ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার: পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮)

সংখ্যা: ১৩০তম সংখ্যা | বিভাগ:

 -হযরত মাওলানা মুফতী সাইয়্যিদ মুহম্মদ আব্দুল হালীম

দরবার শরীফে অবস্থানের আদব

১৫। দরবার শরীফের প্রত্যেকটি বিষয় এবং বস্তুর প্রতি ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব সর্বদা বজায় রাখা। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফের প্রতিটি বিষয় এবং বস্তুর প্রতি যেরূপ ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব বজায় রেখেছেন সালিক বা মুরীদগণকে তদীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা-এর দরবার শরীফের প্রতিটি বিষয় ও বস্তুর প্রতি সেরূপ ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব বজায় রাখা আবশ্যক। আমিরুল মু’মিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে স্থানে উপবেশন করতেন সে স্থানে হাত বুলিয়ে সেই হাত দিয়ে আপন মুখ-মণ্ডল মুছতেন। (মাদারেজুন্ নুবুওওয়াত) হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে উচ্চস্বরে কখনও কোন কথা বলতেন না। একবার বণি তামিম গোত্রের কতিপয় নবাগত লোক হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে উপস্থিত হলেন। হুজরা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। বিষয়টি আল্লাহ পাক পছন্দ করলেন না। ফলে আল্লাহ পাক আয়াত শরীফ নাযিল করে জানালেন,

  ان الذين ينادونك من وراء الحجرت اكثرهم لا يعقلون.

অর্থঃ- “(হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) নিশ্চয়ই যারা হুজরা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে আপনাকে ডাকাডাকি করেন তাদের অনেকেই আক্বলমন্দ নয়।” (সূরা হুজুরাত/৪) ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি মদীনা শরীফের সীমানায় কোন পশুর উপর সওয়ার হতেন না। তিনি বলতেন, এখানকার মাটি আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরশ পেয়ে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। কোথাও তিনি শয়ন করেছেন, কোথাও বা উপবেশন করেছেন। আর সেই মাটিতে আমি অশ্বারোহী হয়ে পথ চলবো- একথা ভাবতেও আমি ভীত ও লজ্জিত হই। (মাদারিজুন্ নুবুওওয়াত) উল্লেখ্য যে, বিনীত ও বিনম্র হওয়া নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের স্বভাব। তার বিপরীত অহঙ্কার ও উদ্ধত হওয়া ইবলিসের স্বভাব।  মূলতঃ আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রহমত এবং ইহসান যাদের উপর বর্ষিত হয় তারাই সর্বক্ষেত্রে ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ভাব বজায় রাখতে পারেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

 ان الذين يغضون اصواتهم عند رسول الله اولئك الذين امتحن اله قلوبهم للتقوى لهم مغفرة واجر عظيم.

 অর্থঃ- “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে (বিনীত-বিনম্র হয়) তাঁরা তো সেই সমস্ত লোক যাদের অন্তরকে আল্লাহ পাক তাকওয়া বা পরহেযগারীর জন্য পরিশুদ্ধ করেছেন। তাঁদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।” (সূরা হুজুরাত/৩)  উক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,

طهرهم من ك قبيح وجعل فى قلوبهم الخوف من الله والتقوى.

অর্থঃ- “তাদেরকে (যারা বিনীত-বিনম্র হয়েছে) আল্লাহ পাক সর্বপ্রকার অপছন্দনীয় বিষয়াবলী হতে পুতঃপবিত্র রেখেছেন এবং তাঁদের অন্তরে খোদাভীতি এবং তাক্বওয়া দ্বারা পরিপূর্ণ করেছেন।” আমিরুল মু’মিনীন খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,

اذهب عن قلوبهم الشهوات.

 অর্থঃ- “তাঁদের অন্তকরন হতে কু-প্রবৃত্তি তথা সর্বপ্রকার কামনা-বাসনাকে দূর করে দিয়েছেন।”

 امتحن قلوبهم فاخلصها.

  অর্থাৎ- “তাঁদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং তাতে ইখলাছ দান করেছেন।” (তাফসীরে কুরতুবী, ইবনে আব্বাস, আবী সউদ, তাবারী, মাযহারী) স্মর্তব্য যে, উক্ত আয়াত শরীফখানা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উদ্দেশ্যে নাযিল হলেও এর হুকুম তাঁর নায়িব তথা হক্বানী-রব্বানী আলিম, আউলিয়ায়ে কিরামগণের ক্ষেত্রে সম্মকভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ যে সকল মুরীদ স্বীয় পীর ছাহেব ক্বিবলা এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় ও বস্তুর প্রতি ভদ্রতা-নম্রতা এবং বিনয়ভাব বজায় রাখবে আল্লাহ পাক তাদের অন্তরসমূহকে তাক্বওয়া বা পরহেযগারীর জন্য পরিশুদ্ধ করবেন এবং তাদেরকে পরিপূর্ণ ইখলাছ দান করবেন।  (সুবহানাল্লাহ)  সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من تواضع لله رفعه الله.

অর্থঃ- “যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-এর জন্য বিনয়ী হবে আল্লাহ পাক তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন।” (মিশকাত শরীফ) তিনি এতটুকু মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী হবেন যে, তাঁকে মুহব্বত করা, তাঁর প্রতি বিনয়ী হওয়া উম্মতের আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 اذا رأيتم المتوا ضعين من امتى فتواضعوا لهم.

  অর্থঃ- “যখন তোমরা আমার উম্মতের বিনয়ী ব্যক্তিদেরকে দেখবে তখন তাঁদের প্রতি বিনয়াবনত হবে।”  হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম বলেন,

طوبى للمتواضعين فى الدنيا هم اصحاب المنابر يوم القيامة.

অর্থঃ- “বিনয়ীদেরকে দুনিয়াতে সুসংবাদ দাও। তাঁরা কিয়ামতের দিন নূরের মিম্বরের অধিকারী হবেন।” (মুকাশাফাতুল কুলুব/২১০) সাইয়্যিদুশ্ শুয়ারা, শাইখুল মিল্লাত ওয়াদ্ দ্বীন, মুছলিহুদ্ দ্বীন হযরত শায়খ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় বিশ্বখ্যাত  ‘কারীমা’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন,

 تواضع كند مرد راصرفراز+ تواضع بود سرو ران راطراز

অর্থঃ- ‘বিনয়-নম্রতা মানুষকে সরদার বানিয়ে দেয়। মূলতঃ বিনয়-নম্রতা হলো সরদারদের সৌন্দর্যবর্ধক বস্তু।’

 تواضع كند بركه بست ادمى+ نه زيبد زمردم بجزمردمى.

অর্থঃ- ‘যেই ব্যক্তি প্রকৃত মানুষ তিনিই বিনীত-বিনম্র হন সেহেতু মানুষের জন্য মনুষ্যত্ব ছাড়া আর কিছু শোভা পায়না। মূলতঃ নম্রতা বিনয়ভাব বজায় রাখাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।’

 উদূ লেখা ঢুকবে………………………………..

অর্থঃ-‘বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই বিনয়-নম্রতাকে গ্রহণ করেন, ফলে পূর্ণ বৃক্ষের শাখা মাটির দিকেই মাথা রেখে ঝুঁকে থাকে।’

উদূ লেখা ঢুকবে………………………………..

অর্থঃ- ‘বিনয়-নম্রতা তোমার সম্মান-ইজ্জতকে বর্ধিত করবে এবং এটাই জান্নাতুল ফিরদাউসে তোমার স্থান করে দিবে।’  উদূ লেখা ঢুকবে………………………………..

অর্থঃ- ‘বিনয়-নম্রতা হলো বেহেশ্তের চাবি। এটা নেতৃত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তির সৌন্দর্যবর্ধক।’ বিনয় ও নম্রতা ছূফী তথা আল্লাহওয়ালাগণের বিশেষ গুণ।  বিনয় ও নম্রতা ব্যতীত কেউ কোন নিয়ামত হাছিল করতে পারেননি। আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নৈকট্য-রেযামন্দি লাভ হয়নি।  ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ‘মাবদা ওয়া মায়াদ’ কিতাবে উল্লেখ করেন, “একদিন আমি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় আমার  দৃষ্টি স্বীয় খারাবীর দিকে পতিত হলো। কিছু সময় এ অবস্থায় অতিবাহিত হলে আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, ছূফী-দরবেশগণের সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই। সেই অবস্থায় অন্তকরণে শব্দ শুনতে পেলাম যে,

غفرت لك ولمن توسل بك الى بواسطة اوبغير واسطة الى يوم القيامة.  অর্থাৎ- “আপনাকে ক্ষমা করলাম এবং যে ব্যক্তি মধ্যস্থতায় অথবা বিনা মধ্যস্থতায় আমার নৈকট্য লাভের জন্য ক্বিয়ামত পর্যন্ত আপনাকে ওসীলা বানাবে তাকেও ক্ষমা করে দিলাম।” এটা বার বার আমার অন্তরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। অবশেষে যখন আমি সন্দেহমুক্ত হলাম তখন উক্ত নিয়ামত প্রকাশ করার জন্য আদিষ্ট হলাম।

(রওজাতুল কাইয়্যূমিয়াত)

হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (২৫৮)

   ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৮) 

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮০)

  ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৭৬)

ফিক্বহুল হাদীছ ওয়াল আছার পীর ছাহেব ও মুরীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে (৮২)