ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –

সংখ্যা: ১৩৭তম সংখ্যা | বিভাগ:

যরত মাওলানা মুফ্তী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

  দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গঃ অন্তরে সর্বদা একথাই বদ্ধমুল রাখবে যে, “এ দরবার শরীফ এমন আজিমুশ্ শান এবং মহান মর্যাদাপূর্ণ যে, এখানে সামান্য বেয়াদবীর কারণে জীবনের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে।” (ধারাবাহিক) আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভয়-ভীতি এবং আশা-আকাঙ্খার মাঝে অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

  الايمان بين الخوف والرجاء.

 অর্থঃ- “ঈমান ভয় এবং আশার মাঝে অবস্থিত।” যারা ভয়-ভীতি মুক্ত, নির্ভীক তারা ঈমানের সীমা অতিক্রম করে। আবার যারা আশা ছেড়ে দেয় নিরাশ হয় তারাও ঈমানের সীমা পেরিয়ে কুফরীতে নিমজ্জিত হয়। ইবলিস সর্বদা কোশেশে থাকে আদম সন্তানকে ভয়-ভীতি মুক্ত, নির্ভিক করতে। আবার এমন ভয়-ভীতি দেখায় যার ফলে সে নিরাশ হয়ে যায়।  উল্লেখ্য যে, পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফ অত্যন্ত ফযীলত, মর্যাদাপূর্ণ স্থান। সেখানে অবস্থান করার সময় যেমন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হবে তেমনি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণœ হবে কিংবা আদব রক্ষা করা সম্ভব হবে না আশঙ্কা করে সেখানে অবস্থান করবেনা- সেটাও সমীচীন হবে না। মূলতঃ একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে যা প্রকাশিত হবে তা ক্ষমার যোগ্য।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে,

  يايها الذين امنوا لاترفعوا اصواتكم فوق صوت النبى ولاتجهروا له بالقول كجهر بعضكم لبعض ان تحبط اعمالكم وانتم لاتشعرون.

 অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ। তোমরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কক্তস্বরকে উচু করনা এবং তোমরা পরস্পর  যেরূপ উচুস্বরে কথা বলো তাঁর সাথে সেরূপ উচুস্বরে কথা বলোনা। তাতে তোমাদের অজান্তেই তোমাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে।” (সূরা হুজুরাত/২) উক্ত আয়াত শরীফ নাযিলের পর হযরত ছাবেত ইবনে কায়েস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাহু-এর দরবার শরীফে আসা বন্ধই করে দিলেন। আপন মনে কেবল বলতে লাগলেন, ‘আমি তো তাহলে জাহান্নামী।’ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহিবে রসূলিল্লাহ, হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন- হে আবু ওমর! ছাবেত ইবনে কায়েস-এর খবর কি, সে কি অসুস্থ? হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ‘সে রকম কিছু হলে আমি তো জানতাম। তিনি তো আমার প্রতিবেশী।’  অতঃপর হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত ছাবেত ইবনে কায়েস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর বাড়ীতে গেলেন এবং বললেন, ‘সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।’ হযরত ছাবেত ইবনে কায়েস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, ‘আপনারাতো জানেনই যে, আমি কথা বলি উচুস্বরে। আর এ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে সাবধান বানী। কাজেই আমি তো জাহান্নামী।’ হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ সংবাদ আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে নিবেদন করলেন। তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাবেত ইবনে কায়েস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দরবারে নববী শরীফে আসার নির্দেশ দিলেন এবং সুসংবাদ দিয়ে বললেন, ‘সে জাহান্নামী নয় বরং সে জান্নাতী। (সুবহানাল্লাহ)’ (তাফসীরে মাযহারী) আল্লাহ পাক তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,

 فاتقوا الله مااستطعتم.

 অর্থঃ- “তোমরা আল্লাহ পাককে যথাসাধ্য বা সাধ্য মুতাবিক ভয় কর।” (সূরা তাগাবুন/১৬)

 لايكلف الله نفسا الا وسعها.

 অর্থঃ- “আল্লাহ পাক কাহাকেও সাধ্যের বাইরে কোন আদেশ বা দায়িত্ব দেননা।” (সূরা বাক্বারা/২৮৬) কাজেই কোন মুরীদের উচিত নয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে আসা বন্ধ করা। কারণ যখন কোন মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে আসা বন্ধ করে দেয় তখন সে শয়তানের খেলনার পাত্রে পরিণত হয়। শয়তান তার উপদেষ্টা সেজে বসে। অন্তরে বিভিন্ন ওয়াস্ওয়াসা বা কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে মুরীদ আস্তে আস্তে নিরাশ হয়ে গোমরাহ বা বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়। উল্লেখ্য যে, “স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফের  প্রতি সামান্যতম বেয়াদবীর দ্বারা আমার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে।” অন্তরে এরূপ আক্বীদা রাখা মুরীদের সর্বশেষ আমল। অর্থাৎ যে মুরীদ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্য-রেযামন্দি হাছিল করতে চায় তাঁর কর্তব্য হচ্ছে, সাধ্য মোতাবেক মাল-জান সর্বস্ব দিয়ে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর খিদমত করা। তাঁর প্রতি যথাযথ তাযীম-তাকরীম, আদব-ইহতিরাম বজায় রাখার পর “আমি পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর কোন খিদমতই করতে পারিনি” বলে ওজরখাহী (অক্ষমতা প্রকাশ) করা।  মূলতঃ কোন যোগ্যতাই আমার নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কোন মেজবান তার মেহমানকে নিজ বাড়ীতে দাওয়াত করলেন। মেহমানের মেহমানদারীর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলো। তাঁদের আদর-আপ্যায়নের কোন প্রকার ত্রুটিই হলো না। মেজবানের আচার-আচরণ, আদর-ইহতিরাম পেয়ে মেহমান সন্তুষ্টিও প্রকাশ করলেন। এক কথায় মেহমানদারীর কোন দিকই বাকি রইল না। এমতাবস্থায় একটা দিক বাকী থাকে। আর তা হচ্ছে মেহমানের নিকট ওজরখাহী বা অক্ষমতা প্রকাশ। কারণ মেজবান যদি ওজরখাহী করে যে, আপনাদের কোন খিদমত করতে পারিনি আপনাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তাযীম-তাকরীম বলতে কিছুই করতে পারেনি। বেয়াদবী ক্ষমা করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি ওজরখাহী বা অক্ষমতা প্রকাশ করে তবে তার এরূপ আচরণে মেহমান যেরূপ খুশি হবেন সেক্ষেত্রে যারা ওজরখাহী করবে না বা নম্রতা দেখাবে না। তারা যতই ভাল মেহমানদারী করুক না কেন মেহমান তাদের প্রতি তত খুশী হবেননা। অর্থাৎ অক্ষমতা তথা বিনয় প্রকাশই হচ্ছে পূর্ণতার আলামত বা নিদর্শন।  হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিআল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন,

  سالت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن هذه الاية والذين يؤتون ما اتوا وقلوبهم وجلة اهم الذين يشربون الخمر ويسرقون قال لا ياابنت الصديق ولكنهم الذين يصومون ويصلون ويتصدقون وهم يخافون ان الايقبل منهم اولئك الذين يسارعون فى الخيرات.

 অর্থঃ- “একদিন আমি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আলোচ্য আয়াত শরীফ

  والذين يؤتون ما اتوا وقلوبهم وجلة.

 (অর্থাৎ “এবং ঐ সমস্ত লোক তাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা ভীত কম্পিত হৃদয়ে দান করে)” সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা কি ঐ সমস্ত লোক যারা শরাব পান করে এবং চুরি করে? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন না, ‘হে ছিদ্দীকে আকবর-এর কন্যা! বরং (আয়াত শরীফে) ঐ সমস্ত লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং দান-সদকা করে। আর এই আশঙ্কায় ভীত থাকে যে, তাদের এ সমস্ত আমল সম্ভবত কবুল নাও হতে পারে। মুলতঃ এই সমস্ত লোকই দ্রুত কল্যাণ অর্জন করে থাকে। অর্থাৎ তারা পূর্ণ সফলতা লাভকারী।” (তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাযাহ শরীফ, মিশকাত শরীফ/৪৫৭) কাজেই বলার অপেক্ষা রাখে না, যে সমস্ত সালিক বা মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে আদব শিষ্টচারের প্রতি লক্ষ্য করে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকে তারাই পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারে। আর তারাই হয় সকলের অগ্রগামী।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)