিনি। আমি এসেছি নিজের রোগ সারাতে। একথা চিন্তা করেই তাঁকে কিছু বলা থেকে বিরত রইলাম।” (তাযকিরাতুল আউলিয়া) মূলতঃ এটাই হচ্ছে হাক্বীক্বী অবস্থা যে, মূরীদ নিজেরই রোগব্যাধি দুর করণার্থে পীর ছাহেবের নিকট বাইয়াত হয়। কাজেই নিজের আভ্যন্তরীণ রোগব্যাধি কতটুকু নির্মূল হলো তারই প্রতি সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। একটা বিষয় সব সময় মনে রাখা উচিত, পীর ছাহেব সাধারণ লোকের মত নন। তিনি আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মনোনীত, কবুলকৃত। ইলহাম-ইল্কা ব্যতীত তিনি কোন কিছুই করেন না, বলেন না। পক্ষান্তরে তিনি যা কিছুই করেন অথবা বলেন, অর্থাৎ তাঁর প্রতিটি বিষয়ই আল্লাহ পাক কবুল করে থাকেন। আর একথা অনিবার্য রূপে সত্য যে, মুরীদ তাঁর যে বিষয়ে অনুসরণ-অনুকরণ করবে, আদেশ-নিষেধ পালন করবে তারও আমলগুলো একইভাবে কবুল হবে। (সুবহানাল্লাহ) যারা নিজের পীর ছাহেবের ছিদ্রান্বেষণ কাজে ব্যাপৃত তারা মূলতঃ মুরীদ নয়; মুরীদ নামের কলঙ্ক। তারা কখনও পীর ছাহেবের ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ পায়নি এবং কখনও পাবে না। ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ পাওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে পীর ছাহেবের প্রতি হুসনে জন (সুধারণা) থাকা। সেক্ষেত্র যার হুসনে জন (সুধারণা) যত বেশী হবে সে পীর ছাহেবের তত বেশী খাছ ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ লাভ করবে। মনে রাখতে হবে, যারা পীর ছাহেবের খাছ ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্ত তাদের অন্তরে এসব বিষয়ের কোন চিন্তাও উদয় হয় না। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্রতম ছোহবতে থেকে মুনাফিক সর্দার উবাই ইবনে সুলূল যেন তাঁর ছিদ্রান্বেষণে সব সময় লিপ্ত ছিল। তারাই ধারাবাহিকতায় মুনাফিক সর্দার উবাই ইবনে সুলূলের উত্তরসূরীরা আউলিয়ায়ে কিরামের ছোহবতে থেকে উক্ত আউলিয়ায়ে কিরামের দোষত্রুটি তালাশ করতে থাকে। (নাউযুবিল্লাহ) মূলত: তারা উক্ত আউলিয়ায়ে কিরামকে একটি সুন্নত আদায়ের সহায়তা করে এবং নিজেদের ধ্বংসকে তরান্বিত করার প্রয়াস পায়। প্রায় সব দরবার শরীফে এদের অস্তিত্ব দেখা যায়। খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, “যাত্রাবাড়ী দরবার শরীফে আমি এরূপ অনেক লোককে দেখেছি তারা নিজের পীর ছাহেবের দোষত্রুটি অন্বেষণ করে এবং প্রকাশ করে। সামান্য কিছু হলে তারা বিরাট করে তা প্রকাশ করতো। ‘পীর ছাহেবের ছেলে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে কেন?’ ‘অমুক কাজটি কি জায়িয হলো?’ ইত্যাদি অমূলক আলোচনা সমালোচনা করতো। অনেক নামি-দামি, ছূফী-দরবেশও একাজে জড়িত ছিলো। কিন্তু আমি সব সময় এ সব লোকদের সংসর্গ পরিহার করতাম। আল্লাহ পাক-এর রহমত! আমার অন্তরে পীর ছাহেব ক্বিবলা সম্পর্কে কখনও কোন প্রশ্নের সঞ্চার হয়নি, এখনও হচ্ছে না আশা করি ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও উদয় হবে না।” (সুবহানাল্লাহ) তিনি আরো বলেন, “আমি দেখতাম, পীর ছাহেব ক্বিবলা যাকে খারাপ জানেন এবং তার খারাপের কথা বলে সমালোচনা করেন, তাদের সাথে এদের সম্পর্ক। তারা তাদেরকে ভাল জানে। তাদের প্রশংসা করে। এরা প্রকৃতপক্ষে পীর ছাহেবের মুরীদ নয় এরা তাঁর বিরোধিতাকারী।” আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ পাক বলেছেন,
من عادى لى وليا فقد اذنته بالحرب.
অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আমার ওলীর বিরোধিতা করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। অর্থাৎ তার ধ্বংস অনিবার্য।” (বুখারী শরীফ) তার বাস্তবিক সেটাই হয়েছে এরূপ ব্যক্তিদের কেউই কামিয়াবী লাভ করতে পারেনি।
মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ কিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী আরো বলেন, “এই একটি মাত্র কারণে অনেক হক্ পীর ছাহেবের সিলসিলাও ধ্বংস হয়েছে। পীর ছাহেব থাকে যেরূপ জানেন যে মুরীদ তাকে সেরূপ জানবে না সে মুরীদ কস্মিনকালেও কামিয়াবী লাভকরতে পারবে না। কারণ, পরোক্ষভাবে এটা বিরোধিতার অন্তর্ভুক্ত। “
উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ বলে থাকে যে, “পীর ছাহেব ওলী আল্লাহ্ তিনি অপরকে যা-তা বলতে পারেন কিন্তু আমি তো আর ওলী আল্লাহ নই। কাজেই আমার জন্য তা জায়িয নেই। আমাকে সবার প্রতি সুধারণা রাখতে হবে।”
মূলত; এটাও শয়তানের এক প্রকার ধোঁকা। এরূপ মনোভাব প্রকারান্তরে পীর ছাহেবের ছিদ্রান্বেষণের পথকে
প্রসারিত করে। ফয়েজ- তাওয়াজ্জুহর রাস্তাকে বন্ধ করে দেয়। আর পীর ছাহেবের ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ ব্যতীত সব পরিশ্রম বৃথা। কারণ হজ্ব এবং হজ্বের সাথে কখনও দ্বন্দ্ব নেই। হক্কও নাহকের মাঝেই দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে। হক্ নাহক চেনার যোগ্যতা মুরীদ কোথায় পাবে? মুরীদ পীর ছাহেবের অধীন । কাজেই আলাদা কোন চিন্তা করা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “প্রেমিক যে প্রিয়ার জন্য পাগল। তার বিরোধিতা বা ছিদ্রান্বেষণের ক্ষমতা কোথায়? স্বীয় প্রিয়ার শত্রুদের সাথে কোনক্রমেই সে বন্ধুত্ব করতে পারে না। ‘দুই বিপরীত বস্তু একত্র হওয়া অসম্ভব বলা হয়ে থাকে। কাজেই তাদের একটিকে মুহব্বত করলে অপরটির সাথে অবশ্যই শত্রুতা ঘটাবে।” (মাকতুবাত শরীফ)
কাজেই একথা অনিবার্যরূপে সত্য যে, যারা নিজের পীর ছাহেবের দোষত্রুটি অন্বেষণ করবে কিংবা প্রকাশ করবে তাদের হালাক্বী বা ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
আল্লাহ পাক যামানার মহান মুজাদ্দিদের উছীলায় আমাদের সবাইকে এ নিকৃষ্টতম কাজ থেকে হিফাযত করুন। (আমীন)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)