-হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালিম
দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গঃ দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখবে। দরবার শরীফের আমানতসমূহের কখনও খিয়ানত করবে না। (ধারাবাহিক) হযরত ইউসুফ ইবনে হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি আল্লাহ পাক-এর সেই ওলীর কথা মুতাবিক স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার কাছে গেলেন। যখন তিনি গেলেন, তখন তাঁকে বলা হলো, হে ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি! আল্লাহ পাক আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত-মা’রিফত শিক্ষার জন্য, ইসমে আ’যম শিক্ষার জন্য। এই তিন বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল, আমি আল্লাহ পাক-এর কাছে সাতবার আরয করেছিলাম যে, আয় আল্লাহ পাক! আমি কি তাঁকে কিছু শিক্ষা দিব? কিছু দিয়ে দিব? আল্লাহ পাক বললেন, এখনো সময় হয়নি। আরো ধৈর্যধারণ করুন। আমি যখন বারবার আল্লাহ পাক-এর কাছে আরয করতে লাগলাম। আল্লাহ পাক বললেন, তাহলে আপনি এক কাজ করুন, পরীক্ষা করে দেখুন, সে উপযুক্ত হয়েছে কি-না? সেই পরীক্ষার জন্যই আমি আপনাকে এই কৌটার মধ্যে ইঁদুর ভরে দিয়েছিলাম। আপনি সেটা রক্ষা করতে পারলেন না। এখন এক কাজ করুন, আপনার সময় এখনও বাকি রয়েছে। আপনি দেশে চলে যান। তিনি সবক দিয়ে দিলেন এবং নছীহত করলেন। তিনটা বিষয় বললেন যে, সবচেয়ে উত্তম একটা নছীহত রয়েছে। হযরত ইউসূফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি খুব বড় আলিম ছিলেন। হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, আপনি দেশে গিয়ে আপনার ইলমের কথা প্রচার করবেন না। সাধারণ লোকের মতো আপনি বসবাস করবেন আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি হাছিল করার জন্য। তিনি বললেন, হুযূর! ইলম্ শিখেছি, আপনার ছোহবতে থেকেছি, আমি সেটা কি করে না বলে পারব? তখন বললেন, তাহলে দ্বিতীয় আরেকটা নছীহত রয়েছে।
আপনি এক কাজ করুন, ইলম্ প্রচার করুন; তবে আমার কথা বলবেন না, আপনি যে আমার কাছে মুরীদ হয়েছেন। তিনি বললেন, এটা কি করে সম্ভব? আপনি আল্লাহ পাক-এর এত বড় ওলী, আমি আপনার কাছে মুরীদ হয়েছি, বাইয়াত হয়েছি, এটা বলব না? তখন তিনি বললেন, বেশ- যদি সেটা আপনি বলতেই চান, তাহলে আরেকটা শর্ত রয়েছে, আপনাকে ওয়াজ করতে হবে, আপনি সব সময় ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ করবেন। আপনার মজলিসে মানুষ থাকুক, চাই না থাকুক। আর কখনও মানুষের জন্য অর্থাৎ নিজের জন্য ওয়াজ করবেন না, আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করবেন। যখন এ নছীহত তাঁকে করা হলো, তিনি বললেন- বেশ, তবে একটা বিষয় আমার বুঝে আসলোনা। সেটা কি? সেটা হলো, আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করতে হবে, নিজের জন্য করা যাবে না। হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, এর অর্থ হচ্ছে, আপনি যখন ওয়াজ করবেন, আপনার এলাকায় যদি অন্য কোন ওয়ায়িজ আসে ওয়াজ করার জন্য, তারা যদি সত্যিই আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করে, সেটা আপনার নিকট যদি খারাপ মনে হয় যে, সে ওয়ায়িজ ওয়াজ করে লোক আকৃষ্ট করে নিবে, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি নিজের জন্য ওয়াজ করেন, আল্লাহ পাক-এর জন্য নয়। আর অন্য কোন ওয়ায়িজ যদি আল্লাহ পাক-এর জন্য ওয়াজ করে আর আপনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন যে, হ্যাঁ আপনার কাজ সে করে দিচ্ছে, তাহলে বুঝা যাবে, আপনি আল্লাহ পাক-এর জন্য করছেন। তিনি সে নির্দেশ নিয়ে চলে আসলেন। কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পঞ্চাশ বৎসর এভাবে তিনি তাঁর পীর ছাহেবের নির্দেশ পালন করলেন। প্রথম দিকে কোন লোক হতো না তাঁর মাহফিলে। তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ করতেন। একদিন মাহফিলে কোন লোকই ছিলনা। তিনি মনে করলেন, আজকে চলে যাই, লোক যখন নেই। হঠাৎ একটা বৃদ্ধা মহিলা কোথা থেকে এসে বললেন, হে ইউসুফ! আপনি পীর ছাহেবকে যে ওয়াদা দিয়েছেন, সেটা স্মরণ রাখুন। তিনি আবার সেই ক্বিবলামুখী হয়ে ওয়াজ শুরু করে দিলেন। পঞ্চাশ বৎসর পর তিনি কামালিয়াত হাছিল করলেন। তিনি পরবর্তীতে আল্লাহ পাক-এর খালিছ ওলী ও লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছিলেন। মূলতঃ প্রত্যেক ব্যক্তিকে অনুরূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যার সূচনা হয় স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফের আমানত রক্ষার মাধ্যমে। যারা স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর নিকট আমানতদার হিসেবে পরিচিত তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছেও আমানতদার হিসেবে গণ্য। সুতরাং প্রত্যেক মুরীদের উচিত সবক্ষেত্রে স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলার আমানত রক্ষা করা। দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখা। মহান আল্লাহ পাক যামানার মহান ইমাম ও মুজাদ্দিদ-এর উছীলায় আমাদেরকে আমানত রক্ষা করার তৌফিক দান করুন এবং আমাদের সাথে যারা আমীন বলবেন তাদেরকেও তার মধ্যে শামীল করুন। ১৭। অন্তরে সব সময় একথাই বন্ধমুল রাখতে হবে, “এ দরবার শরীফ এমন আজিমুশ্ শান এবং মহান মর্যাদাপূর্ণ যে, এখানে সামান্য বেয়াদবীর কারণে জীবনের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে।” ভীত সন্ত্রস্তপূর্ণ হৃদয় আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল। মা’রিফাত-মুহব্বতের আধার। যারা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে তাঁদেরকে আল্লাহ পাক মুহব্বত করেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহব্বত করেন। সমস্ত রহমত, বরকত, সাকীনা, মাগফিরাত এবং ইহসান তারা পেয়ে যান। মূলত: তাঁরাই হচ্ছেন মুত্তাকী তথা পরহিযগার।
তাঁদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন
واعلموا ان الله مع متقين.
অর্থঃ- জেনে রাখ! নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক মুত্তাকী গণের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা/১৯৪) আর তারা সব ধ্বংসাত্মক বিষয় হতে মুক্ত। গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা এবং আযাব-গযব তাদেরকে স্পর্শ করেনা। আল্লাহ পাক বলেন,
وما كان الله معذبهم وهم يستغفرون.
অর্থঃ- “আল্লাহ পাক এরূপ নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আর তিনি তাদেরকে আযাব বা শাস্তি দান করবেন।” (সূরা আনফাল/৩৩)
পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফ আল্লাহ পাক-এর দরবার শরীফ, আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফের মত। কাজেই সেরূপ ভয় ভীতি আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হবে যেরূপ ভয়-ভীতি, আর আদব ও ইহতিরাম নিয়ে অবস্থান করতে হয় আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে। বরং পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী ভয়-ভীতি, আদব-ইহতিরাম সহকারে অবস্থান করতে হয়। কারণ একথা সর্বজন বিদিত যে, যদি কোন মুরীদ কোন বেয়াদবীর কারণে তার পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফ হতে বিতাড়িত হয় তবে তার হালাকী বা ধ্বংস অনিবার্য। পৃথিবীর কোথাও সে তার ঠাঁই পাবেনা। সব দরবার হতে সে বিতাড়িত হতে বাধ্য হবে। হযরত মানছুর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহি আল্লাহ পাক-এর মকবুল বান্দাগণের মধ্যে পরিগণিত ছিলেন। তিনি স্বীয় পীর ছাহেব হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দরবার শরীফ হতে বিতাড়িত হওয়ার কারণে জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি এমনকি ফাঁসি কাষ্টে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। হাত-পা কর্তিত অবস্থায় আল্লাহ পাক-এর দিদারে যেতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর হস্ত লিখিত ‘গাঞ্জেনামা’ নামক একখানা কিতাব অনুমতি ব্যতীত দরবার শরীফ হতে নিয়ে গেলেন। অবশ্য তিনি কিতাবখানা কোন অসৎ উদ্দেশ্যে নেননি। বরং তিনি এরূপ ধারণায় নিয়েছিলেন যে, কিতাবখানা কয়েকদিন পড়বেন। পড়া শেষ হলেই আবার যথাস্থানে রেখে দিবেন। আল্লাহ পাক-এর ওলীগণ অসন্তুষ্ট হলে সবদিক থেকে বিপদ নেমে আসে। হযরত মানছূর হাল্লাজ রহমতুল্লাহি আলাইহির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি কিতাবখানা নিয়ে যাওয়ার পরপরই তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কিতাবখানার প্রয়োজন দেখা দিলো। তিনি তা তালাশ (অন্বেষণ) করতে লাগলেন। অনেক তালাশের পরও তা না পেয়ে অত্যন্ত কষ্ট পেলেন। কিতাবখানা হযরত আমর ইবনে উছমান মাক্কী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর অতি প্রিয় ছিলো। বিশেষতঃ তা ছিলো হস্ত লিখিত বিধায় তার দ্বিতীয় কোন কপি পাওয়ার কোন উপায় ছিলনা। ফলে তিনি খুবই দুঃখিত হলেন এবং আল্লাহ পাক-এর পবিত্র দরবারে এই বলে প্রার্থনা করলেন, “আয় আল্লাহ পাক! যে ব্যক্তি আমার এ প্রাণাপেক্ষা প্রিয় কিতাবখানা নিয়েগেছে তার হাত-পা যেন দ্বিখণ্ডিত হয়।” (অসমাপ্ত)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)