ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯২)

সংখ্যা: ১৪৪তম সংখ্যা | বিভাগ:

প্রসঙ্গ: আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত-মুহব্বত হাছিলের পথে যদি কখনও কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় কিংবা কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয় তখন স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে তা অবহিত করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদি তিনি ক্ষমাপ্রাপ্তির সুসংবাদ দান করেন তাহলে শুকরিয়া আদায় করবে।

উল্লেখ্য যে, পীর ছাহেব হচ্ছেন আল্লাহ পাক-এর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কায়িম-মাক্বাম তথা স্থলাভিষিক্ত। কাজেই মুরিদ মারিফত-মুহব্বত হাছিলের পথে প্রতিবন্ধকতার শিকার হলে কিংবা তার দ্বারা কোন পাপ কাজ সংঘটিত হলে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে তা অবহিত করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেক্ষেত্রে পীর ছাহেব-এর ক্ষমাই হবে আল্লাহ পাক-এর ক্ষমা। (সুবহানাল্লাহ)। এটাই আউলিয়ায়ে কিরামগণের (তর্জ-তরীক্বা) রীতি-নীতি। ইল্মে তাসাউফের শিক্ষা এমন কি আউলিয়ায়ে কিরামগণ স্বীয় পীর ছাহেব দুনিয়া হতে বিদায় নেয়ার পরেও যদি এরূপ কোন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতেন তখন তাঁর মাযার শরীফের নিকটবর্তী হয়ে সবিনয়ে নিবেদন করতেন। ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ পেলে কিংবা ক্ষমা পাওয়ার কোন আলামত (প্রকাশ) জাহির হলে চলে আসতেন। সাথে সাথে সে প্রতিকূল অবস্থাও দূর হত।

প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, শাইখুল আউলিয়া, মাহবুবে ইলাহী হযরত আবু সাঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পীর ছাহেব শাইখুল আলম, ইমামে রব্বানী, সুলতানুল আউলিয়া হযরত আবুল ফজল হাসান সারাখ্সী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মর্যাদা ও বুুযুর্গী সম্পর্কে বলেন যে, কোন সময় আমার অন্তরে ক্বাব্য-এর অবস্থার সৃষ্টি হলে অর্থাৎ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরফ হতে আমার দিলে ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ আসা বন্ধ হওয়ার অবস্থা পয়দা হলে আমি মুরীদগণকে বলতাম, ঘোড়া সাজাও আমি হজ্জে যাব। ঘোড়া সাজানো হলে তাতে চড়ে আমি আমার পীর ছাহেব শাইখুল আলম, সুলতানুল আউলিয়া হযরত আবুল ফজল হাসান সারাখ্সী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযার শরীফে আসতাম। ছওয়াব রেসানী করে তাঁর নিকট সবিনয়ে নিবেদন পেশ করতাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ক্বাব্য তথা অন্তরের সেই সঙ্কুচিত ও রূদ্ধভাব দূর হয়ে আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফত-মুহব্বতের নূর অন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করত। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)।

উল্লেখ্য যে, মুহলিকাত (ধ্বংসাত্মক বদ খাছলত) গুলো দূর করতঃ মুনজিয়াত (মুক্তিদানকারী নেক খাছলত) গুলো হাছিল করা মুরীদের আসল কাজ।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন.

قد افلح من زكها وقد خاب من دسها.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম হয়েছে আর যে নিজেকে কলুষিত করেছে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” (সূরা শামস্- ৯, ১০)

বদ খাছলতগুলো পূর্ণরূপে বিনাশ না করতে পারলে মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়।

কামিল পীর ছাহেবের তত্ত্বাবধানে থেকে যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাতের দ্বারা বদ খাছলতগুলো পূর্ণরূপে বিনাশের কোশেশ (চেষ্টা) করা আবশ্যক বা ফরজের অন্তর্ভুক্ত। এই ফরজ আদায়ে ত্রুটি হলে কিংবা পরিত্যাগ করলে মারিফত-মুহব্বত হাছিলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য।

উল্লেখ্য, ইবলিস ছয় লক্ষ বছর পর গোমরাহ হলো। বনী ইসরাইলের বড় আলিম আবুল হারেছা সুদীর্ঘ দিন পর লা’নত গ্রস্ত হয়ে সাপে পরিণত হলো। বনী ইসরাইলের আরেকজন আবেদ বাল’আম বিন বাউরা তিনশত বছর সাধনালব্ধ নিয়ামত হতে বঞ্চিত হলো। লা’নতগ্রস্ত হলো বদ খাছলতগুলো পূর্ণরূপে বিনাশ না হওয়ার কারণেই।

বর্তমান যামানার মুফতী, মুহাদ্দিস, ফকীহ, সূফী, আমীর, পীর-দরবেশ, শাইখুল হাদীছ, শাইখুত তাফসীর, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বক্তা, খতীব এবং মশহুর ছিলছিলার গদ্দীনশিন হাদী ব্যক্তিবর্গের নাজায়িয হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া এবং গোমরাহ হওয়ার পিছনে একই কারণ বিদ্যমান। এই গোমরাহী থেকে মুক্ত থাকার জন্যই কামিল পীর ছাহেবের কাছে বাইয়াত হওয়াকে ফরজ বলে ফতওয়া দেয়া হয়েছে। কারণ মানব স্বভাবে এমন কতকগুলো ধ্বংসাত্মক বদ খাছলত রয়েছে যা শুধুমাত্র নিজের চেষ্টা কোশেশের দ্বারা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তা নির্মূল করার জন্য কামিল পীর ছাহেবের নির্দেশিত পন্থায় কঠোর রিয়াজত তথা চেষ্টা কোশেশের সাথে সাথে পীর ছাহেবের ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহর প্রয়োজন। পীর ছাহেবের ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ পেলে তা হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

কাজেই সেই সকল বদ খাছলতগুলো স্বীয় পীর ছাহেবকে অবহিত করা মুরীদের কর্তব্য। যদিও কামিল পীর ছাহেবের নিকট মুরীদের কোন বিষয়ই গোপন থাকে না তথাপি তা পীর ছাহেবকে অবহিত করাই শ্রেয় এবং মুক্তির সহজ পথ।

হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,

ان رجلا جاء الى النبى صلى الله عليه وسلم وقال انى اريد ان اومن بك الا انى احب الزنا والخمر والسرقة والكذب والناس يقولون انك تحرم هذه الاشياء ولا طاقة لى على تركها باسرها فان قنعت منى بترك واحد منها امنت بك.

অর্থঃ- “এক ব্যক্তি একদিন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে এসে বললেন, আমি আপনার প্রতি ঈমান আনতে চাই কিন্তু ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়া, শরাব পান করা, চুরি করা এবং মিথ্যা বলা আমার প্রিয় অভ্যাস। আর লোকেরা বলে থাকে, আপনি নাকি এগুলোকে হারাম বা নিষিদ্ধ বলে থাকেন। অতি সহসাই এগুলোকে পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এসব থেকে আমি একটি পরিত্যাগ করাতে যদি আপনি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে আমি আপনার প্রতি ঈমান আনতে পারি।” সেই ব্যক্তির কথা শুনে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

اترك الكذب فقبل ذلك ثم اسلم فلما خرج من عند النبى صلى الله عليه وسلم عرضوا عليه الخمر فقال ان شربت الخمر فسألنى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن شربها وكذبت فقد نقضت العهد وان صدقت اقام الحد على فتركها ثم عرضوا عليه الزنا فجاء ذلك الخاطر فتركه وكذا فى السرقة فعاد الى رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال ما احسن ما قلت لما منعتنى من الكذب انسدت ابواب المعاصى على وتاب عن الكل.

অর্থঃ- “তুমি মিথ্যা বলা পরিহার কর।’ সে ব্যক্তি তাতে সম্মত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর যখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বিদায় হলো তখন তার চিরাচরিত অভ্যাস মত শরাব পানের প্রতি মনোনিবেশ করলো। পরক্ষণে চিন্তা করলো যদি আমি শরাব পান করি আর আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন যদি মিথ্যা বলি তাহলে ওয়াদার খিলাফ হবে। আর যদি সত্য বলি তাহলে আমার উপর শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। এ চিন্তা করে তা পরিত্যাগ করলো। অতঃপর ব্যাভিচারের প্রতি মনোযোগ দিলো তখনও অন্তরে অনুরূপ চিন্তা উদয় হলো। অত:পর তা পরিত্যাগ করলো। এমনিভাবে চুরির বিষয়টিও পরিত্যাগ করলো। তারপর একদিন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললো, আপনি আমাকে যা বলেছেন তা কতই না উত্তম। আপনি যখন আমাকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করলেন তখন আমার সকল পাপের রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেলো। পরে সে সব বিষয় থেকে তওবা করলো।” (তাফসীরে কবীর, লুবাব ১০:২৩৫)

মুরীদের জন্য পীর ছাহেব হচ্ছেন অনুরূপ ব্যবস্থাদাতা। মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেবকে নিজের বদ খাছলতগুলো অবহিত করলে পীর ছাহেব সে অনুপাতে ছবক দিবেন এবং তা হতে মুক্তি পাওয়ার দিক নির্দেশনা তথা তালীম-তরবিয়ত দান করবেন। পক্ষান্তরে যারা তা গোপন রাখে অথবা বিনাশ সাধনের জন্য কোশেশ করে না তারা সেরূপ তালীম-তরবিয়ত লাভ করতে পারে না। তবে পীর ছাহেব-এর তালীম-তরবিয়ত হতে কেউই মাহরূম তথা বঞ্চিতও হয় না।

কাজেই মুরীদের উচিত সূলুকের পথে প্রতিবন্ধকতা নিজের অবস্থা এবং নিকৃষ্টতম বদ খাছলতগুলো স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে অবহিত করা। আর তিনি যে দিক নির্দেশনা বা ছবক দান করেন যথাযথ ভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের কোশেশ করা। আল্লাহ পাক তাওফীক দাতা।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯৩)