ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯১)

সংখ্যা: ১৪৩তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

দরবার শরীফে অবস্থানের আদব

৪৫। আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মা’রিফত-মুহব্বত হাছিলের পথে যদি কখনও কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় কিংবা কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয় তখন স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলাকে তা অবহিত করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদি তিনি ক্ষমাপ্রাপ্তির সুসংবাদ দান করেন তাহলে শুকরিয়া আদায় করবে। একদিন আফযালুল আউলিয়া, ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় মুরীদ মোল্লা দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহিকে উপদেশ দান করতঃ বললেন, পার্থিব নানারূপ চিন্তা-ভাবনা যেন ওযীফা তথা যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দিগী, এবং আউলিয়ায়ে কিরামগণের ত্বরীকার উপর ইস্তিকামত (অটল) থাকার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। ঘটনাক্রমে যদি অন্তঃকরণে কোন তমসার সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবার শরীফে একান্ত আযীযী-ইনকেসারীর (অনুনয়-বিনয়) সাথে তওবা-ইস্তিগফার করবে এবং স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার স্মরণাপন্ন হবে। এটাই তার একমাত্র চিকিৎসা। কারণ সমস্ত নিয়ামতপ্রাপ্তির মাধ্যম হচ্ছেন পীর ছাহেব। আর তাঁরই নিকট রয়েছে সমস্ত নিয়ামত রাজী। কাজেই পীর ছাহেব ক্বিবলার সন্তুষ্টিকেই আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির অবলম্বন তথা একমাত্র পাথেয় মনে করবে। ইহাই কামিয়াবী ও নাজাতের পথ।  তিনি অন্যত্র বলেন, মনে রাখবে, এ পথের উৎকৃষ্ট আমল হচ্ছে, পীর ছাহেব ক্বিবলার প্রতি খালিছ মুহব্বত। পীর ছাহেব ক্বিবলার প্রতি যদি খাঁটি মুহব্বত থাকে আর আত্মাধিক অবস্থার ক্ষেত্রে উপস্থিত কোন তরক্কী বা উন্নতি যদি অনুভূত নাও হয় তাতেও কোন চিন্তার কারণ নেই। কেননা যদি ইখলাছ এবং খালিছ মুহব্বত কায়িম থাকে তা হলে বহু বৎসরের কার্য এক মুহূর্তের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। কিন্তু যদি তা না হয় তবে যিকির-ফিকির, ইবাদত-বন্দিগী, রিয়াজত-মুশাক্কাত সবই নিষ্ফল। তথাপি আত্মার যদি কোন তরক্কী উন্নতি পরিদৃষ্ট হয় তবে মনে করবে তা ছলনামূলক উন্নতিমাত্র।  ইমামে রব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, খোদা ও ওলীর দয়া যদি নাহি হয় ফেরেশ্তা হলেও তার ভাগ্য অন্ধকার। আউলিয়ায়ে কিরামগণের মুহব্বতই ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক সৌভাগ্যের মূলধন। (মাকতুবাত শরীফ) স্বীয় পীর ছাহেবের প্রতি খালিছ মুহব্বত থাকলে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সাধনার পথে উদ্ভূত প্রতিবন্ধকতা তাঁকে অবহিত করা সহজ হয়। তাছাড়া খালিছ মুহব্বত থাকলে সে অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার ও সম্ভাবনা থাকেনা। গভীর মুহব্বতের কারণে পীর ছাহেবের ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ সর্বদা উক্ত মুরিদের উপর পতিত হতে থাকে। ফলে সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা ও বিপদ-আপদের হাত থেকে মুক্ত থাকে। শহীদে আ’যম, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরেলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাওলানা মুরীদ কলকাতা শহরে গিয়ে পতিতালয়ের দিকে নজর দিয়ে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ দিয়ে তা হতে মুক্ত করেছিলেন। মুলতঃ যদি কোন মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেব-এর প্রতি খালিছ মুহব্বত রেখে তাঁর নির্দেশিত ওযীফা যথাযথভাবে নিয়োমিত আদায় করে তাহলে সে মুরীদের ছুলুকের পথে কখনও কোন প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়না। আর যদি কখনও সম্ভবনা থাকেও তবে পীর ছাহেবই ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ দিয়ে তা দূর করে উক্ত মুরীদকে ফিৎনা মুক্ত করেন। “তাযকিরাতুল আউলিয়া” কিতাবে উল্লেখ আছে, একদিন একজন মুরীদ অতি প্রত্যুষে তার পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে উপস্থিত হলো। সে অত্যন্ত হয়রান-পেরেশান এবং ভয়-ভীতি অবস্থায় রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা পীর ছাহেব ক্বিবলার কাছে জানালো। সবিনয়ে বললো, হুযূর! বেয়াদবী ক্ষমা চাই। রাতে আমার গোসল ফরয হয়েছিল। এজন্য আমি অত্যন্ত চিন্তিত। মেহেরবানী করে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করুন। সব বিবরণ শুনে পীর ছাহেব ক্বিবলা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললেন, চিন্তা করনা। আমি দেখতে পেয়েছিলাম তোমার নাম জাহান্নামীদের তালিকাভুক্ত রয়েছে। কারণ হিসেবে জানতে পারলাম, তুমি উক্ত মেয়ের সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হবে। তখন তোমার নাজাতের জন্য আল্লাহ পাক-এর নিকট দোয়া করলাম এবং সুপারিশ করলাম। আল্লাহ পাক আমার সুপারিশ কবুল করতঃ ঘুমের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করিয়ে তোমাকে নাযাত দান করলেন। (সুবহানাল্লাহ) তাছাড়া নিম্নের ঘটনা থেকে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার হবে ইনশাআল্লাহ। আফযালুল আউলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় মুরীদ হযরত মীর মুহম্মদ নু’মান রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক পত্রের জাওয়াবে লিখেন, “মীর দাদ ছাহেবের দ্বারা যে পত্র পাঠিয়ে ছিলেন তা প্রাপ্তির পর একদিন ফজরের নামাযান্তে আউলিয়ায়ে কিরামগণের হালকায় উপবিষ্ট ছিলাম। তখন ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক আপনার প্রতি তাওয়াজ্জুহ দিলাম এবং আপনার নফস বা প্রবৃত্তির অবশিষ্ট চিহ্ন যা আমার নজরে পড়ল তা বিদূরীত করার জন্য ফয়েজ দিলাম। আপনার মধ্যে যে সকল তমসা ও মলিনতা অনুভূতি হতে ছিল তা অপসারণ করার চেষ্টা করলাম। অবশেষে আপনার নবচন্দ পূর্ণিমার চাঁদে পরিণত হলো। আশা করি আপনার এই কামালিয়াত বা পূর্ণতানুয়ায়ী অন্য সকলকে পূর্ণ করতে সক্ষম হবেন এবং তথাকার মরুপ্রান্তর আপনার পবিত্র অজুদের নূরে নূরানী হবে। (মাকতুবাত শরীফ) উল্লেখ্য যে, মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ  হয়েছে,

ان الانسان مركب من الخطاء والنسيان.

অর্থাঃ “নিশ্চয়ই মানুষ ভুলত্রুটি যুক্ত।” ভুল করা মানুষের স্বভাব। কোন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে স্বীয় পীর ছাহেব-এর ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার স্মরণাপন্ন হওয়া এবং কাঁদা-কাটি করতঃ তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

আল্লাহ পাক বলেন,

وما ارسلنا من رسول الا ليطاع باذن الله ولو انهم اذ ظلموا انفسهم جاءوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما.

অর্থঃ- “আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যে রসূল আলাইহিমুস্ সালামকে প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহ পাক-এর নির্দেশেই তাঁর অনুগত হবে। যখন তারা নিজেদের নফসের উপর জুলুম করবে (প্রবৃত্তির অনুগামী হবে) আর ক্ষমাপ্রাপ্তির আশায় আপনার দরবার শরীফে আসবে অতঃপর আল্লাহ পাক এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে আর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি ক্ষমা করার সুপারিশ করেন তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহ পাককে ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু হিসেবে পাবে। (সূরা নিসা-৬৪) তাফসীরে কুরতুবীর ৩ঃ২৬৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হযরত আবূ সাদিক আজদিল কুফী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন, আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পবিত্র রওজা মুবারকে রাখার তিনদিন পর একজন গ্রাম্য লোক আসলেন। তিনি পবিত্র রওজা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে পবিত্র রওজা শরীফের মাটি মুবারক স্বীয় মাথায় স্থাপন করতঃ বলতে লাগলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ! ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,

قد ظلمت نفسى وجئتك تستغفرلى فنودى من القبر الشريف انه قد غفرلك.

অর্থঃ “আমি আমার নফসের উপর জুলুম করেছি অতঃপর আপনার পবিত্র সান্নিধ্যে এসেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তখন পবিত্র রওজা মুবারক থেকে বলা হলো, “নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করা  হলো।” (সুবহানাল্লাহ) উল্লেখ যে, উক্ত আয়াত শরীফে বলা হয়েছে যে, রসূল আলাইহিমুস্ সালাম-এর অনুগত হওয়া তাঁদের অনুসরণ করা সেটা আল্লাহ পাক-এরই নির্দেশ। তাছাড়া আল্লাহ পাক-এর হুকুম আহকাম পালনের ক্ষেত্রে যদি কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় এবং রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্মরণাপন্ন হয়ে তাওবা ইস্তিগফার করে তাহলে আল্লাহ পাক তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন এবং দয়ালু হবেন। অনুরূপভাবে হক্বানী-রব্বানী পীর ছাহেবগণের ক্ষেত্রে ও একই হুকুম প্রয়োজ্য। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর তাঁরাই হচ্ছেন তাঁর নায়িব বা স্থলাভিষিক্ত। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অবর্তমানে তাদের ছোহবত ইখতিয়ার করা তাঁদের অনুগত হওয়া এবং অনুসরণ করা সেটাও আল্লাহ পাক এর নির্দেশ। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই নির্দেশ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,

يايها الذين امنوا اطيعوا الله واطيعوا الرسول واولى الامر منكم.

অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ পাক এবং তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুগত হও। আর তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমর রয়েছেন তাঁদের অনুগত হও। (সূরা নিসা-৫৯) কাজেই একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আল্লাহ পাক না করুক যদি কোন মুরীদের দ্বারা কখনও কোন নাজায়িয-হারাম কার্য সংঘটিত হয় অতঃপর সে যদি অনুতপ্ত হয়ে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তিনি যদি তাকে ক্ষমা প্রাপ্তির সুসংবাদ দেন তবে অবশ্যই আল্লাহ পাকও তাকে ক্ষমা করবেন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে স্বীয় পীর ছাহেব-এর ক্ষমাই হবে আল্লাহ পাক-এরই ক্ষমা। (সুবহানাল্লাহ)                  (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)