হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালিম পীর ছাহেব ক্বিবলার দরবার শরীফে অবস্থানের আদব প্রসঙ্গঃ দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো সর্বদা গোপন রাখবে। দরবার শরীফের আমানতসমূহের কখনও খিয়ানত করবে না। দরবার শরীফের গোপনীয় বিষয়গুলো জানার কোশেশও (চেষ্টা) করবে না। সর্বোপরি পীর ছাহেব ক্বিবলা যদি কাউকে গোপনে কিছু বলেন, কিংবা এমন পরিবেশে কোন কথা বলেন যার গোপনীয়তা রক্ষা করার ইঙ্গিত বহন করে তবে তা কারো নিকট কখনই প্রকাশ করবে না। কেননা, এটাও আমানতের খিয়ানত বলে গণ্য। আল্লাহ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اذا حدث الرجل الحديث ثم التفت فهى امانة.
অর্থঃ- “যখন কোন ব্যক্তি কোন কথা বলার সময় এদিক-সেদিক তাকায় তখন ওটা আমানতের অন্তর্ভুক্ত।” (তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ) অর্থাৎ কাউকে কোন কথা বলার সময় তার এদিক সেদিক তাকানোর দ্বারা প্রকাশ পায় যে, সে এটাকে অন্যের নিকট গোপন রাখতে চায়। সুতরাং যাকে শুনানো হচ্ছে তার কর্তব্য হবে সেটাকে গোপন রাখা। অন্যথায় আমানতের খিয়ানত বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে পীর ছাহেব ক্বিবলা গোপনে কাউকে কোন কথা বললে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে জানতেও চাইবে না। কারণ জানতে চাওয়া কিংবা জানার আগ্রহ প্রকাশ করা উভয়ই চরম অন্যায়। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে দু’টি অবস্থা থেকে খালি নয়। হয়তো জানাবে নতুবা জানাবে না। যদি তা জানিয়ে দেয় তবে সে আমানতের খিয়ানত (বিশ্বাস ঘাতকতা) করলো। আর যদি না জানায় তবে তোমার সঙ্গে তার সুসম্পর্কের অবনতি ঘটলো। উভয় অবস্থাই তার জন্য সঙ্কটপূর্ণ। যা কোন মু’মিন অন্য কোন মু’মিন থেকে কখনো কামনা করে না।
উল্লেখ্য যে, যারা পীর ছাহেব ক্বিবলা এবং তাঁর দরবার শরীফের আমানত রক্ষা করতে পারে না তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমানতও রক্ষা করতে পারে না। আর যারা আমানত রক্ষা করতে পারে না তাদের কাছে কখনও আমানত রাখা হয় না। আর রাখলেও তা তার অযোগ্যতার কারণে চলে যায়। মূলতঃ যারা আমানত রক্ষা করার যোগ্যতা রাখে তাদের কাছেই আমানত রাখা হয়। তারাই সমস্ত নিয়ামতের অধিকারী হয়ে থাকেন। আরশ-কুরসী, লৌহ-কলম, আসমান-যমীন, আলমে নাসুত, আলমে মালাকুত, জাবারুত, বরযখের সমস্ত পর্দাই তাঁদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এক কথায় আল্লাহ পাক এবং তাঁদের মাঝে কোন পর্দা থাকেনা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী একদা প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, “তোমরা কখন, কোথায় কি কর, কি খাও, কি বল, কিভাবে থাক আমি সবই জানি; কিন্তু বলিনা। আর বলাটা সঙ্গতও নয়।” অনুরূপ কথা অতীতের অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের জীবনীতে পাওয়া যায়। সাইয়্যিদুল আওলিয়া, গাউসুল আ’যম, হযরত বড় পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমার মুখে যদি শরীয়তের লাগাম না থাকতো তাহলে আমি সমস্ত হাক্বীক্বত প্রকাশ করে দিতাম।” হুজ্জাতুল ইসলাম, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমি আল্লাহ পাক-এর মা’রিফাতের গুপ্ত রহস্য যদি প্রকাশ করি তাহলে কাছের লোক দূরে সরে যাবে এবং দূরের লোক অবিশ্বাস করবে।”
আফজালুল আওলিয়া, মাহবুবে সুবহানী, ইমামে রব্বানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “আমি আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যা জানি তা যদি ব্যক্ত করি তাহলে কাছের লোক দূরে সরে যাবে আর দূরের লোক অস্বীকার করবে।” আওলিয়ায়ে কিরামগণের এসব বক্তব্য দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, আল্লাহ পাক তাঁদের মাঝে কি প্রকার নিয়ামত আমানত রেখেছেন।
পক্ষান্তরে অনেক আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের জীবনীতে দেখা যায় যখন বাতিনী নিয়ামত আমানত বা গচ্ছিত রাখা শুরু হয়, আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহসান ও দয়া করতঃ কারো জন্য কোন নিয়ামতের দ্বার খুলে দেন কিন্তু যখন তা কারো নিকট প্রকাশ করে আমানতের খেয়ানত করে তখনই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, শুকরের গলায় মনি-মুক্তার মালা পরানো যেমন বেমানান এবং মূল্যহীন তেমনি অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে কোন নিয়ামত দেয়াও বেমানান এবং মূল্যহীন। ভল্লুকের হাতে কোদাল তুলে দেয়া যেরূপ বিপদের কারণ অনুপযুক্ত ব্যক্তির কাছে আমানত রাখাও তদ্রুপ বিপদের কারণ। সঙ্গতকারণে কোন নিয়ামত আমানত বা গচ্ছিত রাখার পূর্বে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার আবশ্যক হয়। খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ্, ইমামুল আইম্মাহ, মুহ্ইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা মুর্শিদ ক্বিবলা মুদ্দা জিল্লুহুল আলী বলেন, “মাটির পাতিল বা কোন পাত্র যার মূল্য ২/৪ টাকা মাত্র মানুষ সেটাও কেনার পূর্বে কতবার যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, টোকা দিয়ে দেখে ভাল আছে কিনা তার হিসাব নেই। আর আল্লাহ পাক তাঁর মা’রিফাত-মুহব্বতের গুপ্ত রহস্য ভা-ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ব্যতীত কাউকে দান করবেন, এটা কি করে সম্ভব?” তিনি আরো বলেন, “আফজালুল আরিফীন, হুজ্জাতুল মুহিব্বীন, ফখরুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ হযরত ইউসুফ ইবনে হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রাথমিক জীবনে স্বপ¦যোগে আল্লাহ পাক-এর জলীলুল কদর রসূল, হযরত ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-এর নির্দেশ পেয়ে শাইখুল ইসলাম, হাবীবুল্লাহ্, হযরত যুন্নুন মিস্রী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ছোহ্বত লাভের জন্য মিসরে গেলেন। একে একে তিনি তিন বৎসর সেখানে অবস্থান করলেন। তিনি বর্ণনা করেন, আমি প্রথম গিয়ে সালাম দিলাম, হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সালামের জবাব দিয়ে তিনি চলে গেলেন, আর কোন কথা বললেন না। তিনি যে মসজিদে নামায পড়াতেন, অবস্থান করতেন আমি সেখানে অবস্থান করতে লাগলাম। এক বৎসর অতিবাহিত হলো। এরপর আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আমি বললাম, রয় প্রদেশ থেকে এসেছি। এতটুকু কথা শেষ হয়ে গেল। আরেক বৎসর অতিবাহিত হলো। এরপর তিনি আমাকে বললেন, আপনি কেন এসেছেন? আমি বললাম, আমি আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত-মা’রিফত, ইসমে আ’যম যা রয়েছে, সেটা শেখার জন্য এসেছি।’ এরপর আরো এক বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর তিন বৎসর যখন অতিবাহিত হয়ে গেল তখন হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি (এর মধ্যে হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তা’লীম-তালক্বীন তাঁর মসজিদেই চলতে থাকলো। তাতে হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি অংশগ্রহণ করতে লাগলেন।) একটা কৌটা দিয়ে অর্থাৎ কাঠের ছোট একটা কৌটা দিয়ে বললেন, এ কৌটাটা নিয়ে সামনে নদী রয়েছে, নদীর অপর পারে একজন বুযূর্গ রয়েছেন সেখানে পৌঁছে দিবেন। হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ‘আমি সেটা নিয়ে রওয়ানা হলাম। নদী পার হয়ে একটা জঙ্গল, মনে মনে চিন্তা করলাম, এ জঙ্গলের মধ্যে তো কেউ দেখবেনা, কৌটার মধ্যে মনে হচ্ছে কিছু নড়াচড়া করছে, সেটা কি নড়াচড়া করছে? সেটা দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে গেলেন। সেটা খুললেন, দেখা গেল, খোলামাত্রই সেই কৌটা থেকে একটা ইঁদুর বের হয়ে এক লাফ দিয়ে জঙ্গলে পড়ে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত ইউসুফ বিন হুসাইন রয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ফিকির করতে লাগলেন, কাজটা কি হলো? ইঁদুরটা চলে গেল, জঙ্গল থেকে তো ইঁদুর ধরা সম্ভব নয়। এখন আমি কি করব? আল্লাহ পাক-এর যে ওলীর কাছে আমাকে পাঠানো হয়েছে, আমি কি তাঁর কাছে যাব? অথবা আমি ফিরে যাব? কোনটা?অনেক চিন্তা করে তিনি শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক-এর যে ওলীর কাছে পাঠানো হয়েছিল, তাঁর কাছে তিনি গেলেন। যাওয়া মাত্রই সেই আল্লাহ পাক-এর ওলী বললেন যে, ‘হে ব্যক্তি! আপনি তো এসেছেন আল্লাহ পাক-এর মুহব্বত, মা’রিফত শেখার জন্য, ইসমে আ’যম শেখার জন্য হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে। কিন্তু আপনাকে একটা সাধারণ ইঁদুর কৌটার মধ্যে দেয়া হলো, সেটা আপনি বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাহলে আল্লাহ পাক-এর ইসমে আ’যম, মুহব্বত-মা’রিফত যদি দেয়া হয়, সেটা কি করে আপনি বরদাস্ত করবেন? আপনি আবার ফিরে যান হযরত যুন্নূন মিসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে। (চলবে)
হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮০)
ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮২)