ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৯০)

সংখ্যা: ১৪২তম সংখ্যা | বিভাগ:

-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

দরবার শরীফে অবস্থানের আদব

প্রসঙ্গেঃ “দরবার শরীফে অবস্থানকালে কারো দ্বারা কোন প্রকার দুঃখণ্ডকষ্ট বা আঘাত পেলে তা নির্দ্বিধায় সহ্য করবে, ছবর করবে। কারো প্রতি কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণ করবে না। বরং মনে মনে এই ধারণা করবে যে, আমার সীমাহীন গুনাহ্র কারণে আমার সাথে এরূপ আচরণ করা হয়েছে। কাজেই স্বীয় গুনাহ্র জন্য তওবা-ইস্তিগ্ফার করবে এবং  তার জন্য কল্যাণ কামনা করে আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবারে দোয়া করবে।”

বদগুমান (খারাপ ধারণা) একটি জঘন্যতম বদ খাছলত। ইবাদত বন্দেগী, যিকির-ফিকিরকারী এবং পরহিজগার ব্যক্তির অন্তরেও বদগুমান উদয় হতে পারে। নিজের ইবাদত, বন্দেগী এবং পরহিজগারীতাকে অন্যান্য ইবাদতকারী ও পরহিজগার ব্যক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জানা থেকে অধিকাংশ আবিদ, পরহিজগার, ছূফী এবং দরবেশই মুক্ত নয়।

আর এরূপ লোকই অন্যের দেয়া দুঃখণ্ডকষ্ট সহ্য করে না। বরং তাদের প্রতি খারাপ ধারণা করে বসে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তি তাদের সাথে বেয়াদবী করলে কিংবা কোনভাবে কষ্ট দিলে, কিংবা দুর্ব্যবহার করলে অতঃপর যদি সে ব্যক্তি হঠাৎ কোন বিপদে পতিত হয় তবে তারা বলে থাকে দেখ, আমার সাথে বেয়াদবীর ফল। (নাঊযুবিল্লাহ) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোন মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করা মহাপাপ। (কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত)

তিনি আরো বলেন,

حسن الظن حسن العبادة.

অর্থঃ  “উত্তম ধারণা উত্তম ইবাদত।”

একজন দরবেশ লোক বহু ইবাদত করেছে বলে নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, অপরাপর লোককে তুচ্ছ জ্ঞানে ঘৃণা করে তার প্রতি বদগুমান রাখে। আর এক ব্যক্তি অপর একজন মুসলমান ভাইকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে এবং আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য পাওয়ার জন্য তাদেরকে মুহব্বত করে, এই উভয় ব্যক্তির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য আছে।

তদুপরি এমনও আশঙ্কা আছে যে, আল্লাহ তায়ালা উক্ত দরবেশ লোকটির যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকিরের মর্যাদা সেই বদগুমান কৃত লোকটিকে দান করে উক্ত দরবেশকে স্বীয় ইবাদতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত রাখতে পারেন।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বনি ইসরাঈল-এর একজন শ্রেষ্ঠ আবিদ (ইবাদতকারী) ব্যক্তি এবং আর একজন সর্বাপেক্ষা জঘন্য পাপী ব্যক্তি ছিল। একদিন উক্ত আবিদ ব্যক্তি কোন একস্থানে বসে ছিলেন। এক খণ্ড মেঘ তাঁর মাথার উপরে দিচ্ছিল ছায়া। এটা দেখে উক্ত পাপী লোকটি মনে মনে বলতে লাগল, এই দরবেশ ছাহেব স্বীয় ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির, রিয়াজত-মুশাক্কাতের দ্বারা আল্লাহ পাক-এর এমনি সন্তুষ্টি-রেযামন্দি হাছিল করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ছায়া প্রদানের জন্য এক খণ্ড মেঘকে নির্ধারণ করেছেন। আমি এই আবিদ লোকটির পার্শ্বে বসলে তাঁর ছোহবতের বরকতে হয়তো আল্লাহ তায়ালা আমার প্রতি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন। এই ভেবে পাপী লোকটি আবিদের পার্শ্বে গিয়ে বসলো। তাকে দেখামাত্র আবিদ লোকটি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিরস্কারপূর্বক বললেন, “এই লোকটি কে? কোন্ সাহসে আমার পাশে বসেছে? লোকটি তো বড়ই বে-আদব। যাও, দূর হও।” পাপী বেচারা হতাশ হয়ে নিতান্ত দুঃখিত মনে তথা হতে উঠে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মেঘ খণ্ডটিও পাপী ব্যক্তির মাথার উপর ছায়া প্রদান করে চলল। (সুবহানাল্লাহ)

তৎকালে যিনি বনি ইসরাইল বংশের নবী ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ওহী করলেন যে, ‘উক্ত ফাসিক (পাপী ব্যক্তি) ও আবিদ উভয় ব্যক্তিকে বলে দিন তারা যেন উভয়ে নতুনভাবে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির আরম্ভ করে। ফাসিক ব্যক্তি যা কিছু পাপ কার্য করেছিল, অনুতপ্ত হয়ে ঈমান পরিপক্ক করার দরুন আমি তার সমস্ত পাপ মার্জনা করেছি। আর ‘আবিদ’ ব্যক্তি যা কিছু ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-ফিকির করেছিল, বদগুমান এবং অহঙ্কারের কারণে তার সবকিছুই বাতিল করে দিয়েছি।’ (কিমিয়ায়ে সা’য়াদাত)

হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি-এর মহল্লায় এক যুবক বাস করত। সে নিতান্ত যালেম ও দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। একদিন তার দ্বারা নির্যাতিত কতিপয় লোক হযরত মালিক ইবনে দ্বীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট অভিযোগ করলো। তিনি অভিযোগ শুনে যালিম লোকটির বাড়ীতে গিয়ে অত্যাচার হতে বিরত থাকার অনুরোধ করলেন। লোকটি ছিল নিতান্ত কঠোর প্রকৃতির। সে তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে রুক্ষ স্বরে বলল, আমি বাদশাহর কর্মচারী; আমার কার্যে বাধা দান করে এমন সাধ্য কারও নেই।

হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তোমার অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহার সম্পর্কে আমরা বাদশাহর নিকট নালিশ করব।” যুবক বলল, “বাদশাহ আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। আমি যা কিছু বলি বা করি সব কিছুতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।” হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “বাদশাহর নিকট কোন প্রতিকার না পেলে আমি রহমানুর রহীম আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবার শরীফে নালিশ করব।” যুবক হেসে বলল, “তিনি তো আরও করুণাময়, এজন্য তিনি আমাকে পাকড়াও করবেন না।” এটা শুনে হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি অপরাগ হয়ে ফিরে আসলেন। এর পর লোকটির অত্যাচার আরো চরমে উঠল। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবার একদল লোক হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি এর খিদমতে উপস্থিত হল এবং তার অত্যাচার হতে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানাল। এবার হযরত মালেক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি তাকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তাঁর বাড়ীর দিকে যাত্রা করলেন। পথে তিনি একটি গায়িবী আওয়ায শুনতে পেলেন, “আমার বন্ধু হতে বিরত থাক।” এটা শুনে হযরত মালিক ইবনে দীনার রহমতুল্লাহি আলাইহি বিস্মিত হলেন। কিন্তু গমনে ক্ষান্ত না হয়ে যথাসময়ে তার বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলেন।

যালিম লোকটি তাঁেক দেখামাত্র বলে উঠল, “আবার এসেছ।” তিনি বললেন, এবার তোমাকে একটি সুসংবাদ শুনানোর জন্য এসেছি। এ বলে তিনি পথে যে গায়িবী আওয়াজ শুনেছিলেন তা ব্যক্ত করলেন। যুবক এটা শুনে বলে উঠল, “ব্যাপার যদি এরূপই হয়ে থাকে, তবে আমার যা কিছু আছে, সবকিছু আজই বন্ধুর নামে বিলিয়ে দিচ্ছি।” এটা বলে সে মুহূর্তেই তার যথাসর্বস্ব গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিল এবং আল্লাহ তায়ালার পথে বের হয়ে পড়ল।

সারকথা এই যে, পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থানরত ছূফী কিংবা অপরাপর পীর ভাইগণ কে কোন্ আমলের দ্বারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরম-পরম নৈকট্য লাভ করেছে। অথবা পীর ছাহেব ক্বিবলা কাকে কোন্ খিদমতের কারণে মুহব্বত করেন তা সাধারণভাবে বোঝা যাবেনা। কাজেই প্রত্যেকের প্রতি সুধারণা পোষণ করাই কামিয়াবীর সোপান। তাছাড়া আমি স্বয়ং খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ সাইয়্যিদুনা মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলীকে অনেকবারই বলতে শুনেছি যে, “এখানে এমন অনেক লোকই আছে যারা অনেক উচু স্তরের ওলীআল্লাহ। অথচ সেটা সে নিজেও জানেনা।”

অতঃপর প্রত্যেকেরই উচিত হবে যদি কেউ তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞানী লোককে দেখে তাহলে যেন মনে করে- বেচারা মূর্খ, নির্বোধ, দোষ-ত্রুটি ও পাপ সম্বন্ধে তার বহু ওযর গ্রাহ্য হবে, অনেক দোষ-ত্রুটি মার্জিত হবে। কিন্তু আমার জ্ঞান থাকাবশতঃ আমি সে সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত থাকব। অতএব, এ ব্যক্তি আমার চেয়ে উত্তম। আবার নিজের তুলনায় অধিক জ্ঞানী ব্যক্তিকে দেখলে মনে করবে, তিনি এমন বিষয়ের জ্ঞান রাখেন যা আমি জানি না।

কাজেই তিনি আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। নিজের চেয়ে অধিক বৃদ্ধ লোককে দেখলে মনে করবে, তিনি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত আমা অপেক্ষা অনেক বেশি করেছেন, অতএব, তিনি আমার থেকে শ্রেষ্ঠ। আর কোন অল্প বয়স্ক বালককে দেখতে পেলে মনে মনে ধারণা করবে, আমি দীর্ঘদিন বেঁচে বহু পাপ কাজ করেছি। কিন্তু এ নিষ্পাপ বালকটি এখন পর্যন্ত পাপ কাকে বলে জানেই না। অতঃপর সে আমার থেকে অনেক ভালো। মুলতঃ তাছাউফের সমস্ত কিতাবেই এ শিক্ষাই দেয়া হয়েছে।

মহান আল্লাহ পাক, যামানার ইমাম ও মুজতাহিদ মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী-এর ওসীলায় সবক্ষেত্রে সবার প্রতি সুধারণা পোষণ করার তাওফিক দান করুন। (অসমাপ্ত)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)