ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

সংখ্যা: ১৩৯তম সংখ্যা | বিভাগ:

দরবার শরীফে অবস্থানের আদব

প্রসঙ্গঃ দরবার শরীফের খাদ্য-দ্রব্যকে ‘তাবাররুক’ মনে করে খেতে হবে। সুতরাং সেখানকার খাদ্য-দ্রব্যকে কোন অবস্থায় কোন প্রকার ত্রুটিপূর্ণ মনে করা বা মর্যাদা ক্ষুন্ন করা যাবেনা।

উল্লেখ্য যে, শুধু উদরপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে খাবার খেলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। পশুপাখি উদরপূর্ণ করার জন্যই খাবার খেয়ে থাকে। তাই তাদের খাবার গ্রহণের কোন নিয়মনীতি নেই। আর কোন নিয়ম-নীতি পালনের প্রয়োজন হয় না। বল্গাহীন ভাবে যা পায়, যেভাবে পায় সবই উদরে পূর্ণ করে।

আর মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। তাদের আশরাফিয়াতকে (শ্রেষ্ঠত্ব) বজায় রাখার জন্য অনেক নিয়ম-নীতি পালন করতে হয়। কাফির-মুশরিকরা তাদের আশরাফিয়াতকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা শরীয়তের কোন হুকুম-আহকাম পালন করে না। খাবার-দাবারের কোন নিয়ম-নীতি পালন করে না।

 আল্লাহ পাক তাদের সম্পর্কে বলেন,

يأكلون كما تاكل الانعام.

অর্থঃ- “তারা (কাফিররা) চতুষ্পদ জন্তর মত খাবার খেয়ে থাকে।” মূলতঃ কাফির-মুশরিকরা মানুষ নয় বরং মানুষ নামের পশু।”

কাজেই মু’মিন-মুসলমান তথা ছূফীগণের বিষয়টি ভিন্ন। তারা কখনও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরনার্থে খাবার খান না। বরং তারা যা খান তা একমাত্র আল্লাহ পাক এবং আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত, মুহব্বত, সন্তুষ্টি, রেজামন্দী তথা নৈকট্য লাভের শক্তি অর্জন করার উদ্দেশ্যে খেয়ে থাকেন। সুতরাং তাদের খাবার গ্রহণটাও ইবাদতের মধ্যে গণ্যহয়।

          খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম,মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা, ইমাম রাজারবাগ শরীফের হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, ‘খাবারের মাঝে মানুষ এবং ফেরেশ্তাদের স্বভাবের মাঝে পার্থক্য সূচীত হয়।’ অর্থাৎ মানুষ ইবাদত-বন্দিগী করার শক্তি অর্জনের জন্য খাবার খেয়ে থাকেন। আর ফেরেশ্তাদের খাবারের কোন প্রয়োজন হয় না। মানুষের যদি খাবারের প্রয়োজন না হতো তাহলে মানুষ এবং ফেরেশ্তাদের স্বভাবের কোন পার্থক্য থাকতো না।

পবিত্র হালাল খাদ্যের মধ্যে কি প্রকার রূহানী শক্তি থাকতে পারে তা বুঝার জন্য একটি ঘটনার অবতারণা করছি। আল্লাহ পাক-এর একজন ওলী ছিলেন। তাঁর একজন মুরীদ, একদিন আরজু পেশ করলেন যে, “আমাকে এমন একটি আমলের সন্ধান দান করুন, যার মাধ্যমে আমি আল্লাহ পাক-এর কুদরত অবলোকন করতে পারবো।” মুরীদের হৃদয়ের ব্যাকুলতার প্রতি লক্ষ্য করে পীর ছাহেব ক্বিবলা বললেন, ‘তোমার পেটে যেদিন খাছ হালাল খাদ্য যাবে সেদিনই তুমি আল্লাহ পাক-এর কুদরত অবলোকন করতে পারবে।’

পীর ছাহেব ক্বিবলার বরকতপূর্ণ উপদেশ শুনে উক্ত মুরীদ খাছ হালাল খাদ্যের সন্ধানে বের হলেন। স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফের চেয়ে অধিক উত্তম ও হালাল খাদ্য আর কোথায় থাকতে পারে? যদিও এ ব্যাপারটি সবাই সমসময় উপলব্ধি করতে পারে না।

যাই হোক তিনি খাছ হালাল খাদ্যের তালাশে বের হলেন। হাট-বাজার, মাঠ-ঘাট, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে দীর্ঘ দিন সফর করলেন। কিন্তু সেই হালাল খাদ্যের কোন সন্ধান পেলেন না। একদিন হঠাৎ এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হলো। তার এরূপ অবস্থা দেখে সেই ব্যক্তি কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এভাবে কোথায় চলছেন?” জবাবে সে মুরীদ বললেন, “আমি খাছ হালাল খাদ্যের তালাশ করছি। আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা বলেছেন, যেদিন আমার পেটে খাছ হালাল খাদ্য প্রবেশ করবে সেদিন আমি স্বচক্ষে আল্লাহ পাক-এর কুদরত দেখতে পাব।”

তখন সে ব্যক্তি অদূরে এক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ীর প্রতি ইঙ্গিত করলেন এবং বললেন, “আপনি ঐ বাড়ীতে যান, সেখানে খাছ হালাল খাদ্য পাবেন। উক্ত মুরীদ সেই বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। বাড়ীর নিকটবর্তী হয়ে অতি কাতরকণ্ঠে বললেন, “মা, মাগো! আমি একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি। আমাকে দয়া করে কিছু খাবার দাও, মা। আমি দীর্ঘ দিন হতে খাবার খাইনি।” লোকটির হাক-ডাক শুনে বাড়ী হতে ৫/৭ বছর বয়সের ছোট্ট ফুটফুটে একটি ছেলে বেরিয়ে আসলো। তার এক হাতে ছিল রুটি ও গোশ্ত অন্য হাতে ছিল এক গ্লাস পানি।

সে ক্ষুধার্ত সেই মুরীদকে খেতে দিলো। সে মুরীদ তা খেলো। খাওয়ার পরপরই মাথা, হাত, পা দারুণভাবে দোলাতে লাগলো। তার এ অবস্থা দেখে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো, “হে ব্যক্তি! আপনি এরূপ করছেন কেন?” প্রতি উত্তরে তিনি কিছুই বললেন না। ছেলেটির বার বার প্রশ্ন করার কারণে তিনি বললেন, “বাবা তুমি ছোট্ট মানুষ, এসব বুঝবে না।” ছেলেটি ছিল নাছোড় বান্দা। সে তার প্রকৃত অবস্থা না জানা পর্যন্ত ছাড়বেই না।

অবশেষে তিনি বলতে বাধ্য হলেন। বললেন, “বাবা, আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা বলেছেন, তোমার পেটে যেদিন খাছ হালাল খাদ্য পৌঁছবে সেদিনই তুমি আল্লাহ পাক-এর কুদরত অবলোকন করতে পারবে।’ আমার পীর ছাহেব ক্বিবলার কথা আজ বাস্তবে পরিণত হলো। তোমাদের দেয়া খাদ্য খাওয়ার কারণে আমি আল্লাহ পাক-এর সমস্ত কুদরত অবলোকন করতে পারছি। আমি দেখতে পাচ্ছি, একটা জাহাজ সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়েছে। সমস্ত যাত্রীরা হৈচৈ করছে। আর জাহাটাও ডুবে যাচ্ছে। আমি মোরাকাবা করে সেই জাহাজ এবং যাত্রীদেরকে উদ্ধার করছিলাম।”

ছেলেটি তাঁর কথা শুনে বললো, হে ব্যক্তি! আপনি আল্লাহ পাক-এর এত বড় নাফরমান। আগে জানলে আমি কিছুতেই আপনাকে খাদ্য দিতাম না। আপনি কি লৌহ মাহ্ফুজের দিকে একবারও লক্ষ্য করেননি? সেখানে কি লেখা আছে তা কি জানেন? লৌহ মাহফুজে লেখা আছে যে, ঐ সমস্ত লোক দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ধ্বংস বা ক্ষতি করার লক্ষ্যে জাহাজে করে যাচ্ছিল আর আল্লাহ পাক তাদেরকে ঝড়-তুফান দিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আর আপনি কিনা আল্লাহ পাক-এর বিরোধিতা করে তাদেরকে উদ্ধার করছেন।

ছেলেটির এমন রহস্যপূর্ণ বক্তব্য শুনে সে মুরীদ অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা! তুমি ছেলে মানুষ। লৌহ মাহ্ফুজের খবর জান কিভাবে?” ছেলেটি জবাবে বললো, “কেন, আল্লাহ পাক আমাদেরকে দুনিয়াতে যেভাবে পাঠিয়েছেন আমাদের অন্তকরণ ঠিক সেভাবেই রয়েছে। কোনরূপ অপবিত্রতার পরশ লাগেনি। আমার আব্বা কাঠ কাটেন এবং তা বাজারে বিক্রি করে খাছ হালাল খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। আর মা কোন দিনই কখনও বেপর্দা হননি। ফলে আমরা লৌহ মাহ্ফুজের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছি। আমরা সবকিছুই দেখতে পাই এবং বুঝতে পারি।”

কাজেই আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত হাছিলের পথে বরকতপূর্ণ খাদ্যের ব্যাপারটি কত গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়।

সুলতানুল হিন্দ, কুতুবুল মাশায়িখ, গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ, হযরত খাজা ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যেদিন হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট হতে  বরকতপূর্ণ একটি ফল খেতে পারলেন সেদিনই তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তন হলো। সেদিনই ইশ্কে ইলাহীর মুহব্বতে তাঁর অন্তর পরিপূর্ণ হলো। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সকল সম্পদ আল্লাহ পাক-এর রাহে বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মারিফাত-মুহব্বত ও নৈকট্য তালাশে বের হলেন।

আর ‘জাওয়ামিউল কালিম’ কিতাবে উল্লেখ আছে, শাইখুল আলম বাবা হযরত ফরীদুদ্দীন মাসঊদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সেদিন হতেই অভূতপূর্ব রূহানী তরক্কী শুরু হলো, যেদিন হযরত শায়খ জালালুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দেয়া একটা আনার ফলের একটা মাত্র দানা তাঁর পেট মুবারকে প্রবেশ করলো।

জনৈক বুযূর্গ বলেছেন যে, আউলিয়ায়ে কিরামগণের দরবার শরীফের শুকনা রুটি কিংবা বাসি ভাতের মধ্যে যে লজ্জত আছে তা বাদশাহী খানার মধ্যেও নেই। কারণ আউলিয়ায়ে কিরামগণের দরবার শরীফের প্রত্যেকটি দানা আল্লাহ পাক-এর নূর এবং বরকতে পূর্ণ।

যার কারণে দরবার শরীফের খাবারের দ্বারা কেবলমাত্র ক্ষুধাই নিরাবণ হয় না বরং তার দ্বারা বাতিনী নূরও পয়দা হয় এবং রূহানী তরক্কী (উন্নতী) হয় উত্তরোত্তর। কাজেই অন্যান্য খাবার যত দামী হোক না কেন তার মধ্যে সে নিয়ামত নেই।

একবার বাদশাহ জাহাঙ্গীর ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফের খাবার খেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বললেন, ‘আমার জীবনে আমি কখনও এরূপ বরকতপূর্ণ এবং সুস্বাদু খাবার খাইনি।’ (হালাতে মাশায়িখি নকশ্বন্দীয়ায়ে মুজাদ্দিদীয়া ২/৮৭)

এজন্য অতীতের অনেক আউলিয়ায়ে কিরামকে দেখা গেছে, যারা নিজ হাতে উপার্জন করে মুরীদকে স্বীয় ছোহবতে রেখে দরবার শরীফেরই খাবার খাওয়ায়েছেন। বাইরের কোন খাদ্য-দ্রব্য মুরীদকে খেতে দিতেন না। কারণ, বাইরের কোন্ খাবারের মধ্যে জুলমত বা অন্ধকার রয়েছে, আর কোন খাবার জুলমতমুক্ত তা মুরীদ নির্ণয় করতে পারবে না। ফলে সাধনা তথা রিয়াজত-মুশাক্কাতের মধ্যে হয়ত ভাটা পড়বে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।

কাজেই সকলেরই উচিত স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফের খাদ্য-দ্রব্য সর্বদা তাবাররুক মনে করে খাওয়া এবং তার যথাযথ তা’যীম-তাকরীম করা।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)