-হযরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম
দরবার শরীফে অবস্থানের আদব
প্রসঙ্গেঃ “দরবার শরীফে অবস্থানকালে কারো দ্বারা কোন প্রকার দুঃখণ্ডকষ্ট বা আঘাত পেলে তা নির্দ্বিধায় সহ্য করবে, ছবর করবে। কারো প্রতি কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণ করবে না। বরং মনে মনে এই ধারণা করবে যে, আমার সীমাহীন গুনাহ্র কারণে আমার সাথে এরূপ আচরণ করা হয়েছে। কাজেই স্বীয় গুনাহ্র জন্য তওবা-ইস্তিগ্ফার করবে এবং তার জন্য কল্যাণ কামনা করে আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবারে দোয়া করবে।”
ছবর (ধৈর্যধারণ) এবং শোকর দু’টি বিশেষ মাক্বাম। এই মাক্বাম দু’টি খুব কম লোকই হাছিল করতে পারে। আল্লাহ পাক বলেন,
قليل من عبادى الشكور.
অর্থঃ “আমার বান্দাদের মধ্যে শোকরগুযার বান্দার সংখ্যা খুবই কম।”(সূরা সাবাঃ ১৩)
কাজেই যারা এই মাক্বামদ্বয় হাছিল করতে পারেন তাদের মর্যাদা মর্তবা সম্মান কি পরিমাণ তা সহজেই অনুমেয়।
ছবরের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে কুরআন মজীদে নব্বইয়েরও অধিক স্থানে উল্লেখ রয়েছে। ছবরকারী বা ধৈর্যধারণকারী ব্যক্তির জন্য উচ্চ মর্যাদা ও প্রতিদানের ওয়াদা করা হয়েছে। এদের জন্য এমন এমন নিয়ামত ও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, অন্য কারও জন্য এরূপ প্রতিশ্রুতি নেই। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ
اولئك عليهم صلوت من ربهم ورحمة و اولئك هم المهتدون.
অর্থঃ “তাদের উপর তাদের রবের পক্ষ হতে বিশেষ করুণাসমূহ বর্ষিত হবে এবং সেইসঙ্গে সাধারণ করুণাও হবে। আর তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।” (সূরা বাক্বারাহঃ১৫৭)
এ আয়াতে তিনটি নিয়ামতের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এক, হিদায়াত, দুই. সাধারণ রহমত, তিন. বিশেষ রহমত। আখিরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “ছবর হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক।”
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন- “আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে যে সব নেয়ামত দান করেছেন, তম্মধ্যে ‘ইয়াক্বীন’ ও ‘ছবর’ অতি অল্প সংখ্যক লোককেই দেয়া হয়েছে। আর যাদেরকে এই অমূল্য দুইটি সম্পদ দেয়া হয়েছে, তাদের (নফল) রোযা, নামায অল্প হলেও সেজন্যে তাদের কোন ভয় নেই। হে আমার সাহাবীগণ! আপনারা আজ যে অবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন, যদি ছবর করে এই অবস্থার উপর টিকে থাকতে পারেন, তবে আপনাদের এই অবস্থা আমার নিকট এতো প্রিয় ও ভাল বলে বিবেচিত হবে যে, উক্ত অবস্থা থেকে ফিরে আপনাদের প্রত্যেকে আপনাদের সমষ্টিগতভাবে সকলের ইবাদতের সমান ইবাদত করলেও তা আমার নিকট প্রিয় হবে না। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যে, আমার পরে আপনাদের সম্মুখে দুনিয়ার পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে। ফলে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হবে এবং আসমানবাসীগণ আপনাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। কাজেই যে ব্যক্তি ছবর করবে এবং সওয়াবের আশায় থাকবে সে ব্যক্তি পূর্ণ ছওয়াব প্রাপ্ত হবে। অতঃপর আখিরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করলেনঃ
ما عندكم ينفد وما عند الله باق ولنجزين الذين صبروا اجرهم باحسن ما كانوا يعملون.
অর্থঃ “যা তোমাদের কাছে আছে, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে পক্ষান্তরে যা কিছু আল্লাহ পাক-এর নিকট আছে তা অনন্তকাল স্থায়ী থাকবে। যারা ছবর করেছে, আমি তাদেরকে তাদের আমল অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পুরস্কারে ভূষিত করবো।” (সূরা নাহলঃ ৯৬)
হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ইয়া রসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তা কি? তিনি বলেছেন, ঈমান হচ্ছে, ছবর ও উদারতা।
তিনি আরও বলেছেন, “ছবর বেহেশতের রতœভাণ্ডারসমূহের মধ্যে একটি রতœভাণ্ডার।”
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন,
افضل الاعمال ما اكرهت عليه النفوس.
অর্থঃ “শ্রেষ্ঠতর আমল হচ্ছে, যা আঞ্জাম দিতে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে হয় এবং কষ্ট সহ্য করতে হয়।”
একদা হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ওহী আসলোঃ “হে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম! আপনি আমার (আল্লাহর) আখলাক্বের অনুকরণ করুন; আর আমার আখলাক্বের মধ্যে একটি হলো- আমি ‘ছাবুর’ অর্থাৎ অত্যন্ত ধৈর্যশীল।
হযরত আতা রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আনসারী সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের কয়েকজন লোককে দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
امؤمنون انتم؟
অর্থাৎ “আপনারা কি মু’মিন?”
এ কথা শুনে তারা সকলেই নিশ্চুপ রইলেন। আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ফারুক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেনঃ হ্যাঁ- ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা মু’মিন। আল্লাহ পাক এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনারা যে মু’মিন এর প্রমাণ কি? তদুত্তরে তাঁরা আরয করলেন
نشكر على الرخاء ونصبر على البلاء ونرضى بالقضاء.
অর্থঃ “আমরা আল্লাহ পাক প্রদত্ত নিয়ামতে শোকরগুযারী করি, বিপদ-আপদে ছবর করি এবং আল্লাহ তায়ালার বিধান ও ফয়সালায় সন্তুষ্টি থাকি।”
এ কথা শুনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, مؤمنون ورب الكعبة.
অর্থঃ “কাবা শরীফ-এর রবের কসম! আপনারা পাকা মু’মিন।”
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেনঃ
فى الصبر على ما تكره خير كثير.
অর্থঃ ‘মনের বিপরীত বিষয়ের উপর ধৈর্যধারণের মধ্যে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে।”
জলীলুল ক্বদর নবী ও রসূল হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন,
انكم لا تدر كون ما تحبون الا بصبر كم على ما تكر هون.
অর্থঃ “যে সব বিষয়ে ধৈর্যধারণ কষ্টকর, সেসব বিষয়ে তোমরা ধৈর্যধারণ করতে না পারলে তোমাদের কাঙিক্ষত ও সুখময় বিষয়েও তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে না।”
তিনি আরো বলেন, “ছবরকে যদি মানুষের আকার দেয়া হতো, তবে সে অতিশয় দয়ালু হতো। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন।” (মুকাশাফাতুল ক্বুলুব/২৪৯)
মূলতঃ যাদের জাহির-বাতিন পরিশুদ্ধ তথা আউলিয়া আল্লাহ পাক তাঁদের পক্ষে প্রকৃত ছবর এবং শোকর করা সম্ভব। এমনকি তারা মাখলুক্বাতের দেয়া দুঃখণ্ডকষ্টকে কষ্ট মনে করতেন না। বরং তা মহান প্রতিপালকের পক্ষ হতে হাদীয়া মনে করতঃ ধৈর্যধারণ করতেন।
কেউ কেউ এমনও ছিলেন যে, যদি বিপদ-আপদ না আসতো তাহলে চিন্তাযুক্ত হতেন। আর বলতেন, আল্লাহ পাক কি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন!
হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ এক ব্যক্তি কোথা থেকে এসে তার চেহারা মুবারকে আঘাত করলো। অনতিদূরে কিছু লোক ছিলেন তারা ব্যাপারটি অবলোকন করতঃ বললেন, হে ব্যক্তি! তুমি কি করলে? তুমি আল্লাহ পাক-এর ওলীকে অন্যায়ভাবে আঘাত করলে?
পরিশেষে সে ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতঃ তাঁর কদম মুবারকে লুটে পড়লো। সবিনয়ে বললো, হুযূর! বেয়াদবী ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।
হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন- না, না, তোমার কোন ভুল হয়নি। কারণ, আঘাত যেখান থেকে এসেছে সেখানে কখনও ভুল হয় না।
অপর একজন বুযূর্গ ব্যক্তি ছিলেন। যিনি একদিন গলি পথে কোথাও যাচ্ছিলেন। ছাদের উপর থেকে এক ব্যক্তি তাঁর মাথার উপর ছাই নিক্ষেপ করলো।
যখন বুঝতে পারলো যে, তিনি একজন আউলিয়া-এর মাথায় ছাই ফেলেছেন তখন অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেই বুযূর্গ ব্যক্তি বললেন, তোমার কোন দোষ নেই। আমি তো আগুন দ্বারা পুড়ে যাওয়ার উপযুক্ত। অথচ আমার মাথার উপর ছাই নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেটা তো নেহায়েত অল্পই হয়েছে।
সেক্ষেত্রে পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থান কালীন দরবার শরীফে অবস্থানরত কোন ছূফীর দ্বারা দুঃখণ্ডকষ্ট পাওয়া সেটাতো কষ্ট মনে করাই উচিত নয় বরং তা হাসি মুখে বরণ করে নেয়া উচিত।
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)