ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৪)

সংখ্যা: ১৩৬তম সংখ্যা | বিভাগ:

 দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গঃ অন্তরে সর্বদা একথাই বদ্ধমুল রাখবে যে, “এ দরবার শরীফ এমন আজিমুশ্ শান এবং মহান মর্যাদাপূর্ণ যে, এখানে সামান্য বেয়াদবীর কারণে জীবনের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে।” (ধারাবাহিক) সুলতানুল আরিফীন, হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক বিশিষ্ট খলীফা ও মুরীদ ছিলেন। যিনি সারাজীবন পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর ছোহবতে কাটিয়েছেন। কিন্তু ইন্তিকালের সময় তার মুখে কলিমা শরীফ মুখে বের হচ্ছিলনা।। হযরত শায়খ ছানান রহমতুল্লাহি আলাইহি যার লক্ষ লক্ষ মুরীদ ছিলো। শাইখুল মিল্লাত হযরত ফরীদুদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মত মশহুর হাজার হাজার আলিম-উলামা, ছূফী-দরবেশ ছিলেন তাঁর খলীফা। কিন্তু কোন একদিন এক খ্রীষ্টান মেয়ের মুহব্বতে পড়ে গেলেন। মুসলমানী সমস্ত, তাহজীব-তামাদ্দুন, রীতি-নীতি, লেবাস-পোশাক ছেড়ে দিয়ে তিনিও খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেন। যদিও পরবর্তীতে গাউসুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দোয়ার বদৌলতে  সৌভাগ্য ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু কেন এই অধঃপতন? এই অবস্থায় সম্মুখীন হতে হয়েছিলো কেন? যদি শুধু আমল করলেই না’যাত বা মুক্তি পাওয়া যেত তাহলে উল্লিখিত ব্যক্তিদের এই ভয়াবহ পরিণত হলো কেন? তার অন্যতম কারণ ছিল তারা ভয়-ভীতি এবং আশঙ্কা মুক্ত হয়েছিলো। মূলতঃ যখন কেউ ভয়-ভীতি এবং আশঙ্কা মুক্ত হয়, আদব বা শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখেনা তখন তার অহঙ্কার জাহির বা প্রকাশ হয়। সে সর্বপ্রকার ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলে আজিজী-ইনকিসারী করা তথা বিনয় প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়না। বস্তুতঃ যারা আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাক্বীক্বী মারিফাত হাক্বীক্বী মুহব্বত হাছিল করতে পারেনা। যারা আকস্ বা ছায়ার মধ্যে বিরাজ করে তাদেরই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর তারাই লা’নতের তবকা বা স্তরে পড়ে যায়। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ সেই তবক্বা বা স্তরের অন্তর্ভুক্ত। তারা হাক্বীক্বী মারিফাত হাক্বীক্বী মুহব্বত হাছিল করতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, কোন নেক কাজ করলে কিংবা কোন নেক লোকের ছোহবত ইখতিয়ার করলে প্রথমতঃ সেই নেক কাজের বা নেক লোকের একটা আকস্ বা ছায়া তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। পরে আস্তে আস্তে সে তার হাক্বীক্বতে উপনীত হয়। কিন্তু সেই আক্স বা ছায়াকেই যারা হাক্বীক্বী অবস্থা মনে করে কিংবা তার প্রভাবেই গর্বিত হয়, আদব ইহতিরামের গুরুত্ব আছে বলে মনে করে না তখনই তাদের গোমরাহী বা পদস্খলন দেখা দেয়। অধিকাংশ লোকই এই আকস্ বা ছায়াকে হাক্বীক্বী মনে করে তার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে থাকে। ফলে হাক্বীক্বত বা প্রকৃত অবস্থায় পৌঁছতে পারে না।  হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং যে সমস্ত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি হাক্বীক্বতে (প্রকৃত অবস্থায়) পৌঁছে ছিলেন তারা সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন। সেক্ষেত্রে যিনি যত বেশী নৈকট্যপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি তত বেশী ভীত সন্ত্রস্ত এবং আশঙ্কাযুক্ত ছিলেন। ছিদ্দীকে আকবর, খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মাঝে মাঝে এই বলে বিলাপ করতেন, হায়! আমি যদি ঘাস হতাম। আর চতুষ্পদ জন্তু আমাকে খেত তাহলে কতইনা উত্তম হতো।’ ফারুকে আ’যম, আমীরুল মু’মিনীন, যার শানে আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 لوكان بعدى نبى لكان عمر بن الخطاب رضى الله تعالى عنه.

 অর্থঃ- “যদি আমার পরে কেউ নবী হতেন তবে তিনি হতেন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।” সেই হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রায়শঃ বলতেন, হায়! যদি আমি খড়-কুটা হতাম অথবা আমার মা যদি আমাকে জন্মই না দিতেন। আমীরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উছমান জুন্ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এমন অঝোর নয়নে কাঁদতেন যে, তাঁর চোখের পানি মুবারক দ্বারা দাড়ি মুবারক ভিজে যেত।  রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহ পাক-এর ভয়ে এতো বেশী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কান্নাকাটি করেছেন যে, শেষ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও এত বেশী কাঁদতেন যে, চোখের পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে তাঁদের গাল মুবারকে দাগ পড়ে গিয়েছিলো। একদিন এক বৃদ্ধা মহিলা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইমামে আ’যম, হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহিকে প্রশ্ন করলেন, “হে নুমান বিন ছাবিত রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনাকে মানুষ ইমামে আ’যম বলে থাকে। আপনি বলুন তো আপনার মুখের দাড়ি মুবারক উত্তম না আমার ছাগলের থোতার পশম উত্তম?” জবাবে ইমামে আ’যম, হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “হে বৃদ্ধা মহিলা! তোমার এই সুওয়ালের জাওয়াব আমি তিনদিন পরে দিব ইনশাআল্লাহ।” কিন্তু দেখা গেল, তিনদিন পরে ইমামে আ’যম হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি দুনিয়া থেকে পর্দা করলেন। আর সেই বৃদ্ধা মহিলার বিদ্বেষের আগুন তীব্রভাবে বেড়ে গেল। সে সারা এলাকায় এই বলে ঘোষণা দিতে লাগলো যে, হে লোক সকল! আপনারা যাকে ইমামে আ’যম খেতাবে ভূষিত করেছেন তিনি আমার একটা প্রশ্নের জাওয়াব দিতে না পেরে ভয়ে ভীত হয়ে শেষ পর্যন্ত ইন্তিকাল করেছেন।’ আল্লাহ পাক-এর কুদরত। সেই বৃদ্ধা মহিলা যখন তার এই ঘোষণা দিতে দিতে রাস্তার পর রাস্তা অতিক্রম করছিলো। অন্য একটি রাস্তা দিয়ে ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জিস্ম (শরীর মুবারক) দাফন করার জন্য খাটিয়াতে করে বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। চৌরাস্তায় সেই বৃদ্ধা মহিলার সাথে সাক্ষাত হলো। আর হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জিস্ম মুবারক থেকে কুদরতীভাবে জাওয়াব ভেসে আসলো, “হে বৃদ্ধা মহিলা! আজকে তোমার সুওয়ালের জাওয়াব দেয়ার সময় হয়েছে। তোমার ছাগলের থোতার পশমের চেয়ে আমার মুখের দাড়ি মুবারক অনেক অনেক উত্তম। (সুবহানাল্লাহ) তিনি আরো বললেন, হে বৃদ্ধা মহিলা! সেদিন তোমার এই সুওয়ালের জাওয়াব দেইনি কেন জানো? আমি শঙ্কিত ছিলাম যে, ঈমান নিয়ে মারা পারব কিনা? যদি ঈমান নিয়ে যেতে না পারি তাহলে তোমার ছাগলের থোতার পশমই উত্তম হবে।  কিন্তু আজ আমি নিশ্চিত। যেহেতু ঈমান নিয়ে আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টির উপর বিদায় নিয়েছি। কাজেই আমার দাড়ি মুবারকই অতি উত্তম।” (সুবহানাল্লাহ) সাইয়্যিদুল আউলিয়া, গাউসুল আ’যম, হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর যখন আল্লাহ পাক-এর সাথে দীদারের সময় হলো তখন আল্লাহ পাক-এর ভয়ে এমনভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন যে, তাঁর কলিজা-গুর্দা তছনছ হয়ে রক্ত আকারে প্রসাবের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলো।  কাজেই বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যে মুরীদ হাক্বীক্বতে (প্রকৃত অবস্থায়) উপনীত হয়েছে সে মুরীদ তার মুর্শিদ ক্বিবলাকে চিনতে পেরেছে, মুর্শিদ ক্বিবলা-এর মর্যাদা-মর্তবা উপলব্ধি করতে পেরেছে। সর্বোপরি তাঁর মুর্শিদ ক্বিবলা-এর সাথে আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তায়াল্লুক, নেছবত তথা নৈকট্যের বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে।  সুতরাং যে ব্যক্তি হাক্বীক্বতে পৌঁছতে চায় তার উচিত সর্বক্ষেত্রে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া, স্বীয় মুর্শিদ ক্বিবলা-এর এবং তাঁর দরবার শরীফের প্রতি আদব বা শিষ্টাচারিতা প্রদর্শন করা।

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৩)

 ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৫) –

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৭)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮৯)